English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২১-১১-০১ ২৩:৪০:১৪
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৯ ১০:৪১:৩৪


আলবার্ট আইনস্টাইন ও মহাবিশ্ব

আলবার্ট আইনস্টাইন ও মহাবিশ্ব


 বজলুল করিম আকন্দ

 

একসময় সারাবিশ্বের সংবাদমাধ্যমে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এত বেশি গুরুত্ব পায় যে, আইনস্টাইন তখনকার সুপারস্টারদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ১৯৩১ সালে হলিউড সুপারস্টার চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাসিটি লাইটস’-এর উদ্বোধনী শোতে অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন আইনস্টাইন তখন উপস্থিত দর্শকেরা চার্লিকে দেখে যতটা আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন আইনস্টাইনকে দেখে তখন আইনস্টাইন চার্লিকে বলেছিলেন, ‘সবাই আপনার ভূয়সী প্রসংশা করেন যদিও আপনি একটি কথাও বলেন না


উত্তরে চার্লি বলেছিলেন, ‘তা ঠিক, তবে আপনার খ্যাতি তার চেয়েও বেশি যদিও তারা আপনি যা বলেন তা  বোঝেন না

আইনস্টাইনের বিশ্বজুড়ে খ্যাতির পেছনে রয়েছে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এটির জনক আলবার্ট  আইনস্টাইন স্থান-কাল এবং ভর শক্তির মিলনের ভীষণ সুন্দর এই দলিল গণিতের ভাষায় লেখা একসময় তত্ত্ব খুব কমসংখ্যক লোকই বুঝতে পারতেন ইদানীং সংবেদনশীল বেশ কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এটি বোধগম্য হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি হয়েছে এতে কোনো ভুল এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির উলম শহরে এক ইহুদি পরিবারে আইনস্টাইনের জন্ম প্রাচীনকাল থেকে উলম-এর বাসিন্দারা গণিতে -িত ছিলেন বলে কথিত আছে উলমে আইনস্টাইনের পূর্বপুরুষদেরফিদারবেডস’- এর ব্যবসা ছিল ওখানে তাঁদের ব্যবসা ভালো চলছিল না তাই আইনস্টাইনের জন্মের এক বছর পরই তাঁর পিতা-মাতা মিউনিখে চলে আসেন এখানে তাঁর পিতা হেরম্যান চাচা জ্যাকব গ্যাস বিদ্যুৎ সাপ্লাই-এর ব্যবসা শুরু করেন এই ব্যবসার আয়ে তাঁদের সংসার চলত হেরম্যান সাদাসিদে প্রকৃতির লোক ছিলেন সম্ভবত কারণেই তিনি সফল ব্যবসায়ী হতে পারেননি বাল্যকাল থেকেই হেরম্যানের গণিতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো সঙ্গতি ছিল না তাঁর পরিবারের তবে তাঁর ছোট ভাই জ্যাকব ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পেরেছিলেন আইনস্টাইনের মা পলিন ছিলেন খুবই বিচক্ষণ দৃঢ় মনোবলের অধিকারিণী তাঁর মা সঙ্গীতের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল তিনি ভালো পিয়ানোবাদক ছিলেন এটিই সম্ভবত আইনস্টাইনের সঙ্গীতপ্রিয়তায় উৎসাহ যুগিয়েছে সবসময়


শৈশবে কেমন ছিলেন আইনস্টাইনশৈশবে তিনি কথা বলতে শুরু করেন একটু দেরিতে ছোট বোন মাজা ছিল তাঁর খেলার সাথী সাত বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশুনা করেন তিনি টিউটরের মুখে আলবার্টের প্রশংসা শুনে মা পলিন আহ্লাদিত কারণ, তাঁর ভয় ছিল, দেরিতে কথা বলেছে যে ছেলেটা, সে যেন বোবা না হয় তাঁকে স্কুলে ভর্তি করার পর রিপোর্ট কার্ড দেখে মা রীতিমত বিমর্ষ কারণ, তা মোটেও আশাব্যঞ্জক ছিল না অন্যদের সঙ্গে একদম মেশে না, পড়া মুখস্থ বলতে পারে না, আর প্রশ্ন করলে অনেকক্ষণ পরে জবাব দেয় প্রায়ই জবাব দেওয়ার আগে কী যেন বিড়বিড় করে এর কারণ, পিটুনির ভয় পড়া ভুল বললে বেতের বাড়ি খেতে হবে তাই উত্তরটা বলার আগে বিড়বিড় করে আওড়ে নেওয়া স্কুল-কলেজের রেজাল্ট যদি বিচার করা হয়, তা হলে প্রায় মাঝারি তাঁর রেকর্ড, যদিও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি এগিয়েছিলেন অনেক সতীর্থ বিজ্ঞানীর চেয়ে হঠাৎ তাঁর বাপ-চাচার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয় তাই তখন তাঁর পরিবার জার্মানি ছেড়ে ইতালির মিলান শহরে বসবাসের জন্য চলে আসেন আলবার্ট তখন মিউনিখে লুটপোল্ড জিমনেসিয়াম স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র, বার্ষিক পরীক্ষার জন্য তাঁকে আরও কিছুদিন মিউনিখে থাকতে হবে কিন্তু মিউনিখের বিদ্যালয় তাঁর কিছুতেই ভালো লাগত না সেখানকার বাঁধাধরা নিয়ম-কানুন তাঁর কাছে সামরিক বিদ্যালয়ের মতোই মনে হতো তাই তিনি কিছুদিন পরেই মিলানে বাবা-মা সাথে মিলিত হলেন লুটপোল্ড জিমনেসিয়াম স্কুলের কঠোর শাসনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস  ফেললেন ইতালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করল এই সুযোগে তিনি ইতালির নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন

কিছুদিন এইভাবে কাটানোর পর তিনি ঠিক করলেন, ভর্তি হবেন জুরিখ-এর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সেসময় কারিগরী শিক্ষার জন্য সুইজারল্যান্ডের ওই কলেজের খুব নাম আইনস্টাইন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেন এবং ফেল করলেন তাঁকে ঘিরে পরীক্ষায় ফেল করার যে বদনামটা বিখ্যাত হয়ে আছে, তা সম্ভবত এই ঘটনার জন্য হ্যাঁ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ভর্তি টেস্টে ফেলই করেছিলেন আইনস্টাইন কিন্তু বড় সত্যিটা এই যে, ফরাসি ভাষা, রসায়ন এবং জীববিদ্যার পরীক্ষাগুলো একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছিল তাঁকে অথচ, গণিত পদার্থবিদ্যার স্কোর এতো ভালো ছিল যে, পদার্থবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক হাইনরিখ ফ্রেডরিক ওয়েবার বললেন, ভর্তি করে ছেলেটিকে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রদের সঙ্গে ক্লাস করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে সম্ভবত অধ্যাপক ওয়েবারের ওই মূল্যায়নে খুশি হয়ে প্রিন্সিপাল আইনস্টাইনকে একটা চমৎকার প্রস্তাব দেন এরপর স্কুল পাশ করে এলে এই কলেজে ভর্তির জন্য তাঁকে আর একবার টেস্টে বসতে হবে না আইনস্টাইন তাই নাম লেখালেন জুরিখ থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে আরাউ শহরের হাই স্কুলে পাশ করলেন ওখান থেকে মার্কস মোটামুটি ভালো আইনস্টাইন এবার ভর্তি হলেন তাঁর সাধের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কিন্তু সেখানেও ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো হলো না

আইনস্টাইন তাঁর আত্মজীবনীতে ছাত্রজীবনের অবস্থা ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘পড়াশুনায় খুব ভালো বা খুব খারাপ, কোনোটাই ছিলাম না আমি আমার প্রধান সমস্যা ছিল দুর্বল স্মৃতিশক্তি, বিশেষত রচনাধর্মী বিষয়গুলোতে শুধু গণিত আর পদার্থবিদ্যায় আমি, নিজের চর্চায়, স্কুলের পাঠ্যতালিকার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকতাম

তরুণ আইনস্টাইন কীভাবে তৈরি করেছিলেন নিজেকে, তার ইঙ্গিত মেলে এই মন্তব্যে এটা শুধু পাঠ্যবিষয়ের ক্ষেত্রে নয়, তাঁর বেহালা বাজানোর ব্যাপারেও একই কথা তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি তালিম নিয়েছিলাম ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত কিন্তু শিক্ষকদের কাছে তেমন কিছু শিখতে পারিনি তারা জিনিসটাকে অভ্যাসমাফিক চর্চার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেন না আমার বয়স যখন তেরো, তখন আমি সত্যি সত্যি শিখতে শুরু করি কারণ, সেসময় আমি প্রেমে পড়ে যাই মোজার্ট- এর সোনাটার

বিস্ময় জন্ম নেয় তখন, যখন আমাদের মনে বদ্ধমূল ধারণার সঙ্গে সংঘাত বাধে কোনো অভিজ্ঞতার’-তাঁর শৈশবে এরকম একটি বিস্ময়ের বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায় সেসময় তাঁর বয়স পাঁচ বছর একবার জ্বরের সময় অসুস্থ ছেলের মন ভালো করার জন্য বাবা তাঁকে এনে দিয়েছিলেন একটা খেলনা সেটা ছিল একটা কম্পাস যার ছোট্ট কাঁটা বরাবর উত্তর দক্ষিণমুখী হয়ে থাকে, তা সে যতই ঘোরানো হোক না কেন কম্পাসটাকে ওই অভিজ্ঞতা এক গভীর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল তাঁর জীবনে শৈশবে আর এক  রহস্যের সঙ্গে মোলাকাতের বর্ণনা আইনস্টাইনের রচনায় পাওয়া যায় এরকম, ‘বারো বছর বয়সে আমি সম্পূর্ণ আলাদা দ্বিতীয় একধরনের বিস্ময়ের মুখোমুখি হই ইউক্লিডীয় জ্যামিতির চটি একখানি বইয়ের মাধ্যমে এক শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ওটি হাতে আসে আমার

কীভাবে বইটা পেলেন তিনি সে আর-এক কাহিনী ১৮৮৯ সালে অর্থাৎ আইনস্টাইনের দশ বছর বয়সে, তাঁদের পরিবার যখন মিউনিখের বাসিন্দা, তখন পোলান্ডের এক গরীব ছাত্র ওখানে আসেন ডাক্তারি পড়তে ছেলেটির নাম ম্যাক্স তালমুদ প্রায়ই রাতের খাবার খেতে আইনস্টাইনদের বাড়িতে আসতেন তালমুদ তাঁর মুখে বিজ্ঞানের নানা গল্প শুনতেন আইনস্টাইন তালমুদেরও ভালো লেগেছিল আইনস্টাইনকে এই তালমুদ আইনস্টাইনকে পড়তে দিয়েছিলেন জ্যামিতির বইখানা বইটা পড়ার পর অভিজ্ঞতার কথা আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘দেখলাম ওর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু ঘোষণা যেমন, যে-কোনো ত্রিভুজের তিনটি উচ্চতার একই বিন্দুতে ছেদ করার ব্যাপারটা যা আপাতদৃষ্টিতে মোটেই আবশ্যিক মনে হয় না কিন্তু যুক্তি দিয়ে এর সত্যতা এমন অকাট্যভাবে প্রমাণ করা হয়েছে যে, ব্যাপারে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না গোটা ব্যাপারটার এই স্বাভাবিকতা এবং অকাট্যতা আমার মনে এক অবর্ণনীয় ছাপ ফেলে দেয়তা দেওয়ারই কথা জ্যামিতি তো শুধু যুক্তির পর যুক্তি, অনেকটা সিঁড়ি ভাঙ্গার মতো এই যে শুধু যুক্তি সম্বল করে এগিয়ে সত্যের দরজায় পৌঁছানো এই পদ্ধতির সাফল্য বালক আইনস্টাইনের জীবনে দ্বিতীয় মূল্যবান উপলব্ধি কম্পাসের কাঁটা যদি ইঙ্গিত দেয় বিশ্বের ঘটনাবলীর পেছনে লুকানো ক্রিয়াকলাপের, তবে জ্যামিতির উপপাদ্যেরা তাঁর চিন্তায় ঢুকিয়ে দেয় আর এক প্রত্যয় চিন্তা, শুধু চিন্তার অসীম ক্ষমতা ল্যাবরেটরি কিংবা যন্ত্রপাতি ছাড়াও কেবল গভীর চিন্তার সাহায্যে জগতের সত্যাবলী আবিষ্কার করা যায় জ্যামিতির চটি বইখানা যিনি দিয়েছিলেন সেই ম্যাক্স তালমুদ আইনস্টাইন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘আমি কখনও ওঁকে পড়তে দেখিনি শিশু সাহিত্যের বই দেখিনি স্কুলের বন্ধু কিংবা সমবয়সীদের সঙ্গে হুটোপুটি করতে ওঁর একমাত্র বিনোদন ছিল বাজনা দেখতাম, ওই বয়সেই মা সঙ্গে বাজাচ্ছে মোজার্ট, আর বিটোফেনের সুর’                


                               

