English
ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২০-০৮-০১ ১১:৪৩:৪০
আপডেটঃ ২০২৪-০৭-২৭ ১৪:১৪:৫৯


ইভ্যালি: প্রতারণার উপত্যকা

 ইভ্যালি: প্রতারণার উপত্যকা

বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন

বাংলাদেশে -কমার্স এক যুগের কিছু বেশি সময় ধরে শুরু হয়েছে ২০০৬ সালে গ্রামীণফোনের সহায়তায় সেলবাজার ডটকম বাংলাদেশের মানুষের সামনে অনলাইনে কেনাবেচার বিষয়টি ব্যাপক ভাবে তুলে ধরে পরবর্তীতে গ্রামীণফোনের নরওয়ে ভিত্তিক মূল কোম্পানি টেলিনর এটি পুরোপুরি কিনে নেয় এবং নাম দেয় এখানেই ডটকম কিন্তু এখানেই ডটকম এক সময় বন্ধ হয়ে যায় এখানেই ছাড়াও বাংলাদেশে ওএলএক্স ডটকম আসে বড় বিনিয়োগ নিয়ে কিন্তু পরে তারা আরেকটি বড় কোম্পানি বিক্রয় ডটকমের কাছে বিক্রি হয়ে যায় সম্প্রতি বাজারে যোগ হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগের আরেকটি কোম্পানি দারাজ ডটকম যার পেছনে আছে চায়নার আলিবাবার বিনিয়োগ

এসবের বাইরে সম্পূর্ণ দেশি বিনিয়োগে দেশের উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন অসংখ্য -কমার্স সাইট ফেসবুক ভিত্তিক অজস্র -কমার্স বিজনেস প্লাটফরম গড়ে তুলেছেন অনেকেই বাংলাদেশে -কমার্সের মধ্যে রকমারি ডটকম যা প্রধানত অনলাইনে বই বিক্রি করে আলোচনায় আসে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বইপ্রেমীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে আছে চালডাল ডটকম, আজকের ডিল, বাগডুম ইত্যাদি -কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ -ক্যাব হচ্ছে দেশের -কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন

অনেক বড় বিনিয়োগ নিয়েও কিছু -কমার্স সাইটের বন্ধ হয়ে যাওয়া বা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে কাঙ্খিত গ্রাহক না পাওয়া বাংলাদেশের বাজার অনেক বড় কিন্তু এদেশের মানুষের বড় অংশ এখনো দোকানে গিয়ে বা বাজারে গিয়ে নিজে দেখে শুনে কিনতে ভালোবাসেন

করোনা ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীতেই -কমার্স ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে  বাংলাদেশের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সীমাবদ্ধতা লোকবলের অভাব সেভাবে  এগিয়ে যেতে পারে নি যতোটা গিয়েছে বিদেশি বিনোয়োগের দারাজ ডটকম তবে দারাজের সার্ভিস নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই

সম্প্রতি বাংলাদেশি একটি -কমার্স প্রতিষ্ঠান ব্যাপক আলোচনায় এসেছে তাদের অতি প্রচারণার কারণে প্রতিষ্ঠানটির নাম ইভ্যালি এক বছরের কিছু বেশি সময় পেরোনো এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের বর্ষপূর্তিতে ১০০ কোটি টাকা টার্নওভারের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশের -কমার্স জগতে এটা ছিল বিস্ময়কর ঘটনাফেসবুক, গুগল, বিলবোর্ডসহ টিভি পত্রিকা অনলাইনে ব্যাপক বিজ্ঞাপনের কারণে হয়তো কেউ তাদের এইঅভাবনীয়সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে নি

অন্যান্য -কমার্স সাইটের সঙ্গে ইভ্যালির প্রধান পার্থক্য হলো বাকি সবাই ক্যাশ অন ডেলিভারি বা প্রডাক্ট গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়ার সময় টাকা গ্রহণ করে থাকে ইভ্যালি টাকাটা নিয়ে নেয় আগে টাকা নেয়ার থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেয়ার ঘোষণা দেয় তারা কিন্ত এই সময় আরো অনেক দীর্ঘ হওয়ার অসংখ্য অভিযোগ আছে

কেন মানুষ আগে টাকা দেয়? কারণ ইভ্যালি শুরু থেকেই নানা অফার দিচ্ছে কখনো ২০ ভাগ থেকে ১৫০ ভাগ পর্যন্তক্যাশ ব্যাকঅফার মূল টাকাও ফেরত পাবে আবার জিনিসও পাবে এই আশায় অনেকেই ইভ্যালির দিকে ঝুঁকছেন এই রকম বিজনেস মডেল বিশ্বে বিরল! কারণ চায়নায় জ্যাক মা যখন আলিবাবা শুরু করেন তখন একটা দীর্ঘ সময় সার্ভিস চার্জ নেন নিকিন্তু প্রডাক্টের দাম গ্রহণ করেছেন


কখনো ২০ ভাগ থেকে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত ‘ক্যাশ ব্যাক’ অফার দিচ্ছে ইভ্যালি 

বিজনেস মডেল হিসেবে ইভ্যালির পদ্ধতি কতোটা বাস্তব সম্মত এমন প্রশ্ন কয়েকজন বিশেষজ্ঞর কাছে করা হলে তারা জানান, এটা কোনো বিজনেস মডেল হতে পারে না যদি তারা যা বলছে বাস্তবে তা মেনে চলে কেননা এই অফারের কারণে অনেকেই ইভ্যালিতে টাকা জমা দিচ্ছে দুই তিন মাস পরে হয়তো কিছু সংখ্যক গ্রাহককে প্রডাক্ট দেয়া হচ্ছে কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আরো অফার ঘোষণা করে প্রচুর টাকা তাদের কাছে চলে যাচ্ছে এক সাথে যদি সব গ্রাহক তাদের প্রডাক্ট চায় তবে ইভ্যালি পুরোপুরি ফেল করবেহয় তারা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করবে অথবা পালাবেমাথায় বাড়ি পড়বে যারা সেখানে টাকা দিয়ে প্রডাক্ট কিনতে চেয়েছেন তাদের ওপর

ইভ্যালির ক্যাশব্যাক অফারেও রয়েছে ফাঁক কারণ এই ক্যাশব্যাকের টাকা ব্যাক হবে না অর্থাৎ পুরো টাকা দেয়ার পর তা আটকে যাচ্ছে তাদের কাছে তারা অফার দিচ্ছে ক্যাশ ব্যাকের টাকা দিয়ে ইভ্যালির অন্য প্রডাক্ট কেনার সেখানে আবার ৪০ ভাগ টাকা নতুন করে জমা দিতে হবে অর্থাৎ যিনি একবার এই চক্রে ঢুকবেন তিনি আর বের হতে পারবেন না কারণ তার জন্য একের পর এক অফারের মুলো ঝুলানো হবেএরই মধ্যে দশ লাখেরও বেশি মানুষ ইভ্যালির সদস্য হয়েছেন জানা যায় আগামীতে এই সংখ্যা দুই কোটিতে নিতে চান এর উদ্যোক্তা

এই ধরনের অফার বা প্রডাক্ট দেখিয়ে টাকা নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম নয় এক সময় ডেসটিনি নামের সংগঠনটি ছয় হাজার টাকার বিনিময়ে দুই বোতল কালোজিরার তেল ধরিয়ে দিয়েছে ডেসটিনির সদস্য হওয়ার আনন্দে অনেকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গাছ কিনেছেন একই গাছ বিক্রি হয়েছে অনেকের কাছে ক্রেতাদের একমাত্র সান্ত্বনা হলো তাদের কাছে গাছ না থাকুক, গাছ কেনার সার্টিফিকেট আছে!

আর্থ ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল মূলধারার মিডিয়ায় অনেক পরিচিতি বুদ্ধিজীবীর নাম ব্যবহার করে তারা পরবর্তীতে আর্থ ফাউন্ডেশনের প্রতারণা ছিল আলোচিত একটি বিষয় তাদের নির্মমতার শিকার হন বাংলাদেশের মানচিত্র প্রকাশনার পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান গ্রাফোসম্যানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোসাররফ হোসেন কয়েক কোটি টাকার প্রকাশনা বিল বাকি রেখে তাকে ধীরে ধীরে অসুস্থ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় এই প্রতারক চক্র

জিজিএন, যুবক, ইউনিপে টু এমন অনেক নাম প্রতারণার ডালি সাজিয়ে হাজির হয়েছে নানা সময়ে অসংখ্য মানুষের চোখের পানি এই সময় পড়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতারণাও এখন ডিজিটালি হচ্ছে

ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো শেষ নেই তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজসহ ইউটিউব অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায় হাজারো অভিযোগ সময় মতো প্রডাক্ট না দেয়া, যে প্রডাক্টের অর্ডার দেয়া হয়েছে তা না দিয়ে অন্য প্রডাক্ট দেয়া, টাকা নেয়ার পর প্রডাক্টের অফার শেষ বলে অন্য প্রডাক্ট নিতে বাধ্য করা, টাকা নিয়ে প্রডাক্ট কম দেয়া বা না দেয়া, প্রডাক্ট দিতে না পেরে টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা, অসংখ্যবার অভিযোগ করেও কোনো সমাধান না পাওয়াসহ প্রচুর অভিযোগ রয়েছে

ইভ্যালির প্রতিটি অফারই চাতুর্যপূর্ণকোনো কোনো অফারের মেয়াদ থাকে মাত্র ত্রিশ মিনিট কিন্তু অনেক ক্রেতাই সে বিষয়ে লক্ষ রাখেন না ফলে টাকা জমা দেয়ার পর তারা জানতে পারেন অফারের সময় শেষ এবং প্রডাক্টটি পেতে হলে আরো টাকা দিতে হবে

ইভ্যালি শুরুতে আলোচনায় আসে কম দামে মোটর সাইকেল দিয়ে অল্প কয়েকজনকে কম দামে মোটর সাইকেল দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালায় তারা তাদের অফারের বাইরের প্রডাক্টগুলো বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে

ইভ্যালি তাদের অফারের সাহায্যে বিপুল পরিমাণ অর্থের সংগ্রহ গড়ে তুলছে যারা অগ্রিম টাকা দিচ্ছেন তারা এক রকম জিম্মি হয়ে পড়ছেন কেননা টাকা দিয়েও প্রডাক্ট পেতে তাদের কয়েক মাস লাগছেঅনেকে প্রডাক্ট না পেয়ে অভিযোগ করে করে ক্লান্ত হয়ে আশা ছেড়ে দিচ্ছেন

-কমার্স খাতের অভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করছেন, দেশের -কমার্স খাত এখনো স্পর্শকাতর অবস্থায় আছে এর মধ্যে বিদেশি জায়ান্টরা চলে আসছে। দারাজের দরজা দিয়ে আলিবাবা ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশের বাজার নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে অ্যামাজন সেক্ষেত্রে দেশি একটি -কমার্সের নামে ইভ্যালি যা করছে তাতে করে দেশি -কমার্স খাত আরো সংকটে পড়বে কেউ কেউ মনে করছেন, ইভ্যালি মার্কেটে তাদের নাম ছড়িয়ে কোনো বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিশাল ফাণ্ড নেয়ার চেষ্টা করছে

এদেশে -কমার্সের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই এমনকি - কমার্সের সংগঠন -ক্যাবের সদস্য তালিকায়ও ইভ্যালির নাম নেই  তারা কোনো দুর্ঘটনা ঘটালে তার দায় নেয়ার কেউ থাকবে না ফলে এখনই ইভ্যালির বিষয়ে সতর্ক হতে হবে

ইভ্যালি অনেকের কাছেই এখন ইভিল ভ্যালি বা শয়তানের উপত্যকায় পরিণত হয়েছে আরো সহজ করে বললে এর নাম হতে পারে, প্রতারণার উপত্যকা

 



ক্যাটেগরিঃ অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,


আরো পড়ুন