English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৭-১২ ০২:৫৬:৪১
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২৫ ১৬:৪৫:৫১


মাতৃত্বের অধিকার

মাতৃত্বের অধিকার

নাছির উদ্দিন মুহাম্মদ সুলতান

 

পর্ব:

গর্ভধারণ নারীর জীবনে এক গুরুত্বপূর্র্ণ অধ্যায়ের সূচনা আর সন্তান প্রসব নারীর জীবনে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা একজন নারী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের দোলাচালে তার গর্ভস্থ শিশু অতিথিকে দেখান মায়াময় পৃথিবীর অপরূপ রূপ নারী তার জঠরের অতিথির জন্য ত্যাগের এক অন্যন্য নজির সৃষ্টি করেছে; তার কাছে পরাজিত জীবন-মৃত্যুর সব সোনালি স্বপ্ন ভয়াবহতা তাই তো পরকালের সফল প্রাপ্তির জান্নাতকে বিশ্ববিধাতার পায়ের কাছে লুটিয়ে দিয়েছেন মেশকাত শরীফের ৪৭২২(২৯), ৯ম খণ্ড- আহমদ, নাসায়ী, বায়হাকীর বর্ণনা - ‘সন্তানদের বলা হয়েছে, জান্নাত তাঁর (মায়ের) পায়ের কাছে

অথচ সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে নারীর যে অধিকার তা যথাযথ ভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কী না অধিকাংশ সময় আমরা তা ভেবে দেখার আগ্রহই দেখাই না ফলশ্রুতিতে প্রায়ই একজন নারী তথা মায়ের জীবনাসান ঘটে বা দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে জীবন যাপনে বাধ্য হয়, যা মোটেই কাম্য নয় আমরা চাই নারী তার প্রাপ্য অধিকার পুরোপুরি ভোগ করুক, যে মাতৃগর্ভে আমাদের জন্ম তা নিরাপদ থাকুক এবং সুস্থ জীবন হাসিখুশি মন নিয়ে পার্থিব জীবন উপভোগ করুক

প্রসবের ক্ষেত্রে গর্ভবতীর সন্তান প্রসবের নিশ্চিত কোনো নির্ধারিত দিনক্ষণ বা তারিখ ডাক্তারদের জানা থাকে না তারা শুধু বলতে পারেন প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ সম্ভাব্য তারিখ বলতে আমরা কী বুঝি? সম্ভাব্যতার অর্থ হচ্ছে নির্ধারিত তারিখে গর্ভবতীর সন্তান প্রসব হতেও পারে আবার নাও হতে পারে অর্থাৎ নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না এভাবে ডাক্তারগণ গর্ভবতীর মাসিকের প্রথম দিন হতে গণনা করে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখটিকে তাদের প্রেসক্রিপশনে তথা ব্যবস্থাপত্রে ইডিডি বলে উল্লেখ করে থাকেন এক্ষেত্রে মিলনের দিন-ক্ষণ বিবেচ্য নয় সন্তান মাতৃগর্ভে থাকে মোট ২৭৫ হতে ২৮০ দিন মাসিক বা ঋতুর প্রথমদিন হতে হিসাব করলে মাসের সংখ্যা হয় মাস দিন জানুয়ারি মাসের যে কোনো দিন ঋতু শুরু হলে এবং সে ঋতুচক্রে গর্ভধারণ করলে অক্টোবরের যে কোনো দিন সন্তান ভূমিষ্ট হবে আগস্ট মাসের ঋতুতে গর্ভ সঞ্চার হলে, মে মাসে সন্তান প্রসব হয় জানুয়ারির তারিখে ঋতুর প্রথম দিন শুরু হলে সে ঋতুচক্রে গর্ভ সঞ্চার হলে  , অক্টোবরকে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিন মনে করা হয় আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যে তারিখে মাসিক বা ঋতু শুরু হল সেই তারিখের সাথে যোগ করে সম্ভাব্য তারিখ নির্ণয় করে মাস যোগ করা হয়, এটাই সম্ভাব্য তারিখ শেষ ঋতুর প্রথম দিন ফেব্রুয়ারি হলে প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ হবে +=১৫ তারিখ, আর মাস হবে ফেব্রুয়ারি+= নভেম্বর মাস অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর প্রসবের সম্ভাব্য দিন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সময়কার শ্লোগান ছিলনারীর অধিকার সুস্থ জীবন হাসি-খুশি মন’, এটা বাস্তবিকই তাদের আন্তরিক ইচ্ছা কিন্তু বাংলাদেশের অতীত প্রেক্ষাপট সুখকর ছিল না, বর্তমান প্রেক্ষাপটও সন্তোষজনক নয় মনে হয় এদেশের বেশিরভাগ ডাক্তারদের শ্লোগান হলো, ‘ধর রোগী কর জবাই তবে হবে অর্থ কামাই আয় রোজগার বাড়াতে তাদের নব নব উপলক্ষের যেন শেষ নেই যে কোনো উপলক্ষে তারা রোগীকে এক গাদা টেস্ট আর সিজার তথা অপারেশন করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন শুধুমাত্র অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে সরকারি হাসপাতালের সরকারি চিকিৎসকগণ বেসরকারি ক্লিনিকে বা চেম্বারে রোগীদের সেবা দেন হৃষ্টচিত্তে কিন্তু একই রোগী দেখেন কর্মস্থলে রুষ্ট আচরণে, ফলে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য হয় ব্যর্থ যেখানে ঔষধে রোগ নিরাময় যোগ্য সেখানেও তাদের শাণিত অস্ত্র থেমে থাকে না যদি রোগীর আর্থিক অবস্থা ভালো হয় তো কথাই নেই

প্রয়োজনে সিজার করাবেন শর্তেনা দাবি সনদেস্বাক্ষর করিয়ে আর কাল বিলম্ব করেন না তখন সিজার অবসম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় বেঁচে যান  মা তার সন্তান গর্ভবতী তার গর্ভস্ত সন্তানকে রক্ষা করার জন্য আত্মীয় স্বজনগণ ডাক্তারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন হৃষ্টচিত্তে প্রশ্ন হলো ডাক্তার কি তার চিত্তের দায়বদ্ধতা থেকে রেহাই পান? না রেহাই পান না  তবুও অর্থ যোগ বলে কথা প্রতিবাদ করতে পারেন, তবে আমি আমার বক্তব্যে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত কিছু বলছি না; নিজ বিবেককে প্রশ্ন করুন সঠিক জবাব পাবেন

স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে অন্তত ১২(বার) ঘণ্টা গর্ভবতীকে ধৈর্য ধারণ করানো উচিৎ, যদিও স্বাভাবিক প্রসবের স্থায়িত্বকাল প্রথম প্রসবকারিণীর ক্ষেত্রে থেকে ১৮ঘণ্টা, অধিক সন্তান প্রসবকারিণীর ক্ষেত্রে থেকে ৮ঘণ্টা মানুষের ধৈর্যশক্তি বা সহনশীলতা খুব একটা বেশি নয়, তাই কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন হয় ডা. হামিদা মায়দার অতীতে তাই করতেন, সারাজীবন কাউন্সেলিং করবেন কিনা জানি না তিনি সিজার করেন নি আমি তা বলছি না, প্রয়োজনে তিনিও সিজার করেছেন তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম তাদের বিরুদ্ধেও আমার কোনোই অভিযোগ নেই, যারা ডা. হামিদা মায়দারের মতো তেমনটি করেন, মানবতা বোঝেন যিনি প্রথম মা হতে যাচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে ডা. হামিদা ময়দারের প্রথম পরামর্শ স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে তার কী কী সুফল বা সুবিধা হবে সিজারের ক্ষেত্রে তার কী কী অসুবিধা বা জটিলতা হতে পারে তিনি বলেন, ‘মায়ের জীবন বাঁচাতে শেষ অবলম্বন সিজার, তবে ধৈর্যের ফল মধুর প্রসবযন্ত্রণা সয়ে মা হওয়ার আনন্দই আলাদাঅন্যান্য ডাক্তারগণ কি তা জানেন নাজানেন, বেশ ভালো করেই জানেন সব কিছুর উর্ধ্বে হলো জীবন রক্ষা করা, তা ডাক্তারদের যেমন জানা, আমরা আমজনতাও তা বুঝতে পারি ইসলামে জীবন বাঁচাতে মিথ্যা বলাকে যায়েজ বলা হয়েছে, হারাম খাওয়াকেও যায়েজ বলা হয়েছে, তবে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হবে না কিন্তু আমরা সমাজে কী দেখতে পাই, রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হাসপাতালে হামলা ভাংচুর অপ্রীতিকর অবস্থার শেষ নেই অভিযোগ, অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা ভুল হবে না আমি তাও বলছি না, হবে তবে সে ভুলও সীমার মধ্যে থাকতে হবে হয়তো বলবেন কাজ করলে ভুল হয়; ভুলের উর্ধ্বে মানুষ নয় তার আবার সীমা পরিসীমা হয় নাকি তার অর্থ এই নয় যে, অ্যাপিন্ডিসাইড অপারেশন করতে গিয়ে অন্ত্র কেটে ফেলবেন, গর্ভবতীর সিজার করতে গিয়ে শিশুর মাথা কেটে ফেলবেন, পিত্তথলি বা টিউমার অপসারণ করতে গিয়ে ভেতরে সিজার আর গজ রেখে দেবেন দাঁত তুলতে গিয়ে পাশের দাঁতে একটু বেশি চাপ পড়তে পারে, ডেলিভারি সিজারে তিন সাড়ে তিন ইঞ্চির স্থলে সাড়ে চার ইঞ্চি কাটা যেতে পারে কসমেটিক সিজারের স্থলে টিজ পড়তে পারে তাই বলে এম.আর করতে গিয়ে ইউটেরাস ধ্বংস করলে, আহত যন্ত্রণাকাতর রোগীকে জরুরি চিকিৎসা না দিয়ে গল্প বা আলাপচারিতায় কাল বিলম্ব করা অথবা রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে বাইরে চা-নাস্তার থিয়েটার মঞ্চস্থ হতে থাকলে কি ক্ষমার যোগ্য হবেআপনাদের কাছে মৃত্যু অথবা অসুস্থতা হয়তো  নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় অসুস্থ ব্যক্তি বা তার পরিজনের কাছে তা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয় এসব অনিয়ম অবহেলায় সুস্থ চিত্তের মানুষও রিঅ্যাক্ট করে, ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা আর তারা তখন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে সেবা বন্ধ কওে দেবেন তাহলে ট্রাক ড্রাইভার আর ডাক্তারদের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু! একটু ভেবে দেখবেন কী: ‘আপনি সেবা দিচ্ছেন না শ্রম দিচ্ছেন স্বভাবতই বলবেন সেবা দিচ্ছেন আসলে তা নয়, আপনি সেবা নয়, শ্রম বিক্রি করছেন চড়ামূল্যে জনগণ মূল্য দিয়েও সঠিক পরিমাণ শ্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ডাক্তারগণ কি তাদের শপথবাক্য পাঠ করেন নি? কেন তবে তারা শপথের বিপরীত আচরণ করবেন? সবকিছুর উর্ধে হলো জীবনরক্ষা করা, প্রয়োজনে ডাক্তার অবশ্যই শল্যচিকিৎসা করবেন, রোগীর আত্মীয় স্বজন না-দাবী সনদে স্বাক্ষর দিক বা না দিক, এটা ডাক্তারের পেশাগত মানবিক অধিকার আমরা ডাক্তারদেরকে সুস্থ মাথার খুনী বলতে চাই না জীবন রক্ষাকারী দূত ভাবতে চাই আমাদের চাওয়া অরণ্যেরোধন হোক তা কাম্য নয়

 

পরবর্তী পর্ব ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে

 

 লেখক পরিচিতি: গবেষক, কবি এবং হোমিও চিকিৎসক

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


আরো পড়ুন