মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
পর্ব : ৬
আজ আবার এসেছিল করোনা টেষ্টের জন্য লালার স্যাম্পল নিতে। সঙ্গরোধের দশম দিন আজ। আগের বারের মতই গতকাল বলে দিয়েছিল—সকাল ন’টা থেকে বিকেল তিন’টার মধ্যে কোন এক সময়ে এসে লালা নিয়ে যাবে। এত লম্বা সময় দিলেও আমার তাতে কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। আমি তো ঘরেই থাকি, থাকবোও তাই। সুতরাং ন’টায় আসলেই বা কি, আর তিন’টাতেই বা কি? দরজা খুলে মুখ হাঁ করা দাঁড়াবো। লম্বা ফ্লেক্সিবল কটন বাড ঢুকিয়ে লালার স্যাম্পল নিবে গলা আর নাকের একদম ভেতর থেকে। প্রথমবারে অস্বস্তি রয়ে ছিল অনেকটা সময় পর্যন্ত। হয়ত মানষিকই হবে বেশী। আজ নিয়ে সব মিলিয়ে ষষ্ঠবারের মত স্যাম্পল দিতে গিয়ে কোন অনুভুতিই হোল না। সব যেন ভোঁতা হয়ে গ্যাছে। যে সময়ের কথাই বলে থাকুক, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যত সম্পর্কে আন্দাজ করে আমার ধারণা হয়েছিল, তারা দশ’টার দিকে আসবে। এসেছিলও তাই। পাঁচ মিনিটেরও কম সময়ে স্যাম্পল নিয়ে চলে গেল। আমিও আমার টেবিলে এসে বসলাম।সকাল থেকে মনটা একটু, যাকে বলে, খিঁচড়ে আছে। তেমন কিছু না। অপেক্ষা করছিলাম সকালের নাস্তার জন্য। সকাল থেকে দরজায় নক্ শুনি নি। ন’টার মধ্যে বার দু’য়েক দরজা খুলে দেখলাম, তামাম ফকফকা—দরজায় কিচ্ছু নেই। অসুবিধে হয় নি। রুমের ছোট্ট ফ্রিজটা থেকে পরিবারের পাঠানো গরুর মাংস, আর বন্ধুর দেয়া বেঁচে যাওয়া নানরুটি অন্য এক বন্ধুর পাঠানো মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেলাম।বাসি নানরুটি গরম করে খেতে হলে কিন্তু পানিতে চুবিয়ে তারপর গরম করতে হয়। নতুবা নান খাচ্ছেন না টোষ্ট বিস্কিট, সেটা বুঝতে আবার বার কয়েক খাওয়া বন্ধ করে দেখে নিতে হবে। গোসত-রুটি আমার অতি প্রিয় নাস্তা। সুতরাং নাস্তা না পাওয়াতে আমার বরং উপকারই হয়েছে। পছন্দের নাস্তা করা গেছে। ফ্রিজটাও কিছুটা খালি হয়েছে। আর তো মোটে চার দিন!কিন্তু পছন্দ মতো নাস্তা হলে কি হবে! সময় মত নাস্তা যে দিয়ে গেল না, আমার প্রাপ্য জিনিস আমি পেলাম না—এটা পীড়া দিতেই থাকলো। ডেল কার্ণেগী থেকে শুরু করে অন্য অনেক মোটিভেশনাল স্পীকারের পরামর্শ এবং সতর্কবাণী (অন্যের কোন কাজ যেন তোমার শান্তি বিঘ্নিত না করে) বৃথাই গেল। আসলে, মনের মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তি দু’দিন থেকেই ছিল। কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন সেবার শর্ত হিসেবে অষ্টম দিনে (মানে, দু’দিন আগে) নতুন লিনেন (তোয়ালে, বিছানার চাদর, আর বালিশের কভার) সরবরাহ করার কথা; যদিও নিজেকেই পাল্টে নিতে হবে। তোয়ালে পেয়েছিলাম বটে, তবে বিছানার চাদর আর বালিশের কভার পাই নি। ব্যাপারটা গেষ্ট-সার্ভিস ডেস্কে ফোন করেও আর জানাই নি। মনকে বুঝাতে পেরেছিলাম—হয়ত ভুলে গেছে, দু’এক দিনের মধ্যে দিয়ে যাবে। তাছাড়া, বন্ধ ঘরে আমার বালিশ, চাদরও তো ময়লা হয় নি মোটেও। এছাড়াও, এরই মধ্যে আরো দু’এক দিন নাস্তা এসেছিল ন’টার পরে। আমি একটু ভোরে উঠি বলেই দেরিতে নাস্তা এলে কিছুটা অসুবিধা হয় বৈ কি!শেষ পর্যন্ত আজ দশ’টা নাগাদ গেষ্ট-সার্ভিস ডেস্কে ফোন করে নাস্তার কথা জানালে তারা সোয়া-দশ’টায় নাস্তা নিয়ে এল। কিন্তু একবার নাস্তা করে ফেলেছি বলে তা ফিরিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করে অনিয়মিত সময়ে নাস্তা সরবরাহের কথা জানালাম, সেই সাথে বাকী লিলেন পাল্টানোর কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য নতুন সেট লিলেন চলে আসলো। তবে ফোনেই সেবার ত্রুটির জন্য দু:খ প্রকাশ করে, ভবিষ্যতে কোন ত্রুটি হবে না—এমন আশ্বাস দিল।মগভর্তি চা নিয়ে জানালায় বসে বসে আমি আমাদের সেবার মান নিয়েই ভাবছিলাম। সেবা প্রদানকারী সংস্থায় যারা কাজ করেন, তা লাভজনক বা অলাভজনক যাই ই হোক না কেন, তাঁরা জানেন—সেবার মানে আমাদের অনেক পার্থক্য বিদ্যমান, মানোন্নয়নের আছে অনেক সুযোগ। Cut-throat Competition এবং Razor-thin-margin এর এই যুগে টিকে থাকতে হলে সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে Competitive Advantage নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি নিজেও ব্যাংকিং-সেবা ব্যবসার সাথে জড়িত। ব্যাংকে এখন Selling Price (অর্থাৎ Lending Interest Rate) এর উর্দ্ধসীমা নির্ধারিত হয়ে আছে। সুতরাং আয় পূর্বাবস্থায় রাখতে বা আয়ের পতন ঠেকাতে যে উপায়গুলো হাতে আছে, তা প্রধানত: হ’লো—খরচ কমানো এবং সেবার মান বাড়িয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়ানো। শুধু ব্যাংকিং নয়, সব ধরণের ব্যবসার জন্যই এটা সত্যি এবং দু’টো উপায়ই বেশ কঠিন।খরচের কথা ভাবলে আবার মাথায় আসে দু’ধরণের খরচ—ফিক্সড খরচ আর ভেরিয়েবল খরচ। যেটা ফিক্সড, সেটা তো কমানো সম্ভব নয়, অন্তত: স্বল্পমেয়াদে তো নয়ই। যেটা ভেরিয়েবল, সেটা ব্যবসার পরিমানের সাথে সমানুপাতিক। ব্যবসার পরিমান বাড়লে, ভেরিয়েবল খরচ বাড়বে, আর ব্যবসার পরিমান কমলে, ভেরিয়েবল খরচ কমবে। দর-কষাকষি করে স্বল্প মেয়াদে ভেরিয়েবল খরচ হয়ত কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হয়। তবে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে গেলে ‘সেবার মানোন্নয়ন’-এর কোন বিকল্প নেই। সেবা নেবার জন্য একজন গ্রাহকের অনেক বিকল্প সেবা প্রদানকারী আছে; কিন্তু সেবা প্রদানকারীর কাছে কিন্তু সেই গ্রাহকই একমাত্র এবং দেবতুল্য। সুতরাং তাকে আকৃষ্ট করতে গেলে, আকৃষ্ট করে ধরে রাখতে গেলে, উন্নততর সেরা প্রদানের তো বিকল্প নেই।গ্রাহকের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল, তখন বলি—‘সেবার মানোন্নয়ন’ বা Service Quality Improvement-এর ওপরে অনেক কর্মশালা বা প্রশিক্ষণ ক্লাসে গিয়ে অংশগ্রহণকারীদের আমি একটা কমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি—কে তোমার গ্রাহক? সেবা তো আমি দেব গ্রাহককে। কিন্তু গ্রাহকটা কে? অনেকেই অনেক কঠিন করে উত্তর দেয়। তবে সত্যি বলতে কি, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণকারীরা ‘গ্রাহক’কে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। প্রশ্ন হ’লো—গ্রাহককেই চিনতে না পারলে তাকে সেবা দেব কিভাবে।