English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২১-০৩-১৬ ০১:১৯:৫৮
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২৫ ১০:৫৫:১৪


রেডিও আর আগের মতো গায় না গান

রেডিও আর আগের মতো গায় না গান


মফস্বলের ডায়রি



বিজয় মজুমদার


 

ছোটবেলায় আমাদের বিনোদন বাক্সটার নাম ছিল রেডিও।  রেডিও মানে গোল হয়ে অনুষ্ঠান শোনা। শুয়ে বসে শুনতে শুনতে সময় কাটানো। আকারে ছোট আর টিভির তুলনায় অনেক সস্তা ছিল বলে ৫০ থেকে ৯০-এর শেষ পর্যন্ত প্রায় সবার ঘর থেকে শোনা যেত রেডিওর প্রিয় আওয়াজ, “এখন শুরু হচ্ছে সৈনিক ভাইদের প্রিয় অনুষ্ঠান দুর্বার

 

বাংলাদেশের হাটে বাজারে, চায়ের দোকানে কিংবা বাসায় বাসায় বসে রেডিও শোনার যে অভ্যাস তৈরি হয়েছিল সেটি অনেকদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে গিয়েছিল। রেডিওর সাথে বাঙালি বাংলাদেশের একটা যোগসূত্র আছে। বাংলার কৃতি সন্তান জগদীশ চন্দ্র বসু রেডিওর অন্যতম আবিষ্কারকদের একজন। পরাধীন দেশে জন্মেছিলেন বলে রেডিও আবিষ্কারের কৃতিত্ব পেতে তাঁর শত বছর লেগে গেছে। অথচ যদি পেটেন্ট আগে করতে পারতেন তাহলে গুগলিয়ামো মার্কনির বদলে ইতিহাসে জগদীশ চন্দ্র বসু হতেন রেডিওর জনক।  একসময় রেডিও বাংলাদেশে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে বাংলাদেশের অনেক মফস্বলের পাড়ায় পাড়ায়  বিভিন্ন রেডিও শ্রোতা সংঘ জাতীয় সংগঠন গড়ে উঠেছিল।  

রেডিও মানে আমাদের শৈশব। রেডিও মানে রঙ্গিন মফস্বল। একটা সময় মফস্বল এর চায়ের দোকান থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের ঘরে এই একটা যন্ত্র মিলত। কারণ এটাই ছিল সবার একমাত্র  বিনোদন। রেডিও মানে সংবাদ, রেডিও মানে গান, রেডিও মানে গল্পের আসর, রেডিও মানে শিক্ষা। রেডিও মানে খেলার মাঠ থেকে সরাসরি সম্প্রচার, রেডিও মানে সেই সম্প্রচার অনুষ্ঠানে ধারাভাষ্যকারের তুবড়ি ছোটানো ভুল, “ মেঘে ঢাকা মাঠ, কর্দমাক্ত আকাশ

 

ছোটবেলায় বাসায় এক্সটা ব্যাটারির মজুত থাকত যেন রেডিওর কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান মিস না হয়ে যায়। দুর্বার এর মত জনপ্রিয় ছিল অনুরোধের আসর গানের ডালি,  গিতালী, মিতালী, নিশুতি। বিদেশি রেডিও চ্যানেল যেমন, আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা ইত্যাদি ছিল ভীষণ জনপ্রিয়

 

 রেডিও কী ভাবে কাজ করে সেটিও অনেকের কাছে ছিল এক বিস্ময়। আমার এক মামার ছোটবেলায় ধারণা ছিল রেডিওর ভেতরে আসলে একদল মানুষ বাস করে। তারাই গান গায়, কথা বলে। একদিন সে বাসার লোকদের অনুরোধ জানায় রেডিওর পেছন দিকটা যেন খুলে ফেলা হয়, যাতে সে রেডিওর ভিতরে গিয়ে গান গাইতে পারে

রেডিওর অনুষ্ঠানে কান লাগিয়ে থাকার আরেকটি কারণ ছিল রেডিওর শ্রোতাদের অনুরোধ এর আসর। এই আসরে শ্রোতাদের নাম উল্লেখ করে ঘোষক বা ঘোষিকা বলতেন, অনুরোধের এই গানটি শুনতে চেয়েছেন, দিনাজপুর মুন্সীপাড়া থেকে নাদিম, সোহেল, বীথি, জাহানারা এবং আরো অনেকে। অনুরোধের আসরে যে নিজের নাম শুনতে পেত সে মুখে চোঙ্গা লাগিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত সবাইকে বলে বেড়াতো তার এই অর্জনের কথা। 

 

আবাহনী আর মোহামেডান এর খেলার ধারাভাষ্য শোনার জন্য রেডিও খুলে বসে থাকতাম খেলা শুরুর অনেক আগে থেকে। আবাহনী সমর্থক গোষ্ঠীর জন্য একটা বিশেষ রেডিও বরাদ্দ ছিল আমাদের। পাড়াতুতো মামা ছিলেন সেই গোষ্ঠীর প্রধান রেডিওর মালিক বলে তাঁকে এই পদ প্রদান করা হয়েছিল। যেদিন খেলা থাকত তার বাসায় মুড়িমাখা নিয়ে কান পেতে রইতাম শুধু একটা শব্দ শোনার জন্য, “গোওওওওওল ধারাভাষ্যকার এর এই একটা শব্দ আমাদের যেমন আনন্দে ভাসিয়ে দিত, তেমনি হৃদয় বিদীর্ণ করে দিত।  

বাংলাদেশে রেডিওর যাত্রা শুরু সেই বৃটিশ আমলে, ১৯৩৯ সালে। বিস্ময়কর ভাবে বাংলাদেশে যেদিন রেডিওর অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু তার ঠিক ৩১ বছর পর একই দিনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় রেডিওর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতের কেন্দ্রের গান, কথিকা, সংবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে রেডিও হয়ে উঠেছিল যুদ্ধের আরেক হাতিয়ার। আর বেতার কেন্দ্রে কাজ করা কর্মীরা ছিলেন শব্দ সৈনিক

রেডিওর সুবিধা ছিল অনেক। এটির জন্য লাগতো না বিশাল কোনো এন্টেনা।  যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় রেডিও বয়ে নিয়ে যাওয়া যেত।  একটি মাত্র চ্যানেল নিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা টিভি সে সময় পরাধীন হলেও রেডিওর এক অর্থে ছিল স্বাধীন। আধুনিক আকাশ সংস্কৃতির অনেক আগে রেডিও দেশ কালের  সীমানা ঘুচিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে শাসক যতই ফলাও করে নিজের গুণগান আর বিরোধীদের দুর্নাম প্রচার করত, সাধারণ মানুষ নিরপেক্ষ সংবাদ পেত রেডিওর মাধ্যমে।  

  

১৯৬৫ সালে  টেলিভিশন এদেশের নাগরিকদের ড্রয়িং রুমে  প্রবেশ করে তবে একটা সময় পর্যন্ত এটি ছিল কেবল উচ্চবিত্তের যন্ত্র। কিন্তু টেলিভিশন এর দাম কমতে থাকার সাথে সাথে রেডিও বাংলাদেশের বাড়িগুলো থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। এক সময় যেটি রেডিওর শক্তি ছিল সেটাই তার দাপট কমিয়ে দেওয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। টেলিভিশন যখন আকাশ সংস্কৃতির যুগে প্রবেশ করে তখন থেকে কমে যেতে শুরু করে রেডিওর আদর। এখন রেডিও একটি ঐতিহাসিক বস্তু হিসেবে দু একটা বাসায় শোভা পেলেও সেটি আর আগের মত ঘরে ঘরে গান গায় না। 

 

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


বিজয় মজুমদার

লেখক, বিজ্ঞাপনকর্মী ও সমাজকর্মী



আরো পড়ুন