মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
পর্ব : ৫
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং . .
প্রতিদিন সকালে প্রায় একই সময়ে রুটিন মাফিক নার্সের ফোন।
— শুভ সকাল!
— নার্স ন্যান্সি বলছি, মামদুদ। কেমন আছো আজ?
— ভালো, তুমি?
— চমৎকার! জিজ্ঞেস করার জন্য ধন্যবাদ। তা, তোমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? জ্বর কিংবা কাশি?
— না।
— গলাব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্ট?
— না।
— গন্ধহীনতা বা স্বাদহীনতা?
— না।
— পেট খারাপ বা ক্ষুধা মন্দা?
— না।
— বমি বমি ভাব অথবা বুকে ব্যথা?
— না।
— তোমার মানসিক অবস্থা এখন কেমন?
ঠিক এই প্রশ্নে এসেই নার্সের সঙ্গে আমার আলাপের ছন্দ পতন হয়। নার্স জিজ্ঞেস করে এক, আর আমি শুনি অন্য।
নার্স জিজ্ঞেস করে—‘তোমার মানসিক অবস্থা এখন কেমন?’
আমি শুনি—‘তুমি কি এখনও পাগল হও নি?’
মুখে বলি—‘চমৎকার; যদিও একঘেয়েমিতে ভুগছি কিছুটা।’
ভিতরে নিজের উত্তরটাই নিজে অন্যভাবে শুনি—‘পাগল হওয়ার কিছু বাকি রেখেছ না কি, তোমরা!’
নার্স পরামর্শ দেয় শখের কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে—হোক সে বই পড়া, গান শোনা, লেখালেখি, কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা, বা অন্য কিছু। তারপর আরও দু’একটা সৌজমূলক বাক্য বিনিময়ের পর ফোনটা রেখে দেয়। আমিও নিজের কাজে ব্যস্ত(!) হয়ে পরি।
জানালার পাশে মাল্টিপারপাস টেবিলে বসে নাস্তা সারতে সারতে গত সাতদিনের দৈনন্দিন কাজের কথা ভাবছিলাম। মাল্টিপারপাস বলার কারণ, এখানে বসেই আমার খাওয়া দাওয়া, ল্যাপটপে কাজকর্ম, লেখালেখি, ছবি আঁকা সবই চলে। আমার ঘর থেকে করিডোরে বের হবার দরজাটা ঘরের পূবদিকে। জানালাগুলো ঘরের পশ্চিমে। কিন্তু রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আমার ঘরটিতে রোদ ঢোকে দিনে দু’বার। এই শুনেই আপনি ভাবছেন—মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে নার্সের প্রশ্নটা তো একদম অমূলক না! আপনার সন্দেহটাই ঠিক হতো যদি হোটেলের পশ্চিমদিকের সুউচ্চ ভবনটি কাঁচে মোড়ানো না হতো। কাঁচে মোড়ানো বলেই সকালের সোনা রোদ ঘরে ঢোকে ভবনের কাঁচে প্রতিফলিত হয়ে । আর পড়ন্ত বিকেলের ক্ষয়িষ্ণু আলো ঢোকে সরাসরি, দুটি ভবনের মাঝের খোলা গলিটা দিয়ে।
আমি কখনো বসে থাকি টেবিলে ল্যাপটপটা সামনে নিয়ে। কখনও হাঁটি আনমনে ঘরের কিঞ্চিৎ ফাঁকা জায়গাটিতে।কখনও বা মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দূরালাপ হতে থাকে অনর্গল। কখনও আইপ্যাডে বাজনা ছেড়ে অহেতুক লাফিয়ে শরীরটাকে চালু রাখার চেষ্টা চলে সবিরাম। কখনও বা রুটিন মাফিক খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ। গান শুনি কখনও, টেলিভিশনও দেখা চলে। সঙ্গরোধিত সময়টাতে নি:সঙ্গতা সত্বেও একঘেয়েমির বিষন্নতা দূর করতে যা প্রয়োজন, সে সবেরই কসরত চলে হরদম—ঘুম থেকে উঠে, না ঘুমানো পর্যন্ত।
হঠাৎ আজ মনে পরে গেল একটা শিক্ষামূলক গল্প। গল্পটি বলেছিলেন প্রফেসর প্রসাদ কাইপা (Prasad Kaipa, Ph.D)। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক প্রসাদ গ্রুপ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০০৩ সাল থেকে ইন্ডিয়ান স্কুল অফ বিজনেস (ISB)-এর ভিজিটিং প্রফেসর এবং ISBর ‘সেন্টার ফর লিডারশিপ, ইনোভেশন অ্যান্ড চেঞ্জ (CLIC)’ এর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক। ‘From Smart to Wise : Acting and Leading with Wisdom’
বইটির সহ-লেখকও তিনি। “Discontinuous
Learning: Igniting Genius Within by Aligning Self, Work, and Family” শিরোনামে আরো একটি e-book লিখেছেন। তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রিটা পদার্থবিদ্যায় হলেও তিনি তাঁর পেশাগত জীবনের মূল সময়টা কাটিয়েছেন একজন ব্যবসায় পরামর্শদাতা (Business Advisor) এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ কোচ হিসেবে। ‘Transformational
Leadership—Tapping into Your Personal DNA‘ শিরোনামের
একটা প্রশিক্ষণে
ISB-Hyderabad-এ গিয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম এই প্রসাদ কাইপাকে। এই প্রশিক্ষণেই কল্পনাশক্তির ক্ষমতা বর্ণনা করতে গিয়ে গল্পটি বলেছিলেন তিনি।
এতদিন পরে গল্পের নায়কের নাম মনে নেই। তবে গল্পের ঘটনাটি মনে আছে পরিষ্কার। নায়ক ছিল যুদ্ধবন্দী। বন্দীদশায় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল ছোট্ট একটি খাঁচায়, যেখান থেকে বাইরে বেরোবার কোনো উপায় ছিল না। বুঝে গিয়েছিল, এভাবে থাকলে সে অচিরেই হয় মারা যাবে, আর ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও পাগল হয়ে যাবে। বন্দী খাঁচা থেকে বের হবার একটা মোক্ষম উপায় বের করেছিল সে; বাস্তবে নয়, কল্পনায়। যুদ্ধে যাবার আগে গলফ খেলতো সে। তবে সুপটু বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। ছিল সাধারণ মাপের একজন খেলোয়াড়। এই গলফকেই বেছে নিয়েছিল সে কল্পনার পাখা মেলতে। তার পরিচিত গলফ কোর্সটিতে প্রতিদিন সে আঠারো হোল গলফ খেলতো। পুরো খেলাটা প্রথমে পরিকল্পনা করতো। কোন পোশাকে সে খেলবে সেটাও দেখতো কল্পনায়। প্র্যাকটিস সুইং করতো টি-অফ করার আগে। শরীরে বাতাসের স্পর্শ নিত। সদ্য কাটা ঘাসের গন্ধ নিত শুঁকে।টি-অফ করার পর পুরো গতিপথ ধরে বলটা দেখতো মাটিতে পরার আগে পর্যন্ত। মাটিতে পরার পর বলের গড়িয়ে যাওয়াটাও দেখতো। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেত বলের কাছে। প্রতিটি কদম অনুভব করতো। তারপর ঠিক যে ক্লাবটি প্রয়োজন, সেটা ব্যাগ থেকে বের করে পুনরায় বলে শট নিত। শেষ পর্যন্ত পাটিং গ্রিনে পৌঁছে পাটিং করে বল ফেলতো কাপে। কাপ থেকে বল তুলে নিয়ে যেত পরের হোল-এ খেলতে। সবই হতো কল্পনায়। খেলার প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি শট সে পরিকল্পনা করতো, বাস্তবায়ন করতো, কল্পনায় । এভাবেই চলতো প্রতিদিন, আঠারো হোল শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
সৌভাগ্যক্রমে, বেশ কয়েক বছর পর মুক্তি পায় সে—তার ছোট্ট খাঁচাটি থেকে, বন্দীদশা থেকে। অপ্রতুল খাবার, শারিরীক নির্যাতন, রোগ-শোক এবং কোনো রকম নড়াচড়ার অভাবে তার শরীর এবং পেশীগুলো ছিল অত্যন্ত দুর্বল। তবুও দেশে ফিরে আউটডোরে প্রথম যে কাজটি সে করে তা হলো—গলফ; তবে এবার আর কল্পনায় নয়, পুরোপুরি বাস্তবে। বিগত কয়েক বছর এই কোর্সেই যে খেলা সে প্রতিদিন খেলেছে কল্পনায়, আজ তা খেলবে বাস্তবে, অনেক বছর পর। আশংকা হচ্ছিল—পারবে তো? বিস্ময়কর ফলাফল পেয়েছিল। বাস্তব অনুশীলনের অভাব আর শারিরীক দুর্বলতার কারণে যেখানে তার আগের চেয়ে খারাপ খেলার কথা, অবাক হয়ে সে দেখেছিল যে তার খেলা যুদ্ধের পূর্বের খেলার চেয়ে উন্নত হয়েছে।
গল্পটার মূল বক্তব্য আমাকে এতটাই আকর্ষণ করেছিল যে, এর সত্যতা যাচাই করার কথা কখনো মনে আসেনি। আমার বর্তমান অবস্থাটার সাথে গল্পের নায়কের অবস্থার যে কোনো তুলনাই নিতান্ত হাস্যকর। তবে, আমার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা যে ব্যাহত হয়েছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ করার মতো কেউ আছে বলে তো মনে হয় না। ভোরে উঠে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার সাইক্লিং বা আট-দশ কিলোমিটার হাঁটা নেই, বাড়ি ফিরে ছাদের ছোট্ট বাগানটিতে পানি দেয়া নেই, গাছগুলোর পরিচর্যা করা নেই, অফিসে যাওয়া নেই, বাইরে ঘোরা নেই, এমনকি কারো সাথে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। এমন বদ্ধ অবস্থায় কিছু না কিছু মানসিক চাপ তো পরে নিশ্চয়ই কারো না কারো ওপর। নইলে, প্রতিদিন নার্সের শেষ প্রশ্নটা কেন হবে—তোমার মানসিক অবস্থা এখন কেমন? প্রশিক্ষণের সময় যতটা না বুঝেছিলাম, তার চেয়ে এখন এ-কয়দিনে আমি অনেক ভালোভাবে বুঝি—কল্পনার অশ্ব বল্গাহীন ভাবে যে যতটা জোড়ে ছোটাতে পারবে, কোয়ারেন্টিনের সময়টুকু তার কাটবে ততোটাই ভালো। আমি সে চেষ্টাই করছি . ..
সিডনি,
অস্ট্রেলিয়া থেকে
১৭ নভেম্বর ২০২০
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত