সামিনা হক শাম্মী
পর্ব: ২
চেনা চয়নিকা
আর দশটা পরিবারের মতো সে সময় আমাদের পরিবারেও নিয়ম ছিল; বিকেলবেলা পাড়ার মাঠে, খেলা শেষে বাড়ি ফিরে হাত-পা ধুয়ে, সোজা পড়তে বসা। খেলার বিকেলটা ছিল একঝাঁক বন্ধু ঘেরা দারুণ রঙিন, চোখের পলকে ফুরৎ করে ফুরিয়ে যাওয়া সময় ওটা। আর এরই সাথে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হতো 'পড়তে বসা ক্লান্ত সন্ধ্যা'গুলোকে.. একব্যাগ বোর্ডের বই ঘিরে পড়ালেখার যে আয়োজন তাতে যতই আকর্ষণীয় শিশুতোষ রংবাহারী প্রচ্ছদ আর ঝকঝকে উপস্থাপনা থাকুক না কেন, সিলেবাসের সীমারেখা আর পাঠ্য নির্দেশনার বেড়াজালে কোথায় যেন একটা পরাধীনতার আঁচ পেতাম। হয়তো সেজন্যই, অন্য সমবয়সী শোকাহতদের মতো, স্কুলের পড়ার বই-এর সাথে আমারও একটা মান-অভিমানের সম্পর্ক বিরাজ করতো হরহামেশাই। কিন্তু, স্কুলের যে কোনো বইগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘চয়নিকা’র ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। ওই চয়নিকাতে গুরু গম্ভীর জ্ঞানের চেয়ে, মনের খোরাকেরই দেখা মিলতো বেশি। তাই ‘বোর্ডের বই’ তকমা সত্বেও চয়নিকা বইটা আমাদের (এখানে 'আমাদের' বলতে ১০ এর নিচের যাদের রোল ; সেইসব বেরসিক হতচ্ছাড়াদের বোঝানো হচ্ছে) ভীষণ প্রিয়। আমার 'কবিতা প্রেম' উপলব্ধির প্রথম মেঘমল্লার বেজে উঠেছিল ওর পাতাতেই।
তৎকালীন সিলেবাসে ‘আমার বই’ - নামেও একটি বই, বোর্ডের মূল 'বাংলা বই' রূপে গণ্য হতো। বইটির প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে, নামী লেখক, দামি কাগজ, গুণী শিল্পী, রঙিন ছবি, দফায় দফায় প্রশ্নমালা, শূন্যস্থান পূরণের অনুশীলন, শব্দার্থ ভান্ডারের ছড়াছড়ি, তারও ওপর প্রচ্ছদসহ এখানে সেখানে কখনও শিল্পী হাশেম খান, কখনও বা কাইয়ূম চৌধুরীদের দক্ষ আঁকের উঁকিঝুঁকি জানান দিতো 'মূল বাংলা বই ' পদবীটির স্পষ্ট দাপট। বইভর্তি অমন সব এলাহী কারবারের সামনে 'চয়নিকা' ছিলো রীতিমতো দুয়োরানী পর্যায়ের একটি আটপৌরে পুস্তিকাসম। নামেই বোর্ডের বই। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও, তাকে তেমন কেউ পুছে না। এক কোনায় ২ বা ৩ নম্বরের
দুই একটি দায়সারা প্রশ্নেই ক্ষ্যামা দিতেন শিক্ষকগণ। অন্য বইগুলো নিয়ে যারপর নাই কোমড়কষে লড়লেও, চয়নিকার বেলায় কেবল চোখ বুলিয়েই পরীক্ষা প্রস্তুতির পাট চুকাতো ক্লাশের ফার্স্টবয়রা; ওতেই ওদের খুব চলে যেতো.. ক্লাশের গুণীমহলে এমনই বে-কদর বেচারা 'চয়নিকা'র।
কিন্তু এই যে আমরা, যারা ক্লাশের আমজনতা ; যাদেরকে 'অমুকের চেয়ে আধা নম্বর কম পেলাম কেন...’ - জাতীয় 'বেকুবী আতঙ্ক' কস্মিনকালেও স্পর্শ করেনি, বরং উত্তীর্ণ শব্দের আশেপাশে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ শব্দটি না থাকলেই ভীষণ বর্তে যাই ; তাদের জন্য পড়ার টেবিলে 'চয়নিকা' ছিলো গল্পের দেবী নেমোসিনির আবির্ভাবতুল্য।
চয়নিকার জন্য নির্বাচিত ছড়া-কবিতার তালিকায় নামই দামি ডাকসাইটে সব লেখক ও ছড়াকারদের আনাগোনা থাকলেও, কে জানে কেন, এর সূচিপত্রে এমন সব দিকপালদের কেবল হালকা মেজাজের আলতো লেখাগুলোই ঠাঁই পেয়েছিল। বলাই বাহুল্য, আমাদের জন্যে ওগুলো ছিল রীতিমতো 'অমৃতসুধা'। তায় সুকুমার রায়, শামসুর রাহমান প্রমুখ.. পাতায় - পাতায় বিরাজমান হলেও, চয়নিকার জন্য নির্বাচিত তাদের লেখা ছড়া-কবিতাগুলো, কোথায় যেনো আমাদের মগজ সমঝে চলা ভাবনাগাছির মতো। সে দিক থেকে সম্পাদকের প্রতি অতটুকুন বয়সেও বেশ কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।
আর চয়নিকা দেহরূপ? ভেতরের অলঙ্করণের যত্ন নেয়া দূরে থাকুক, চয়নিকার প্রচ্ছদ আঁকার ফুরসতও মেলে নি কর্তৃপক্ষের। তাই, মোটা অক্ষরে নিজ 'চয়নিকা' নামটিই তার অলঙ্করণ; পাশে দয়াপরবশত একটা ফুলের মতো আল্পনা কোনমতে 'প্রচ্ছদ" শব্দের মান বাঁচিয়েছে ।
বলতে কী, বোর্ডের বই হওয়া সত্বেও আমার কাছেও চয়নিকা বইটিকে বোর্ডের বা পড়ার বই বলে কখনওই মনে হতো না। ‘পড়ার বই’ নামক ‘শত্রু পক্ষ’ থেকে ওকে সবসময়ই আলাদাই ভাবতাম। তার চেয়েও ভয়ানক তথ্য হলো, অন্য যে সব বইয়ের যা কিছু কবিতা গল্প তারচিৎকারে পড়ে পড়ে, এতো এতো নাম্বার কুড়িয়েছিলাম , সেসব আজ স্মৃতিকোটর থেকে স্রেফ উধাও। কিন্তু স্কুল সিলেবাসের এলেবেলে ভাবে পড়ানো চয়নিকা বইটির প্রতি অদম্য আগ্রহ আর ভালোবাসারা, আজ প্রায় প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তে এসেও, মগজ জুড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে তরতাজা স্মৃতি হয়ে আর সেই সব কবিতা আর গল্পগুলোকে জুগিয়ে রেখেছে সমান উচ্ছ্বাসে। এর প্রায় সব ছড়াগুলোই এখোনো যেন মুখস্ত বলতে পারছি গড়গড়িয়ে। সেই সে কবি শামসুর রাহমানের,
কাঠফাটা সেই দুপুরে
কাকটা গেল পুকুরে।
পানি খাওয়ার আমেজে
পুকুরপাড়ে নামে যে।
সরিয়ে ঝরা পাতাটা,
দেখে কাকের মাথাটা।
অথবা
মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে
লাগলে খিদে মুরগী এঁকে দেয়ালে
আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে।
ভুলি কি করে,
সুকুমার রায়ের সেই
চলে হনহন
ছোটে পনপন
ঘোরে বনবন
কাজে ঠনঠন
বায়ু শনশন
শীতে কনকন
কাশি খনখন
ফোঁড়া টনটন
মাছি ভনভন
থালা ঝন ঝন।
সময় যতো গড়াচ্ছে, যতো বড় (!) হচ্ছি আর বুড়ো হচ্ছি, ততই ‘মনে রাখা’ আর ‘ভুলে যাবার’ পিছনের কার্য-কারণ সম্পর্কিত প্রচুর থিওরির সাথে পরিচিত হচ্ছি। মনুষ্য স্মৃতিরহস্য নিয়ে অমন সব গবেষণাগুলো কমবেশি একটি বিষয়ে একমত যে- 'কোনকিছু সম্পূর্ণভাবে মনে রাখতে চাইলে তার নিয়মিত চর্চা থাকতেই হবে ’। অথচ, নিউজপ্রিন্টের খসখসে লেখা আর বেরঙিন আঁকের সেই 'চয়নিকা ভালোবাসা' স্মৃতিশক্তির চেনাজানা সব থিওরিগুলোকে এক থাবাতে উড়িয়ে দিয়ে, কী প্রবল প্রতাপেই না বিরাজ করছে মনের কোটর জুড়ে!
সহকারী অধ্যপক, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত