English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৮-০৩ ০১:১৮:০৫
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২২ ১০:১৮:৫৮


অদম্য শুটার ক্যারলি

অদম্য শুটার ক্যারলি

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৯১০ সালে জন্ম নেয়া ক্যারলি টাকাক্স (Károly Takács) সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৩৬ সালে হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীতে তিনি পরিচিতি পান সবচেয়ে সেরা পিস্তল শুটার হিসেবে জাতীয় পর্যায়েও তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী খুবই অল্প বয়সে তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন আন্তর্জাতিক মানের একজন শুটার হিসেবে শুরু থেকেই তার মনছবি ছিল তিনি অলিম্পিকে অংশ নেবেন এবং গোল্ড মেডেল জয় করবেন সেনাবাহিনী থেকে যারা ভালো খেলতেন তারা জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেলেও একটি নিয়ম তখন প্রচালিত ছিল শুধু কমিশনড অফিসাররাই অলিম্পিক বা আন্তর্জাতিক খেলায় জাতীয় দলের হয়ে অংশ নিতে পারবেন কম বয়সী নন-কমিশনড সার্জেন্ট ক্যারলি তার অসাধারণ দক্ষতা সত্ত্বেও এই নিয়মের কারণে ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে জাতীয় দলে স্থান পান নি কিছুদিন পর সেনাবাহিনী এই নিয়ম তুলে নিলে ক্যারলি অলিম্পিকে অংশ নেয়ার মনছবিকে লালন করতে থাকেন তার লক্ষ্য থাকে ১৯৪০ সালের অনুষ্ঠিতব্য টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেয়া নিজেকে সেভাবেই তৈরি করা শুরু করেন

মানুষ যেভাবে ভাবে তাতে অনেক সময়ই ছন্দপতন হয়ে থাকে ১৯৩৮ সালে সেনাবাহিনীর এক মহড়া চলাকালে ক্যারলির ডান হাতে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয় যাতে তার ডান হাত পুরোটাই উড়ে যায় এই দুর্ঘটনা ক্যারলির জীবনকে পুরো বদলে দেয়

তীব্র শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি অলিম্পিকে অংশ নেয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে- এটা ভেবে ক্যারলি গভীর হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন তার কাছে জীবনের অর্থ শূন্য হয়ে যায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেন পাশাপাশি তার যারা পরিচিত ছিলেন তারাও ব্যস্ততা এবং প্রয়োজনের কারণে দূরে সরে যান ক্যারলি পরিণত হন যোগাযোগবিহীন এক নিঃসঙ্গ মানুষে


এক বছর পরের কথা

জাতীয় পর্যায়ের শুটিং প্রতিযোগিতা শুরু হবে দেশের সেরা শুটাররা একত্রিত হয়েছেন উৎসবমুখর পরিবেশ চারদিকে এমন এক মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হলেন ক্যারলি তাকে দেখে কেউ বিস্মিত, কেউ অবাক কেউবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েকজন তার কাছে গেলেন তাকে বললেন, অনেকদিন পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে তোমার স্পোর্টিং স্পিরিটের প্রশংসা না করলেই নয় এই অবস্থাতেও তুমি আমাদের উৎসাহ দিতে এসেছ আমরা খুব খুশি হয়েছি

ক্যারলি খুব কম কথায় উত্তর দিলেন, ধন্যবাদ তোমাদের তবে এখানে আমি তোমাদের উৎসাহ দিতে আসি নি আমি এসেছি তোমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে

অবাক চোখে সবাই দেখল, ক্যারলি তার একমাত্র হাতটিতে পিস্তলের ব্যাগটি ধরে রেখেছেন

প্রতিযোগিতা শুরু হলো সবাই যে যার সেরা পারফরমেন্স করলেন ক্যারলি বাঁ হাতে অংশ নিলেন প্রতিযোগিতায় সবাইকে বিস্মিত করে প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন ক্যারলি!


পেছনের কথা

হাত হারিয়ে প্রথমে হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন ক্যারলি তার পরিচিত জগৎ হঠাৎ করেই বদলে যায় তিনি অসীম শূন্যতায় ডুবে যান এক পর্যায়ে তার মনে দুটো প্রশ্ন কাজ করে

এক. আমি কি বাকি জীবন হতাশার মধ্যে চোখের জল ফেলেই যাবো?

দুই. নাকি আমার যেটুকু আছে তাই আমি ব্যবহার করবো?

নিজের কী আছে সেটা ভাবতে গিয়ে ক্যারলি দেখলেন, তার সবচেয়ে অবহেলিত অঙ্গটি হলো বাঁ হাত তিনি ভাবলেন এই বাঁ হাতকেই তার গুরুত্ব দিতে হবে তার ডান হাতবিহীন শরীরে চিকিৎসার জন্যে সময় লাগা এক মাস এরপর তিনি আর দেরি করেন না শুরু করলেন অনুশীলন বাঁ হাত ব্যবহারে মোটেও অভ্যস্ত ছিলেন না তিনি যখন লিখতে যান হাত থেকে কলম খসে পড়ে কোনো কাজ সহজভাবে করতে পারেন না বাঁ হাত দিয়ে পিস্তল ধরা শুরু করলেন কিন্তু নিশানা ঠিক রাখতে পারেন না তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ক্যারলি আবার শুরু করেন আবার হতাশা আসে আবার শুরু করেন দিন-রাত তার একই সাধনা যেভাবেই হোক তাকে আগের অবস্থায় যেতে হবে তাকে সেরা পারফর্মমেন্স দেখাতে হবে


ক্যারলি তার একমাত্র হাত দিয়ে অসাধারণ সাফল্য দেখালে অনেকে তাকে বাহবা দিলেও তিনি আবেগের প্রকাশ ঘটালেন খুব কম কারণ তার স্বপ্ন থেমে নেই তিনি শুরু করলেন আরো কঠিন সাধনা কারণ তার লক্ষ্য, জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে সেরা প্রমাণ করা ১৯৪০ সাল জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিককে সামনে রেখে তিনি তার সাধনা করে চললেন অনেকেই বিশ্বাস করা শুরু করলেন ক্যারলি হয়তো ভালো ফলাফল করবেন

ক্যারলি যা ভাবছিলেন তার বাস্তবতা বদলে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ১৯৪০ সালের অলিম্পিক বাতিল  ঘোষিত হলো

ক্যারলি স্বপ্নভঙ্গের অভিজ্ঞতা আবারো অর্জন করলেন কিন্তু তিনি থেকে থাকার পাত্র নন তার লক্ষ্য দাঁড়ালো ১৯৪৪ সালের লন্ডন অলিম্পিক তিনি তার প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামলো না যুদ্ধ চলমান থাকায় ১৯৪৪ সালের অলিম্পিকও বাতিল হলো আবারো ক্যারলির জীবনে হতাশা ভর করলো তীব্রভাবে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সবকিছুই আবার নতুন করে শুরু হলো ক্যারলি চাইলেন আবারো নতুন করে সব শুরু করতে কিন্তু এবার তার সামনে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল বয়স সাধারণত খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার অল্প সময় থাকে আট বছর সময়ে হাঙ্গেরিতেও অনেক তরুণ শুটার ততোদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে কর্তৃপক্ষ ক্যারলিকে জানালেন, জাতীয় পর্যায়ে আসতে হলে এই তরুণদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আসতে হবে

ক্যারলি ছিলেন এই তরুণ শুটারদের আদর্শ তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার কথা শুনে তিনি দমে যান নি কেননা তার স্বপ্ন দেখা তখনো থামেনি প্রতিযোগিতা হলো তরুণদের হারিয়ে তিনি স্থান পেলেন জাতীয় দলে তার সারা জীবনের স্বপ্ন অলিম্পিকে অংশ নেয়ার সুযোগ এলো তার সামনে পরপর তিনটি অলিম্পিক সিজন অপেক্ষা করে ক্যারলি ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে গেলেন পৃথিবীর সেরা শুটারগণ তাদের সেরা হাতের কাজ দেখাতে লাগলেন ক্যারলি তার একমাত্র হাত নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন

পিস্তলে ২৫ মিটার র‌্যাপিড ফায়ার ইভেন্টে সবাইকে বিস্মিত করে স্বর্ণপদক জয় করলেন ক্যারলি


স্বর্ণপদকজয়ী ক্যারলি (মাঝে) কখনো বুঝতে দিতে চাইতেন না তার এক হাত নেই


ঘটনার এখানেই শেষ নয় ১৯৫২ সালে চার বছর পর হেলসিংকি অলিম্পিকে হাঙ্গেরির পক্ষে অংশ নিলেন ক্যারলি এবার আর বিস্ময় নয় সবার আগ্রহী চোখের সামনে ক্যারলি একমাত্র হাতে প্রতিযোগিতায় নামলেন

অলিম্পিকের ইতিহাসে ২৫ মিটার র‌্যাপিড ফায়ার ইভেন্টে একই ব্যক্তির পর পর দুই বার স্বর্ণ জয়ের অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করলেন ক্যারলি


একজন অদম্য মানুষ যে কোনো বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারেন, ক্যারলি তার অন্যতম উদাহরণ

এম. জেড


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,
সাবক্যাটেগরিঃ অদম্য,


আরো পড়ুন