জুরিখ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ফাইনাল পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্টের ফল হাতেনাতে পেলেন আইনস্টাইন সহপাঠীদের মধ্যে চাকরি জুটল না একমাত্র তাঁরই আইনস্টাইনের হতাশা চরমে বেকারত্বের সঙ্গে রয়েছে আরও এক সমস্যা তাঁর প্রেমিকা মিলেভা তাঁর মায়ের চক্ষুশূল এবং সেই নিয়ে পরিবারে ঘোর অশান্তি বিয়ে করা হলে একটা রোজগার দরকার হন্যে হয়ে আইনস্টাইন চলে এলেন বার্ন শহরে পেট চালাতে বিজ্ঞাপন দিলেন খবরের কাগজে ঘন্টা হিসেবে পারিশ্রমিকে ছাত্র পড়াবেন বিষয় গণিত আর পদার্থবিদ্যা জুটল ছাত্র ইতিমধ্যে কাগজে এক বিজ্ঞপ্তি থেকে একটা চাকরির দরখাস্ত পাঠিয়েছেন বেকার আইনস্টাইন জুরিখ পলিটেকনিকে তাঁর ক্লাসমেট মার্সেল গ্রসম্যানের এক আত্মীয়কে ধরে অনেক চেষ্টার পর জুটল চাকরিটা, সুইস পেটেন্ট অফিসে পদ, পেটেন্ট এগজামিনার, টেকনিক্যাল এক্সপার্ট, থার্ড ক্লাস ১৯০২ সালের জুন মাসে চাকরিতে যোগ দিলেন আইনস্টাইন

নতুন কোনো পণ্য আবিষ্কৃত হওয়ার পর এটির পেটেন্টের জন্য আবেদন করা হয় এবং এগুলো টেকনিক্যাল এক্সপার্ট দিয়ে যাচাই-বাছাই করতে হয় জনপ্রিয় রচনায় আইনস্টাইনের এই চাকরিটাকে ‘ ‘পেটেন্ট অফিসের কেরানিবলে লেখা হয় তা কিন্তু ঠিক নয় কাজটি করতে গণিত কিংবা পদার্থবিদ্যার প্রভূত জ্ঞানের দরকার হয় তাই ল্যাবরেটরিতে বসে না থাকলেও বিজ্ঞানচর্চা থেকে কিন্তু দূরে ছিলেন না আইনস্টাইন পেটেন্ট অফিসের নির্ধারিত কাজ তিনি খুব সহজেই সেরে ফেলতেন তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি পর পর চারটি গবেষণাপত্র লিখে ফেলেছিলেন ১৯০৫ সাল, বয়স তাঁর মাত্র ছাব্বিশ বছর এসময় জার্মান বিজ্ঞান জার্নালঅ্যানালেন ডার ফিজিক’- তিনি একে একে চারটি পেপার জমা দেন এজন্য ১৯০৫ সাল আইনস্টাইনেরএনাস মিরাবিলিসবাবিস্ময় বছর’; এর শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২০০৫ সালকেবিশ্ব পদার্থবিদ্যা বর্ষহিসেবে ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রসংঘ পেপারগুলোতে রেফারেন্স পর্বটি ছিল না রেফারেন্স পর্ব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত পেপারগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিক অনেকটা কারণে আইনস্টাইনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক মিথ কে না জানে যে, সত্যের চেয়ে মিথ চিরকালই মানুষের বেশি প্রিয় আইনস্টাইন সম্পর্কে মিথটি ছিল এই যে, তাঁর  বৈপ্লবিক আবিষ্কারগুলোতে তিনি পৌঁছেছিলেন পেটেন্ট অফিসে নিজের ডেস্কে বসে একা একা ভাবতে ভাবতে কী কী ছিল সেই চারটি পেপারে? প্রথম পেপারটির প্রতিপাদ্য এই যে, আলো কণা তরঙ্গ উভয়ভাবেই আচরণ করে থাকে এক বিপ্লবী বক্তব্য, সমসাময়িক -িতদের পক্ষে যা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না ১৯২১ সালে আইনস্টাইন নোবেল প্রাইজ পান ওই আইডিয়ার জন্য ১৯০৫ সালের দ্বিতীয় পেপারের প্রতিপাদ্য, পদার্থের পরমাণু অণুর অস্তিত্বের প্রমাণ তখনও পর্যন্ত পরমাণুর উপস্থিতি মানতেন না অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীরা আইনস্টাইন ভেঙ্গে দেন তাঁদের ভুল ধারণা এর পরের দু'টি পেপারে আলোচিত হয় সেই যুগান্তকারী আইডিয়া-বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং তার সুবাদে, বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিখ্যাত ফর্মুলা E= mc2 এটি বস্তুর ভর শক্তির সমতুল্যতার নীতি প্রসঙ্গে; পারমাণবিক বোমা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ চারটি পেপারের প্রত্যেকটিই এমন যে, পদার্থবিদ্যার বইপত্র নতুন করে লেখার প্রয়োজন দেখা দেয়

বিশেষ আপেক্ষিকতা গতিবিষয়ক তত্ত্ব এবং এটি নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে চলা বস্তুর ওপর কাজ করে প্রবন্ধটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছেচলন্ত বস্তুর তড়িৎগতিবিদ্যা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন এখানে একটি সাধারণ ধারণা প্রকাশ করলেন, সমস্ত ভৌত বিধি এবং বিশেষ করে আলোর বেগ সব নির্দিষ্ট গতিতে ধাবমান পর্যবেক্ষকদের কাছে একভাবে প্রকাশিত হবে এই ধারণা, পরে দেখা গেল, আমাদের স্থান কালবিষয়ক ধ্যানধারণায় একটি বিপ্লবের দাবি রাখে কেন, তা দেখতে হলে কল্পনা করুন দুটি ঘটনা একই স্থানে, একটি জেট প্লেনে ঘটে, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জেট প্লেনের একজন পর্যবেক্ষকের কাছে দুটি ঘটনার মধ্যে দূরত্ব শূন্য কিন্তু ভূমিতে দ্বিতীয় একজন পর্যবেক্ষকের কাছে ঘটনা দুটি জেট প্লেনের দূরত্বে আলাদা হয়ে ঘটবে, দুটি ঘটনার মধ্যে যে দূরত্ব প্লেনটি অতিক্রম করেছে এতে দেখা যায় দুজন পর্যবেক্ষক যারা পরস্পরের আপেক্ষিকতায় গতিশীল তারা দুটি ঘটনার মধ্যে দূরত্ব নিয়ে একমত হবে না এখন মনে করুন দুজন পর্যবেক্ষক একটি আলোর স্পন্দন যা প্লেনের লেজ থেকে নাকের দিকে যাচ্ছে তা দেখছে ওপরের উদাহরণের মতোই তারা দুজন আলোর দূরত্ব নিয়ে একমত হবে না দূরত্বটি হলো আলো প্লেনের লেজ থেকে প্রক্ষিপ্ত হয়ে সামনে নাকে পৌঁছার যেহেতু গতিবেগ হলো যে দূরত্ব অতিক্রান্ত হয়েছে তাকে সময় দিয়ে বিভাজন, অর্থাৎ যদি তারা আলোর স্পন্দনটির গতি নিয়ে একমত হয়, তারা শুরু শেষ সময়ের বিরতি নিয়ে কখনই একমত হবে না তার মানে যদিও দুজন পর্যবেক্ষক দুটি ভিন্ন সময় পরিমাপ করে, তারা একই ভৌত প্রক্রিয়া দেখছে অর্থাৎ উভয় দর্শকের সময় দেখায় কোন ভুল নেই আসলে, সময়টা তাঁদের দুজনের ক্ষেত্রে দু’-রকম হারে বইছে বলে এই গোলমাল

আইনস্টাইনের কাজের জন্য পদার্থবিদরা উপলব্ধি করলেন, সমস্ত প্রসঙ্গ কাঠামোয় আলোর গতিকে সমান দাবি করায় ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বক তত্ত্ব নির্দেশ দেয়, সময়কে স্থানের তিনটি মাত্রা থেকে আর আলাদা করে দেখা যেতে পারে না (১৮৬০ সালে পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ চুম্বককে একীভূত করেন তিনি আবিষ্কার করেন, আলো নিজেই তড়িৎ - চুম্বক তরঙ্গ) সময় স্থান একটি আরেকটির সাথে পাকানো এটা কিছুটা সাধারণ বাম / ডান, সামনে/ পশ্চাৎ এবং ওপর / নিচের সাথে ভবিষ্যৎ / অতীতের একটি চতুর্থ দিকের সংযোজন পদার্থবিদরা স্থান কালের বিষয়কে বলেন, 'স্থান - কাল' এবং যেহেতু স্থান কালে একটি চতুর্থ মাত্রা যোগ হলো, তাকে বলেন চতুর্থ মাত্রা স্থান - কালে, 'সময়' স্থানের তিনটি মাত্রা থেকে এবং সহজভাবে বলতে গেলে বাম / ডান, সামনে / পেছনে বা ওপর / নিচ আখ্যার মতো দর্শকের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপরে নির্ভর করে একইভাবে সময়ের দিকও দর্শকের গতির ওপর নির্ভরশীল গতিশীল বিভিন্ন দর্শক বিভিন্ন বেগে স্থান-কালে সময়ের জন্য ভিন্ন দিক বেছে নেন কাজেই আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব একটি নতুন মডেল যা চরম সময়ের ধারণা থেকে মুক্ত বিশেষ আপেক্ষিকতার কয়েকটি দিক সহজেই বোঝা যায় কোনো বস্তু যদি গতিশীল হয়, তার দৈর্ঘ্য কমে যায়, বেড়ে যায় তার ভর এবং ধীর হয়ে যায় তার ঘড়ি তবে দৈনন্দিন জীবনে এসব পরিবর্তন আমরা টের পাই না শুধু আলোর গতির কাছাকাছি গতিতেই এটা টের পাওয়া যায় সময় ধীর হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ঘড়ির যান্ত্রিকতার জন্য নয়, এটা সমস্ত ঘড়ির ক্ষেত্রেই এক, এমনকি আমাদের প্রাণিজ ঘড়ির জন্যেও এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে যেমন, কৃত্রিম উপগ্রহের ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে ধীর গতিতে চলে তাই হিসেব ঠিক রাখার জন্য সংশোধন করে নিতে হয় বিশেষ আপেক্ষিকতার বিষয়টি শুধুমাত্র যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য নয় যেমন, এটি ত্রিমাত্রিক স্থানে (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ উচ্চতা) 'সময়' মাত্রাটি যুক্ত করে আমাদের এই মহাবিশ্বকে চতুর্মাত্রিক স্থান-কালে উন্নীত করে

বিশেষ আপেক্ষিকতার পর আইনস্টাইনের আরও বড় আবিষ্কার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব তাতে পৌঁছানোর মূলেও ছোট একটি প্রশ্ন ১৯২২ সালে একবার জাপানে এক বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন ঘটনাটা বলেছিলেন, 'পেটেন্ট অফিসে বসে ছিলাম আমার চেয়ারে হঠাৎ মাথায় এল একটা চিন্তা যদি কেউ শূন্য থেকে নীচে পড়ে তাহলে সে তার ওজন অনুভব করবে না ব্যাপারটি বিস্ময়ের সামান্য এই চিন্তা গেঁথে বসল আমার মনে'

হ্যাঁ, পড়ন্ত কোনো মানুষ কেন তার ওজন অনুভব করবে না- এই প্রশ্ন থেকে আবিষ্কৃত হলো সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইন এটিকে উল্লেখ করেছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক 'চিন্তন' হিসেবে শীঘ্রই আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন মহাকর্ষকে আপেক্ষিকতার সঙ্গে যুক্ত করতে অন্য পরিবর্তন প্রয়োজন নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী যে কোনো সময়ে একটি শক্তি দিয়ে দুটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং তা নির্ভর করে সময়ে তাদের দূরত্বের ওপর কিন্তু আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পরম সময়ের ধারণাটি বিলোপ করেছে কাজেই বলার কোনো উপায় নেই, কখন ওই দুটি বস্তুর মধ্যে দূরত্ব মাপতে হবে কাজেই নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বিশেষ আপেক্ষিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং একে সংশোধন করতে হবে পরবর্তী এগারো বছরে একটি নতুন মহাকর্ষ তত্ত্ব গড়ে তুললেন নাম দিলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা সাধারণ আপেক্ষিকতায় মহাকর্ষের ধারণা কোনোমতেই নিউটনের মতো নয় আগে যেভাবে ধারণা করা হয়েছিল স্থান-কাল সেরকম সমতল নয়, বরং এর ভেতরের ভর শক্তির জন্য বক্র বা বঙ্কিম এবং বিকৃত অর্থাৎ সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, যা বলছে, নিউটনের আইডিয়া ঠিক নয়, গ্রহ-নক্ষত্রেরা কেউ কাউকে টানছে না; আসলে, যে-কোনো ভরের চারপাশে স্থান-কাল দুমড়ে-মুচড়ে যায় গ্রহ-উপগ্রহের আবর্তন বলে যা দেখা যায়, তা ওই দোমড়ানো স্থান-কালের মধ্যে ওদের চলাফেরা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বিশেষ আপেক্ষিকতার পুনর্জন্ম দেয় যখন মহাকর্ষ অনুপস্থিত থাকে বিশেষ আপেক্ষিকতা আমাদের সৌরজগতের ক্ষীণ মহাকর্ষ প্রতিবেশে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মতো প্রায় একই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করে কিন্তু পরিপূর্ণভাবে নয় আসলে সাধারণ আপেক্ষিকতাকে জি, পি, এস স্যাটেলাইট নেভিগেশন পদ্ধতিতে যদি ব্যবহার করা না হতো, তাহলে প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন অবস্থানে দশ কিলোমিটার করে ভুল হতো তবে সাধারণ আপেক্ষিকতা যে কোনো প্রযুক্তিতে ব্যবহারের জন্য নয় বরং এটি মহাবিশ্বের একটি ভিন্নতর মডেল, যা বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন ভবিষ্যদ্বাণী করে, যেমন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এবং কৃষ্ণগহ্বর আর এভাবেই সাধারণ আপেক্ষিকতা পদার্থবিজ্ঞানকে জ্যামিতিতে রূপান্তরিত করেছে সম্প্রতি অনেক সূক্ষ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং তত্ত্বটি সবগুলোতেই উত্তীর্ণ হয়েছে ইদানীং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রমাণ মিলেছে যেমন, ২০১৫ সালে দূরবর্তী অতিকায় বৃহৎ দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আমেরিকার ওয়াশিংটন লুইজিয়ানায় অবস্থিতলাইগোডিটেক্টারে শনাক্ত হয়েছে কাজের জন্য ২০১৭ সালে তিনজন পদার্থবিদ রাইনার ওয়াইজ, কিপ থর্ন ব্যারি বারিস নোবেল পুরস্কার লাভ করেন আর কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ২০২০ সালের অক্টোবর তিনজন পদার্থবিদ রজার পেনরোজ, রাইনহার্ড গেনজেল আন্দ্রেয়া গেজ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই আবিষ্কার দুটি মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন 

আইনস্টাইনের কাজের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় প্রথমে জুরিখ এবং পরে প্রাগ সবশেষে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি গবেষণার কাজও চালিয়ে যান তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল সবকিছুতে বাধ সাধল জার্মানির নাৎসি সরকার ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির শাসনভার গ্রহণের পর ইহুদিদের ওপর নির্যাতন চরমে ওঠে এসবের তিনি জোরালো প্রতিবাদ করলেন আর তাতে তিনি নাৎসি সরকারের রোষানলে পড়লেন কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম তাঁকে দেশদ্রোহী হিসেবেও চিহ্নিত করল তাই তিনি জার্মানি ছেড়ে ইমিগ্রেন্ট হিসেবে আমেরিকায় চলে এলেন এখানে এসে তিনি স্থায়ীভাবে প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিতে অধ্যাপনা গবেষণা কাজে যোগ দিলেন

প্রিন্সটনে আসার পর কর্তৃপক্ষ তাঁর জন্য ইউনিভার্সিটি হলে একটি অফিসের ব্যবস্থা করে এবং জিজ্ঞেস করে তাঁর জন্য আর কী কী দরকার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘একটি টেবিল, চেয়ার, পেপার পেন্সিল; এছাড়া আরও একটি জিনিসের খুব প্রয়োজন, তা হলো একটি বড় সাইজের ওয়েস্টবাস্কেট-যাতে আমি আমার ভুলগুলো বর্জন করতে পারি

ভুলের ব্যাপারে আইনস্টাইন বরাবরই সচেতন ছিলেন তাই ভুল স্বীকার করতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্র সমীকরণে তিনি একটি 'মহাজাগতিক ধ্রুবক' জুড়ে দেন তাতে মহাবিশ্বের একটি স্থিরচিত্র ফুটে ওঠে, যা ঠিক ছিল না কারণ, পরে দেখা যায়, মহাবিশ্ব ক্রমপ্রসারমাণ এটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁর 'সবচেয়ে বড় ভুল' হিসেবে

হিটলারের তা- সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে বিজ্ঞানীরা অ্যাটম বোম তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেন আর এজন্য ওপেন হাইমার, , ফার্মি জিলার্ডসহ কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করেন তাঁদের সাথে ছিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা একটি পত্র আর তাতে ছিল জরুরি ভাবে অ্যাটম বোম তৈরির তাগিদ; যাতে জার্মানির আগেই এই বোম তৈরি সম্ভব হয় আইনস্টাইন তাতে সই করলেন অতি গোপনে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান প্রকল্পে অ্যাটম বোম তৈরির কাজ শুরু হল এখানে তৈরি অ্যাটম বোম ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকিতে ব্যবহৃত হয় এতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে আজও এর দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে সেখানে বহু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে ঘটনায় আইনস্টাইন দীর্ঘদিন মর্ম বেদনায় ভোগেন

১৯৪৮ সালে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় চেইম ওয়াইজম্যান এটির প্রথম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন এই ওয়াইজম্যানই আইনস্টাইনকে ১৯২১ সালে আমেরিকায় নিয়ে আসেন ১৯৫২ সালে ওয়াইজম্যান মৃত্যু বরণ করেন এসময় জেরুজালেমের সংবাদমাধ্যমে আইনস্টাইনকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু হয় এতে আইনস্টাইন চিন্তিত হয়ে পড়েন এরই মধ্যে আমেরিকায় নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত এবা ইবান আইনস্টাইনের সাথে দেখা করে একটি পত্র দেন এতে তাঁকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় আইনস্টাইন এতে সম্মত হননি তিনি বলেছিলেন, 'আমি ব্যাপারে যোগ্য নই আমি সারাজীবন শুধু কয়েকটি মৌলিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি এসব কাজে আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ কিংবা অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই

প্রিন্সটনে কর্মরত অবস্থায় একদিন তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর মহাধমনীতে একটি জরুরি ¯্রােপচারের পরামর্শ দেওয়া হয় তিনি তাতে সম্মত হননি তিনি বলেছিলেন, 'কৃত্রিমভাবে আমি বেঁচে থাকতে চাই না; আমার যেটুকু করার ছিল তা করেছি, আমার যাবার সময় হয়েছে, আমি এখন মরণকে বরণ করে নিতে চাই'

এসময় তাঁর পুত্র হ্যান্স আলবার্টকে খবর দেওয়া হয় সে পিতার শয্যাপাশে এসে দাঁড়ায় আইনস্টাইনের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় তাঁকে প্রিন্সটন হাসপাতালে নেওয়া হয় তবে আর কিছুতেই তাঁকে সুস্থ করে তোলা গেল না

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল প্রিন্সটন হাসপাতালে তিনি মহাপ্রয়াণ করেন প্রয়াণকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াত্তর বছর তাঁর শয্যাপাশে একটি নোট খোঁজে পাওয়া যায় এটি ছিল আইনস্টাইনের পক্ষ থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সপ্তম স্বাধীনতা বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে স্বাগত ভাষণের একটি কপি, যা তাঁর পক্ষে আর পাঠ করা সম্ভব হয়নি এটির শুরুতে আইনস্টাইন লিখেছিলেন, 'ইহুদি কিংবা আমেরিকান হিসেবে নয়, আমি একজন মানুষ হিসেবে আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই'

শয্যাপাশে আরও ছিল তাঁর অন্তিম বাসনার একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বের গণিতে ঠাসা বারো পৃষ্ঠার কিছু মূল্যবান নোটস মহাবিশ্বের জন্য সবকিছুর একটি তত্ত্ব খোঁজে পেতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লড়ে গেছেন



আইনস্টাইনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহভস্ম নির্দিষ্ট কোনো স্থানে সমাহিত না করে চারদিকে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে দেওয়া হয় কারণ, মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিতে দর্শনার্থীদের ভিড় হোক এটা তিনি চাইতেন না তবে প্রিন্সটন হাসপাতালে ময়নাতদন্তের সময় সেখানকার একজন প্যাথলজিস্ট থমাস হার্ভে সকলের অগোচরে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক একটি কাঁচের জারে সংরক্ষণ করে রাখেন উদ্দেশ্য, আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক চুরি হয়ে যাওয়ার যে কাহিনী বিখ্যাত হয়ে আছেসম্ভবত এটা তাই এটা জানাজানি হওয়ার পর হ্যান্স আলবার্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন হার্ভের অনুরোধে তা থেকে তিনি বিরত হন হার্ভের যুক্তি ছিল, আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক গবেষণায় মূল্যবান তথ্য মিলতেও পারে তাই দীর্ঘদিন বিভিন্ন গবেষণাগারে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা চলে এবং ফলশ্রুতিতে কয়েকটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয় তবে প্রথম দিকে গবেষণায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ফলাফল মেলেনি অবশেষে ১৯৯৯ সালে অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কিছুটা সফলতা দেখতে পান এখানে গবেষণায় অন্যান্যদের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ইনফেরিয়ার পেরিয়েটাল লোবে একটি অতি খর্বাকার কাটা দাগ পরিলক্ষিত হয় যা তাঁর গণিতে মেধার উৎস হতে পারে বলে ধারণা করা হয় আর এই অংশে তাঁর মস্তিষ্ক শতকরা পনের ভাগের মতো বেশি প্রসস্থ বলেও লক্ষ্য করা যায় এসব ফলাফল আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের একটি সুসমন্বিত সার্কিটের উৎস হতে পারে বলে গবেষকদল মনে করেন তবে মস্তিষ্ক গবেষণায় মেধার সন্ধান পুরোপুরি মেলার কথা নয় কারণ, আইনস্টাইনের জীবনী-লেখক কার্ল শিলিগ একবার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার প্রতিভা কার দিক থেকে এসেছে - মা, না বাবা?’

জবাবে আইনস্টাইন বলেছিলেন, 'আমার বিশেষ কোনো প্রতিভা নেই- আমি শুধু প্রচ- কৌতূহলী এটা উত্তরাধিকারের ব্যাপার নয়

 

লেখক পরিচিতি:

বজলুল করিম আকন্দ

অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদ



সূত্র: আইনস্টাইন-হিজ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স, ওয়ালটার আইজাকসন; দি গ্র্যান্ড ডিজাইন, স্টিফেন হকিং-লিওনার্দ ম্লডিনো; ক্লাসের ফার্স্টবয় ছিলেন না আলবার্ট, পথিক গুহ, আনন্দমেলা; উইকিপিডিয়া 

 


ক্যাটেগরিঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,


আরো পড়ুন