দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব
মুস্তাকিম আহমেদ
হীরার সহিংস অন্ধকার জগত
গত দুই দশকে আফ্রিকার সাতটি গৃহযুদ্ধের কারণ- হীরা।
আফ্রিকায় হীরা আছে এমন ভূখণ্ডের দখল পেতে চলে সীমাহীন হানাহানি।
হীরা ব্যবহৃত হয় গৃহযুদ্ধের অর্থায়নে।
ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি আর আনন্দময় নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে
হীরাকে তুলে ধরা হয়।
কিন্তু বাস্তবে রক্তক্ষরণ, মৃত্যু, মানবাধিকারের ভয়াবহ
লঙ্ঘনের মূলে এই হীরা।
গৃহযুদ্ধ উসকে দেয় এমন হীরাকে বলা হয় “ব্লাড ডায়মন্ড” অথবা “কনফ্লিক্ট ডায়মন্ড”।
(বিখ্যাত অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও “ব্লাড ডায়মন্ড”
নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রের কাহিনীটি “কাল্পনিক” দেখানোর ডি বিয়ারসের অনুরোধে নির্মাতারা কর্ণপাত করেন নি।)
হীরাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৭ লক্ষ মানুষ নিহত
হয়েছেন।
হীরার খনির পরিবেশও অত্যন্ত করুণ।
এসব খনি শুধু গৃহযুদ্ধ নয়, সহিংসতা, জাতি বিদ্বেষ, পরিবেশ
বিপর্যয়, শিশুশ্রম এবং গুরুতর শ্রমিক শোষণের আঁতুড়ঘর।
দুর্বল কিম্বারলি প্রসেস
ক্রেতারা কোনো ব্লাড বা কনফ্লিক্ট ডায়মন্ড কিনছেন না এই
আশংকা দূর করতে উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে দি কিম্বারলি প্রসেস।
এটি একটি আন্তর্জাতিক সনদ, যা হীরার উৎস নিশ্চিত করে।
ক্রেতার সামনে রাখা হীরা কোন যুদ্ধ, বিদ্রোহে ব্যবহৃত হয়
নি, এমনটা আশ্বস্ত করাই এই সনদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
ব্লাড, কনফ্লিক্ট ডায়মন্ডের জোগান কমাতে সক্ষম হলেও সনদ
প্রক্রিয়াটি কিছুদিনের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে ।
দি কিম্বারলি প্রসেস সনদের মাধ্যমে একটি হীরা কোনো রকমের
যুদ্ধ, বিদ্রোহের অংশ নয় এতটুকু দাবি করতে পারে। শ্রমিকদের প্রতি অন্যায় হয়, মানবাধিকারের
চরম লঙ্ঘন হয় এমন খনি থেকে প্রাপ্ত হীরা নিয়ে দি কিম্বারলি প্রসেস-এর শক্ত কোনো নীতিমালা
নেই।
২০০৮-এ উত্তর জিম্বাবুয়ের হীরার মজুদের দখল নিতে জিম্বাবুইয়ান
আর্মি দুইশরও বেশি খনি শ্রমিককে হত্যা করে।
যেহেতু কোনো যুদ্ধ কিংবা বিদ্রোহী ছিল না, এই মজুদ থেকে
প্রাপ্ত হীরা দি কিম্বারলি প্রসেস সনদ পাবে।
গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় আলোর মুখ দেখার অল্প সময় পড়েই
এ সনদের গ্রহণযোগ্যতা মুখ থুবড়ে পড়ে।
বর্তমানে আপনি যে হীরা কিনছেন তা ব্লাড বা কনফ্লিক্ট ডায়মন্ড
নয়, এ কথা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব।
অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ
শ্রমিকেরা হীরার খনিতে কাজ করে কেমন আয় করেন?
টাইম মাগাজিন এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে।
কঙ্গোর কানগামবালা খনিতে ১০০জন শ্রমিক ৪ মাস ধরে কাজ করছেন।
হীরা পাওয়া যেতে পারে এমন স্তরে যেতে ৫০ ফিট পাথর সরানো হয়েছে।
চারমাস ধরে অমানুষিক ভাবে খেটেও তারা কোনো মজুরি পান নি।
কারণ, এখনো হীরার সাক্ষাত মেলে নি। হীরা পাওয়া গেলে তবেই মিলবে মজুরি।
১০ জনের একটি দল একদিন কাঙ্ক্ষিত হীরা পেল। হিরাটি একটা
গোলমরিচের দানার সমান।
উপস্থিত সুপারভাইজার হীরা হাতে নিয়ে মূল্য অনুমান করলেন,
১০ ডলার।
১০ ডলারের ৩০% (৩ ডলার) ১০ জনের দলটির সদস্যদের মধ্যে ভাগ
হবে।
বাকি ৭০% (৭ ডলার) যাবে খনি মালিকের পকেটে!
“হীরক রাজার দেশে”র
সেই অবিস্মরণীয় গানটি মনে পড়ে যায়,
“ও ভাই হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই
ও তার কানাকড়ি নাই।
কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।”
দানবের নাম সেসিল রোডস
হীরার অতীত ঘাটতে গেলে একটা নাম অনিবার্যভাবে এসে যায়,
সেসিল রোডস।
হের্ট ফোরডশায়ারে ১৮৫৩ সালে সেসিল রোডসের জন্ম।
মা , বাবার ষষ্ঠ সন্তান সেসিলের ছোটবেলা থেকেই হাঁপানি।
অসুস্থ সেসিলকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয় বড়
ভাইয়ের কাছে। ১৬ বছর বয়সে সেসিল পোঁছান নতুন এক মহাদেশ, আফ্রিকায়।
স্থানীয় আদিবাসী জুলুদের সাথে সেসিল হীরা খুঁজতে যেতেন।
এই হীরা হয়ে উঠে তার নেশা।
মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সেসিল রোডস পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন।
একের পর এক হীরার খনি কিনে এক পর্যায়ে প্রবর্তন করেন ডি
বিয়ারস কনসলিডেটেড মাইনস, লিমিটেড।
তিনি মানতেন ইংরেজরা জাতি হিসেবে প্রথম। সমগ্র আফ্রিকাকে
বৃটিশ রাজের অধীনে আনার জন্য তিনি উঠে পড়ে লাগেন।
ইংরেজ সাম্রাজ্যকে ছড়িয়ে দিতে, অকল্পনীয় নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞ
চালিয়ে সেসিল রোডস এককভাবে আফ্রিকার ৪,৫০,০০০ বর্গমাইল এলাকা দখল করেন।
নিজের নামের সাথে মিল রেখে তিনি আফ্রিকার ২টি দেশের নামকরণ
করেন। উত্তর রোডেশিয়া এবং দক্ষিণ রোডেশিয়া যা আজকের জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের প্রধাণ কুশীলব এই সেসিল রোডস।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদলে তার ছিল ব্রিটিশ সাউথ আফ্রিকা
কোম্পানি। তার প্যারা মিলিটারি বাহিনী অসংখ্য কালো মানুষদের হত্যা করে।
সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর মানসিকতা বাস্তবায়নে ছিল তার অঢেল
অর্থ বিত্ত, যা তিনি পেয়েছিলেন হীরার ব্যবসা করে।
প্রতিবছর কমনওয়েলথ দেশগুলো থেকে রোডস স্কলারশিপ প্রাপ্তরা
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। সেসিল রোডস উইল করে এ বৃত্তির ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একজন রোডস স্কলার।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসিল রোডসের একটা স্মৃতিস্তম্ভ
আছে।
সম্প্রতি ১৫০ জন প্রভাষক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েল
কলেজে শিক্ষাদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাম্রাজ্যবাদী সেসিল
রোডসের স্মৃতিস্তম্ভ না সরানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় সেসিল রোডসের দখল করা জমির উপর দাঁড়িয়ে
আছে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ কেপটাউন ।
২০১৫ সালে তীব্র প্রতিবাদের মুখে কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে
অবস্থিত সেইল রোডসের ৯০০ কেজি ওজনের ব্রোঞ্জের মূর্তিটি অপসারণ করা হয়।
সেসিল রোডস কোনো সাদামাটা সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন না।
গার্ডিয়ান পত্রিকা তাকে `খুনি’ আখ্যা দিয়েছে।
বেঁচে থাকলে তিনি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন
হতেন।
ক্যারেট নিয়ে দুটি কথা
হীরার ওজন বোঝাতে ক্যারেট কথাটা ব্যবহৃত হয় (হীরা এবং স্বর্ণের
ক্যারেট এক নয়)।
১ ক্যারেট অর্থ ০.২০০০ গ্রাম।
আরেকটু সহজ করে বললে ১ ক্যারেটের একটা হীরা একটা কিসমিসের
৪ ভাগের ১ ভাগ!
দাম?
বাংলাদেশে ১ ক্যারেট হীরার দাম ৭৯,১৪১ টাকা।
শখের দাম লাখ টাকা আর নির্বুদ্ধিতার মূল্য?