আমি নিজের জন্য গ্রাহকের একটা সহজ সংজ্ঞা করে নিয়েছি—“আমার কাছে যার সেবা প্রয়োজন, সেই আমার গ্রাহক”। সেই সংজ্ঞা অনুসারে সবাই আমার গ্রাহক। যে আমার কাছে পণ্য কিনতে আসে, সে আমার গ্রাহক; আবার যে আমার কাছে পণ্য বেচতে আসে সেও আমার গ্রাহক। এই জন্যই আমানতকারীও ব্যাংকের গ্রাহক, ঋণগ্রহণকারীও ব্যাংকের গ্রাহক। আমার উর্দ্ধতনকে আমি সেবা প্রদান করি, সুতরাং তিনি আমার গ্রাহক; আবার আমার অধ:স্তনেরও আমার কাছে সেবা (সময়মত এবং উপযুক্ত সিদ্ধান্ত, যথাযত এবং স্বচ্ছ আচরণ ইত্যাদি) প্রয়োজন, সুতরাং সেও আমার গ্রাহক।বাবা-মাতে আমি সেবা (বৃদ্ধ বয়সের সেবা ছাড়াও নিজে ভাল থেকে, নিজের উন্নতি করে তাঁদের চিত্তে প্রশান্তি আনা) প্রদান করি, সুতরাং তাঁরা আমার গ্রাহক। আবার আমার পরিবারেরও আমার কাছে সেবা (আর্থিক এবং মায়া-মমতা) প্রয়োজন, সুতরাং পরিবারও আমার গ্রাহক। এমনকি, আমার নিজে আমাকেও সেবা (ক্ষুধার্ত হলে খাদ্য, ক্লান্ত হলে বিশ্রাম) প্রদান করি, সুতরাং আমি নিজেও আমার গ্রাহক। দিনের চব্বিশ ঘন্টাই, এমন কি যখন আমি ঘুমে অচেতন, তখনও আমার কাছে আমার গ্রাহক আছে। গ্রাহককে চিহ্নিত করতে পারলে, বাকী থাকে তাকে সর্বোত্তম সেবা প্রদান। তার জন্য আমাকে গ্রাহকের ব্যক্ত এবং অব্যক্ত প্রয়োজন বুঝতে হবে, প্রয়োজনীয় সেবার জ্ঞান এবং সরবরাহ রাখতে হবে, নিজেকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, সর্বোত্তম উপায়ে সেবাটা প্রদান করতে হবে, এবং গ্রাহকের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা গ্রাহকের সন্তষ্টির মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসার প্রসার করতে পারবো।প্রাসঙ্গিকভাবেই পাঠ্যপুস্তকে পড়া রাশিয়ান লেখন লিও টলষ্টয়ের The Three Questions গল্পটার কথা মনে পরে গেল। গল্পে বর্ণিত রাজা ভেবেছিলেন, তিনি যদি তিনটি বিষয় সম্বন্ধে জানতেন—(১) যে কোন কাজের সঠিক সময় কোনটি, (২) যে কোন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কে, এবং (৩) যে কোন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি—তাহলে তিনি সূচারুরুপে রাজ্য পরিচালনা করতে পারবেন। সেবার মানোন্নয়নের ওপরে লিও টলষ্টয়ের কোন প্রশিক্ষণ ছিল কি না, তা আমার জানা নেই; কিন্তু প্রকারান্তরে তাঁর সেই বিখ্যাত গল্পের মাধ্যমে তিনি কি সেবার মানোন্নয়নের ওপরেই আলোকপাত করে যান নি?চেয়ারে বসে একনাগাড়ে এসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় নক্ শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। দুপুর হয়ে গেছে। দরজার বাইরে দিয়ে গেছে দুপুরের খাবার। স্নান সারতে হবে। প্রার্থণায় বসতে হবে। তারপর হবে মধ্যাহ্নভোজ। ভোজের পরে দিবানিদ্রা দিতে কিন্তু ইদানীং সময়ের কোন অভাব হয় না। কোয়ারেন্টিন বলে কথা . . . . .
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত