English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-১১-১৬ ১৪:১১:২০
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২৫ ২০:৪০:২৪


আক্ষেপ

আক্ষেপ


রুবাইয়াত হাসান সিরাজ

সমাবেশ জমে উঠেছে। নানান বয়সের ছেলে-মেয়েরা জেঁকে বসেছে তাদের প্রিয় মানুষটিকে পেয়ে। সফলদের পেয়ে মানুষের আনন্দের ভাষাও বদলে যায়। তাদের কাছ থেকেই সাহস, অনুপ্রেরণার জয়গান শুনতে পেয়ে নিজেদেরকেও মনে হয়, তাহলে আমিও একদিন নিশ্চয়ই পারবো! এই মানুষগুলোর অর্জন যেমন আমাদের স্বপ্ন দেখায় তেমনি তাদের জীবনের অসামান্য ত্যাগ, সংগ্রাম বুঝতে শেখায়, মানুষ অনেক সাধারণ থেকেও অসাধারণ হয়ে উঠেন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।

সমাবেশে প্রশ্ন করার সুযোগ সীমিত। তবুও অম্লান বদনে জনপ্রিয় সফল বিজ্ঞানী সবার উত্তর দিতে কার্পণ্য করছেন না একবারো। আয়োজকরাও খুশি। হঠাৎ একজন প্রশ্ন করে উঠলেন, ‘সবাই আপনার সাফল্য নিয়েই কথা বলেন। এই বর্ণাঢ্য জীবনে আপনার কোনো আক্ষেপ নেই?  যা করতে পারলে আপনি হয়তো আক্ষেপ করতেন না আর?’

সবাই নড়েচড়ে বসলেন। বিজ্ঞানীর সাথে থাকা দলও খানিকটা অপ্রস্তুত। এমন প্রশ্ন কোনো সেমিনারে শুনতে হয়নি তাদের। স্যার কী উত্তর দেবেন তা শুনতে তারাও উদগ্রীব।

সফল বিজ্ঞানী মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘এমন প্রশ্ন কেউ করে না সাধারণত। তবুও বলি তাহলে হয়তো এতে সত্যটা প্রকাশিত হবে। আমার বড় ভাই-এর বয়স ৯৮ বছর। দেখ, এই বয়সে তিনি খুব ভালো দেখতে পারেন না। আর মাঝে মাঝেই বাতি থাকে না লোডশেডিং-এর কারণে। তাই আমি বাড়িতে সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করেছি। সাথে শক্তিশালী ব্যাটারি। এতে লাভ হয়েছে বেশ। আলোময় থাকে ঘর, রাতের অন্ধকারেও। তিনিও দেখতে পারেন, চলতে পারেন। কিন্তু জানো, আজকে থেকে তিন দশক আগে আমাদের বাড়িতে বারংবার আলো চলে যেত। আমার বাবা-মা তখন তাদের শেষ বয়সে। দুজনের বয়সই ১০০ এর কাছাকাছি। দুজনেরই দেখতে বেগ পেতে হত বেশ। আমি আমার মা-বাবার জন্য কিছু করতে পারি নি তখন। তাদের কষ্ট লাঘব করতে পারি নি আমি। এখনো এই আক্ষেপ বহন করি আমি।

৮০ বছর পেরিয়ে ভারতের প্রখ্যাত ‘মিসাইল ম্যান- ‘জনগণের রাষ্ট্রপতিআবুল পাকির জয়নুল আবেদীন আব্দুল কালাম এই কথাগুলো বলেছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এক সেমিনারে।  কজন আমরা ভাবি এভাবে? কজন সফল হবার পরও এভাবে অবলীলায় স্বীকার করতে পারেন নিজের অক্ষমতা? আব্দুল কালাম জীবন যুদ্ধের ডামাডোলে ভুলেননি তাদের যারা তাকে তিলে তিলে বড় করেছেন। মানুষ কখনোই কৃতজ্ঞ নয় তার প্রভুর প্রতি যতক্ষণ না সে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারছে।

অসাধারণ মূল্যবোধ আর সমমর্মীতা লালন করেছেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি আজীবন। কী করে পারেন তারা?

শুরুটা আসলে পরিবার থেকে। শুদ্ধাচার-মমতা-অন্যের মত, ধর্ম যাই হোক না কেন তাকে সম্মান করতে হয় মানুষ হিসেবে এই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে, তার পরিবারের কাছ থেকে। পাঁচ ভাইবোনের

মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলেও সবার সাথে আজীবন তার বন্ধন ছিল গাঢ়।

একজন মানুষ তার জীবনে সকল অর্জনের চূড়ায় থাকার পরও কীভাবে বিনয়ী হতে হয় হাতে-কলমে দেখিয়ে

গেছেন তিনি আমাদের। জীবনের সিংহভাগ সময়ই ছিলেন নিরামিষাশী। প্রশ্ন করা হয়েছিল, মুসলমান ঘরে জন্ম

নিয়েও যে পরিমন্ডলে তিনি বড় হয়েছেন সেখানে কি কোনো বাঁধা ছিল অন্য খাবার গ্রহণে?  উত্তর শুনলে বিস্মিত হতে হয়। বলেছিলেন, ‘আমি নিরামিষাশী হয়েছি আর্থিক কারণে। যখন ভারতের এম.আই.টিতে ভর্তি হই অ্যারোনটিক্সে; আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব নাজুক সে সময়। কোর্স ফি যা ছিল তা বহন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে আমার পরিবারকে। মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে অর্থ যোগাতে হয়েছে তাদের। আমি যে হোস্টেলে থাকতাম সেখানে তিন ধরনের সুযোগ ছিল। প্রথম শ্রেণীর সুবিধা ছিল মূলত ধনী ছাত্রদের জন্যে। তারা সব ধরনের খাবার গ্রহণের সুযোগ পেতেন। দ্বিতীয় শ্রেণী নিরামিষ আর মাংস দুধরনের খাবারই গ্রহণ করতেন। আর আমি ছিলাম শেষ শ্রেণীর। সবচেয়ে সস্তা আর শুধুই নিরামিষ। আমি আমার পরিবারকেও জানাই নি কারণ আমি ভেবেছিলাম তাদেরকে বললে কষ্ট পাবেন। মনে হতো, যখন আমি উপার্জন করবো তখন না হয় মাংস খেয়ে দেখবো! কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অবাক ব্যাপার, আমার নিরামিষ ভালো লাগতে লাগলো। আজ তাই কোনো অভিযোগ নেই।

খুব সুন্দর একটি কথা আছে - আমি হাসিমুখে ক্ষুধার কষ্ট সইতে পারি। কে পারেন? যিনি অপেক্ষা করতে

পারেন। আলোকিত মানুষেরা আমাদের দেখিয়ে দেন তাদের জীবন দিয়ে। আমাদের জানান দেন সত্যিকারের

সাফল্য আসলে কাদের জন্যে। আসুন না ভেবে দেখি, আমরা কি তাদের আলোর ছটায় নিজেকে একটু বদলাতে

পারি কি না। পারি কি না আরেকটু ভালো মানুষ হতে। প্রত্যেকটি অনন্য জীবন এক একটি প্রদীপ যেন। মিথ্যে-হঠকারিতার তীব্র ভীড়ে তাদের আলোয় আলোকিত হয়ে উদ্ভাসিত হোক আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম।

 

 

 

 

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


রুবাইয়াত হাসান সিরাজ

প্রধান নির্বাহী- গ্রাফাইট, শিক্ষা ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উদ্যোক্তা



আরো পড়ুন