ইসরাইলি হীরাতে রক্তের দাগ
নিরীহ প্যালেস্টাইনিদের নির্বিচারে হত্যাকারী ইসরাইলি সেনা
বাহিনীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, হীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইসরাইলি অর্থনীতিবিদ শির হেভের বলেন,
“ইসরাইলি হীরা ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর ইসরাইলি
সেনাবাহিনীকে ১ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। আপনি ইসরাইলি হীরা কিনছেন মানে প্রতিবার আপনার
টাকার একটা অংশ ইসরাইলি সেনা বাহিনী পাচ্ছে।”
হীরা ইসরাইলের ১ নম্বর রপ্তানি পণ্য।
বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ রাফ হীরা ইসরাইল আমদানি করে।
ইসরাইলে প্রয়োজনীয় ঘষা মাজা শেষে এই হীরা বিক্রির জন্য বিশ্ব বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
ইসরাইলের মোট রপ্তানির ৫ ভাগের ১ ভাগ আসে হীরা থেকে যার
বার্ষিক মূল্য ২৮ বিলিয়ন ডলার।
পৃথিবীতে হীরা ব্যবসার সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক আরও অনেক
গভীরে।
মধ্য ও উত্তর ইউরোপে ইহুদীদের একটি ভাষা “ইয়েডিশ”।
আমেরিকা হোক কিংবা মধ্য প্রাচ্য ,বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে
আজও হীরার লেনদের চূড়ান্ত হয় করমর্দন এবং দুটি শব্দ দিয়ে
“মাযাল উ ব্রাহা”।
সৌভাগ্য ও আশীর্বাদের সাথে।
শব্দ দুটি ইয়েডিশ।
তথ্যসূত্রঃ
• ELIZABETH
SNEAD, "Crystallizing opinion". Los Angeles Times, October 10 2006.
https://www.latimes.com/archives/la-xpm-2006-oct-10-et-diamonds10-story.html
• ARYN
BAKER/TSHIKAPA, “BLOOD DIAMONDS”, TIMES.
https://time.com/blood-diamonds/
• Emily
Lawford, “Who was Cecil Rhodes and why is the Oxford University Statue so
Controversial?” Evening Standard, June 18 2020.
• Christopher
Montague Woodhouse, “Cecil Rhodes”. Encyclopedia Britannica.
https://www.britannica.com/biography/Cecil-Rhodes
• Sean
Clinton, “The Kimberley Process: Israel's multi-billion dollar blood diamond
laundry.” Middle East Monitor, November 19 2019.
https://www.middleeastmonitor.com/20191119-the-kimberley-process-israels-multi-billion-dollar-blood-diamond-laundry/
• Nadeem
Badshah,” Cecil Rhodes: Oriel College faces teaching boycott over refusal to
remove statue”. The Guardian, June 10 2021
https://www.theguardian.com/education/2021/jun/10/oriel-college-faces-teaching-boycott-over-refusal-to-remove-rhodes-statue
• Justin
Parkinson, “Why is Cecil Rhodes such a controversial figure?” BBC News
Magazine, April 1 2015.
https://www.bbc.com/news/magazine-32131829
• Linda
Noordling, “University of Cape Town’s battle to tackle a racist legacy”.
nature, May 26 2021.
https://www.nature.com/articles/d41586-021-01321-3
• David
Olusoga, “Topple the Cecil Rhodes statue? Better to rebrand him a war
criminal”. The Guardian, January 7 2016.
https://www.theguardian.com/commentisfree/2016/jan/07/cecil-rhodes-statue-war-criminal-rhodes-must-fall
• Michael
Fried, “2 Carat Diamond Ring: The Expert Buying Guide”. The Diamond Pro.
https://www.diamonds.pro/education/2-carat-diamond-ring/#author-box
• American
Gem Society, “Understanding Diamond Carat Weight”.
https://www.americangemsociety.org/buying-diamonds-with-confidence/4cs-of-diamonds/understanding-diamond-carat-weight-the-4cs-of-diamonds/
• Bangladesh
Diamond Price
https://www.gold-rate.co.in/diamond-prices/bangladesh-diamond-price-today/
• Palestinians
appeal to the Diamond Industry.
http://www.afopa.com.au/blog/2020/1/30/palestinian-appeal-to-the-diamond-industry
• Niv Elis,
“ Diamonds are (not) a boycotter’s best friend”. The Jerusalem Post, April 8
2014.
https://www.jpost.com/Business/Business-Features/Diamonds-are-not-a-boycotters-best-friend-347843
• Virginia
Gorlinski, “Yiddish language”, Encyclopedia Britannica.
https://www.britannica.com/topic/Yiddish-language
সিনিয়র শিক্ষক, বিজনেস, মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত