English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৭-০৭ ০২:১৩:৪৩
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২৪ ১৮:৪৪:২৯


৯০-এর মধ্যবিত্ত: পাড়া-তো চালচিত্র

৯০-এর মধ্যবিত্ত:  পাড়া-তো চালচিত্র

সামিনা হক শাম্মী

'চয়নিকা' নামে আমাদের একটা বোর্ডের বই ছিল। কারো কি মনে পড়ে? তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রী। মধ্যবিত্তের বেড়ে ওঠার এই এক সুবিধে তখন.... সবগুলো পরিবারের মধ্যেই কোথায় যেন এক ভীষণ মিল। সব বিষয়ে uniqueness বা সবার চেয়ে ভিন্ন হবার কোনো স্যাঁতস্যাঁতে প্রতিযোগিতা নেই।সব কিছুতেই -বাড়িতেও যা, -বাড়িতেও প্রায় একই নিয়ম-কানুন আর পছন্দ-অপছন্দের ছড়াছড়ি। বরং দু'বাড়ির কোনো কিছু হুবহু মিলে গেলে সেটা যেন এক বাড়তি পাওয়া; সে শাড়ি-কাপড়, জামা-জুতো, কাপ-প্লেট, গৃহশৈলীর সৌন্দযবর্ধক তৈজসপত্র, যাই- হোক-না কেন। 'ব্র্যান্ড' নামক দৈত্যটা মধ্যবিত্তের শক্ত কাঁধে তখনও চড়াও হতে পারেনি। একই ভাবে বাচ্চাদের স্কুল নির্বাচন নিয়েও ছিল না অতিমাত্রার কোনো বাড়াবাড়ি বা জোরাজুরি। স্কুলের মান ভিত্তিক ভালো-মন্দের ফারাক থাকলেও; সাধারণতঃ 'স্কুল দেখে' বাসা নয়, বরং 'বাসা-দেখে' সেই বাসার অবস্থানগত নৈকট্যার ভিত্তিতে কাছের স্কুলগুলো বিবেচনা করা হতো। অতঃপর, ওগুলোর মধ্য থেকেই ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় বসিয়ে দিতেন বাবা মায়েরা। ভর্তি পরীক্ষার টেকা-টেকির মাধ্যমে নির্ধারিত হতো বাচ্চাদের 'বিদ্যালয় গন্তব্য' ডিসেম্বরের হিমহিম ঠান্ডার মধ্য দুপুরে; এক হাতে বার্ষিক পরীক্ষার উত্তীর্ন-পত্র এবং সেই ভাঁজে গোলাপি সবুজ কাগজের দুটি বুক লিস্ট বুকে চেপে, বাড়ি ফিরতাম লম্বা ছুটির আমেজ মেশানো 'নতুন ক্লাশে' ওঠার আনন্দে নাচতে নাচতে। হ্যাঁ, 'নাচতে নাচতে'- বলা চলে। কারণ, বাচ্চাকে গাড়ি করে ড্রাইভার সাহেব 'স্কুল থেকে বাড়ি' আর 'বাড়ি থেকে স্কুল' পৌঁছে দিচ্ছেন - এমন দৃশ্য ঐসময় প্রায় হাতে গোনা। বরং পাড়াভিত্তিক ছেলেমেয়েরা ; যারা দল বেঁধে হেঁটে বাড়ি ফিরতো, তাদের প্রতি 'গাড়ি চড়ুয়া বাচ্চাগুলো' বিদায়কালীন চোখে 'নিরব জ্বলুনী' দেখেছি যেন অতিমাত্রায় সরলতায় কেউ কেউ তো বলেই বসতো, "ইস্ দোস্ত, আমিও যদি তোদের মতো দলবেঁধে বাড়ি ফিরতে পারতাম..

 

প্রতিটা পাড়াতেই একাধিক একই স্কুলের ছেলেমেয়ে পাওয়া যাবেই ;যারা নিজেরাই যুক্তি করে, দলবেঁধে স্কুলে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাপত্রটা এঁটে নিতো নির্দ্বিধায়। ওসব নিয়ে ভাবার মতো ফুরসৎ বাবা-মায়ের ছিল না বললেই চলে। ছেলেমেয়েরা সময় মতো হাত-পা নিয়ে ঘরে ফিরেলই হলো। তাছাড়া, এদিক সেদিক করলে পাড়ায় তাদের ছোট-বড় প্রচুর 'চর' আছে, যারা নিজ-দায়িত্বে যাবতীয় কীর্তিকলাপ, যার যার বাবামায়ের কানে গুজে দেয়ার জন্য উদগ্রীব। সেদিক থেকে 'পাড়াতো বন্ধুত্ব' ব্যাপারটার একটা প্রচ্ছ্বন্ন প্রভাব বেশ লক্ষ্ করা যেতো স্কুল গন্ডিতেও। ঐসময়কালে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে সমীহ করা তো দূরে থাক্, 'ইংলিশ মিডিয়াম প্রসঙ্গটা' আমাদের গল্পের ধর্তব্যের বাইরে থাকতো।বাচ্চা বা বড়দের 'খানেক আরামদায়ক গালগপ্পের তালিকার

দূর দূর তক্ ওর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। 

 

সেসময় স্কুল পড়ুয়া পরিবারের অবিচ্ছেদ্য এক যন্ত্র যন্ত্রনার নাম ছিলো 'টাকনি'- সামনে লম্বা সুঁই এর মতো এক শলাকা আর সাথে শস্তা কাঠের তৈরি সাদামাটা হাতল.. সর্বসাকুল্যে আজকের যুগের স্ক্রু ড্রাইভার আদলের একটা যন্ত্র ; যার কার্যকরী অংশটা - সূঁচ সদৃশ, লৌহ শলাকার মাথায় সামান্য খাঁজকাটা কুরশী কাঁটা যেন। বইয়ের 'সৌন্দর্য্যবর্ধক মলাট' পরানোর আগে সুরক্ষা কবজ হিসাবে, টাকনি দিয়ে বইয়ের ধারটাকে সেলাই করা হতো 'নির্দয় কশাই' এর মতো হৃদয়হীন ভাবে।বাড়ির বড় ভাই বা আব্বা শ্রেণীর কোনো বীরপুরুষ(?) প্রবল উৎসাহে উৎসাহী হয়ে, রক্তহীন যজ্ঞটির দায়িত্ব পালন করতেন একাগ্রচিত্তে। এক পায়ে বই চেপে, দুহাতে টাকনি আর সূতা চালিয়ে, এক হৃদয় বিদারক কায়দায়, বই এর টুটি টিপে শক্ত বাঁধনে, বইগুলোর আয়ু নিশ্চিত করা হতো। বলাই বাহুল্য, কায়দা করে লাল-সাদার ডাবল সূতলির মারপ্যাঁচে বইয়ের জীবনী শক্তি জোড়ালো হলেও, টাকনির টিকা খেয়ে বই এর 'আনকোরা সৌন্দর্য' -টি ভীষণ রকম দমে যেতো। তবুও নতুন বই বলে কথা! তো 'বই' নয়, যেনো উচু ক্লাশে ওঠার 'সিলমোহর" শুরু হতো সেই আহত পর্দানশীন নতুন বইগুলো নিয়ে নতুন ক্লাশের রোমাঞ্চকর অপেক্ষা

 

আমাদের সেই ছোট্ট কালের স্কুলের 'বোর্ডের বই' মানেই, বছর শেষে বুক লিস্ট ধরে কিনে আনা নতুন বইয়ের গন্ধ, যত্ন করে গত বছরের ক্যালেন্ডারের উল্টো পিঠের টানটান মলাট.... 

কিন্তু বোর্ডের নতুন বই নিয়ে ভালো লাগার গল্পটা এতটুকুনই। কারণ, নতুন ক্লাশের স্বপ্ন নিয়ে, যে বইগুলোর গন্ধে হৃদয় মৌ মৌ করতো; পুরোদমে ক্লাশ চালু হবার কিছু কাল গেছে, কি-যায়নি; সে সব 'সৌরভ' ততদিনে গাত্র দাহকারী দুশমনে পরিণত হয়েছে। স্কুলে 'পরীক্ষার উপদ্রব' আর বাড়িতে 'বাবার পায়ের আওয়াজ' ; 'বইগুলোর' সাথে তার 'ক্ষুদে পাঠক'দের ভালোলাগার দুরত্ব বাড়াতে যারপর নাই ভূমিকা রাখত। 

 

সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের পর ডাইনিং টেবিলে (বলাই বাহুল্য মধ্যবিত্তের ডাইনিং টেবিলটা, খাওয়া দাওয়া,পড়ালেখা, চালবাছা, , মেহমানদারি, নিকট আত্মীয়ের বৈঠকখানা, জামা সেলাইকালীন সিংগার মেশিনের স্ট্যান্ড, আরবি শিক্ষার ঘরোয়া মক্তব, বা শাড়ির ফলস্ লাগানোর মতো বহুমুখী সব কর্মযজ্ঞের অবধারিত স্থান রূপে বিবেচিত হতো নির্বিকার চিত্তে) বোর্ডের বই নিয়ে পড়তে বসা মানে ছানাপোনাদের অনাগ্রহ মেশানো শাসন-মোড়া পড়ালেখার একটা জগা খিচুরী মুহূর্ত। তা নয়তো কী? একই টেবিলে এই চেয়ারে যখন, 'আমি হবো সকাল বেলার পাখি", তো পাশের চেয়ারেই ' অফ রিলেটিভিটি হেকেঁ মরছে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী, ওরই ধার ঘেঁষে মা রাতের খাবারের আয়োজনে, খাটি সর্ষে তেলের ঝাজালো গন্ধে আধপোড়া সেদ্ধ আলুর সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর শুকনো মরিচ মাখছেন ....

 



ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


সামিনা হক শাম্মী

সহকারী অধ্যপক, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ



আরো পড়ুন