মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
নক্ নক্ নক্!
কিছু খস্ খস্ আওয়াজ শুনলাম বন্ধ দরজার ওপারে। তারপর দরজায় তিন টোকা। ঘড়িতে আটটা বেজে দশ মিনিট দেখে বুঝলাম, সকালের নাস্তা দিয়ে গেল। সাথে সাথে দরজা খোলা যাবে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। কেননা, আমি এখন কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গরোধিত অবস্থায় আছি।
গতরাতে সিডনি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলাম রাত দশটায়। আমার কোয়ারেন্টিন-এর ব্যবস্থা হয়েছে সিডনি হাইড পার্কের পাশেই—শেরাটন গ্র্যান্ড হোটেলে। ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে এসেছি। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে এসে চেক-ইন ফর্মালিটিজ শেষ করে রুমে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বারোটা। মাঝে সাড়ে বার ঘন্টা ট্রানজিট সময়সহ ঢাকার বাসা থেকে বের হবার মোট চৌত্রিশ ঘন্টা পর কোনো ঘরে ঢুকলাম; হোটেল রুম। রুম বলে কথা, তা সে হোটেল রুমই হোক আর বাসার রুমই হোক।
আমি কখনও দুবাই হয়ে সিডনি আসি নি। কারণটা সহজেই বোধগম্য। সিডনি ঢাকার দক্ষিণ-পূর্বে। দুবাই ঢাকার পশ্চিমে। কোনো কারণই নাই অতিরিক্ত সময় উড়োজাহাজে বসে থাকার। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বিরক্তিকর সময় কে কিনতে চায়! আমি সাধারণত আসি কুয়ালা লামপুর, সিঙ্গাপুর, হং কং, চায়নার গুয়ানঝু, ব্যাংকক—এর যে কোনো একটা রুট ধরে। সব মিলিয়ে বাসা থেকে বের হবার ষোল-সতের ঘন্টার মধ্যে সিডনি চলে আসা যেত। এবার লাগলো দ্বিগুণ সময়—চৌত্রিশ ঘন্টা।
করোনা প্যান্ডেমিক চলার কারণে পূবের দিকে একমাত্র মালয়শিয়ান এয়ারলাইন্স সপ্তাহে একদিন ঢাকা-সিডনি রুটে ফ্লাইট অপারেট করে। আমার টিকেট করা ছিল ত্রিশে অক্টোবর রাতে। হঠাৎ জরুরি প্রয়োজনে সেটা বাতিল করাতে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগে আর কোনো বুকিং পেলাম না। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় এমিরাটস-এ একটা বুকিং পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, সময় বেশি লাগে লাগুক; পরিবারের সাথে মিলিত হওয়া বলে কথা।
সিডনি এয়ারপোর্টে পৌঁছে এবারে একটু ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা হলো। সিডনি নামার পরে আমার স্বাধীনতা গেল শেষ হয়ে। মোটামুটি পুলিশি প্রহরায় ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ শেষ করে, পুলিশের অ্যারেঞ্জ করা বাসে উঠে হোটেলে এসে নামলাম। সেখানেও ব্যতীক্রমী অভিজ্ঞতা। হোটেলের সামনে না নেমে আমাদের নামানো হলো হোটেলের পিছনের দিকটায়। পুলিশের মাধ্যমেই হোটেলের চেক-ইন ফর্মালিটিজ সারা হলো; সেটাও হোটেল-লবিতে নয়, বেইজমেন্ট-এর একটা রুমে। নিউ সাউথ ওয়েলস সরকারের সাথে হোটেল কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়েছে। তারা সরকারের তদারকিতে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদেরকে এখানেই কোয়ারেন্টিন করাচ্ছে। পুলিশ তদারকিতেই লাগেজ সহ রুমে এসে যখন ঢুকলাম, তখন মধ্য রাত।
রুমে ঢুকলাম বটে। তবে রুমের কোনো চাবি পেলাম না। কেননা, কোয়ারেন্টিনের পুরো সময়টা এই একই রুমেই কাটাতে হবে। বের হবার কোনো অনুমতি নেই। কোয়ারেন্টিনের খরচ আবার আমাকেই বহন করতে হবে, কেননা সরকার অনুমোদিত সময়ের মধ্যে আমি এসে পৌঁছতে পারি নি। টাকা দিয়ে বন্দীদশা কেনা আর কি! প্যান্ডেমিক বলে কথা। চেক ইন করার সময় কিছু নির্দেশনাসহ একটা খাম হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেটাতেই দেখেছিলাম, তিন বেলা খাবার দেবার সময় দরজায় তিনটে টোকা দেবে। দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করে, মানে এক থেকে দশ গুণে, তবে দরজা খুলে খাবার ভেতরে নিতে হবে। ততক্ষণে সেবাদানকারী নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারবে।
সকালের নাস্তা বলতে একটা প্লাষ্টিকের বাক্সে ডিমের ওমলেট, রোস্ট করা তিনটে অর্ধেক আলু, সিদ্ধ দু’টুকরো ব্রোকলি, আর সিদ্ধ চার টুকরো মিষ্টি কুমড়ো। সাথে কাগজের প্যাকেটে একটা ডোনাট, একটা গাঢ় সবুজ রঙের আপেল, আর দুইশ’ পঞ্চাশ মিলিলিটারের এক বোতল মিশ্র ফলের রস—কমলা, আপেল আর আমের রসের মিশ্রণ। সাথে লবণ আর ব্ল্যাক পেপারের গুড়ো দিতে ভোলে নি।
রুমে একটা কফি তৈরির যন্ত্র আর একটা বৈদ্যুতিক কেতলি আছে—পানি গরম করে নিজের চা নিজেই তৈরি করে নেবার জন্য। ফুটানো পানিতে চায়ের মগটা ভালো মতো ধুয়ে নিলাম। কোথায় যেন শুনেছিলাম, হোটেলের রুমে দেয়া তৈজসপত্র ভালো মতো ধোয়া থাকে না, তা সে যতো ভালো হোটেলই হোক। সত্যি কি মিথ্যে, তা কখনও যাচাই করি নি। তবে শোনার পর থেকে সব সময়ই নিজে গ্লাস বা চায়ের কাপ ফুটানো পানিতে ধুয়ে নিই। আজও তাই করে, ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ চা বানিয়ে সকালের নাস্তা করতে বসলাম। তাড়াহুড়ো নেই। হাতে তো অফুরন্ত সময়।
জানালা খুলে বাইরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলাম। দুটো অফিসের কিছু অংশ চোখে পড়লো। পূবে তাকিয়ে সিডনি টাওয়ার নজরে এলো। চাকরিতে বদলির সময় সরেজমিনে সিডনি দেখতে অফিস থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে প্রথম এখানে এসেছিলাম ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে। ঘটনাক্রমে এসে এই হোটেলেই উঠেছিলাম। যতদূর মনে আছে, হাইড পার্কের সবুজ ভিউ পেয়েছিলাম। এবার পেলাম কংক্রিটের ধূসর ভিউ।
নাস্তা করতে করতে ভাবলাম—এই ভিউ দেখেই কাটাতে হবে চৌদ্দ রাত আর পনের দিন, যা থেকে পার হয়েছে একটি মাত্র রাত। কী আর করা! কেমন ভিউ পাওয়া যাবে, সেটা তো নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন না। এমনও তো হতে পারে, কোয়ারেন্টিন শেষ হতে হতে হয়তো কংক্রিটকেই ভালোবেসে ফেলবো !
০৯ নভেম্বর ২০২০
লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
অতিরিক্ত
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড।
ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত