English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২১-০২-১৮ ০৭:৪৫:৫৯
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৮ ১১:৪৫:৫৪


ইজি নয় ইজি বাইক চালকের জীবন

ইজি নয় ইজি বাইক চালকের জীবন



মফস্বলের ডায়রি

বিজয় মজুমদার


অটো, টুকটুক, টমটম,  ব্যাটারি,  ইজি বাইক এ সবগুলো এই যানটির নাম। তবে দিনাজপুরে এটি ইজি বাইক বা অটো নামে পরিচিত। শহরের স্বস্তি ও অস্বস্তির নামও আটো। প্রথমত অটো না থাকলে শহরের সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের চলাফেরা বন্ধ, আবার রাস্তায় অটোর চাপে রাস্তা জ্যাম হয়ে চলাফেরা বন্ধ। অনেক সময় অটোর চালক নিজেই অপর অটোকে আওয়াজ দেয়, এই অটো, সামনে থেকে হটো।

 দিনাজপুরে কবে প্রথম অটো বা ইজিবাইকের আগমন ঘটেছিল  সেটা এখন রীতিমত ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়। তবে ধারণা করি ১৯৯০ এর পর থেকে দিনাজপুরে ধীরে ধীরে অটো রিকশার প্রচলন শুরু হয়। সে সময় ইজিবাইক এর যাত্রা মোটেও ইজি ছিল না। বলা যেতে পারে রিকশার প্রবল বিরোধীতার মুখে প্রথম দফায় ইজিবাইক রাস্তায় বেরুতে সক্ষম হয়নি। তবে এই দশকের শেষের দিকে এটি আস্তে আস্তে মফস্বল শহরের রাস্তা দখল করতে থাকে। এরপর ইজিবাইকের চাপে  শহর থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে শতাব্দী প্রাচীন মধ্যবিত্তের বাহন রিকশা। এখন মফস্বল শহরে রিকশা এক ঐতিহাসিক বাহন। 

ইজিবাইক সাধারণ মানুষের যাতায়াতকে সহজ করলেও নগরে বেশ কিছু জটিলতার সৃষ্টি করেছে। প্রথমত এটি বিদ্যুৎ চালিত বলে বিশেষ কারণে যদি শহরে বিদ্যুৎ না থাকে তাহলে পরেরদিন রাস্তায় ইজিবাইক সঙ্কট দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত  কারণটি আগেই উল্লেখ করেছি এটি মফস্বল শহরের রাস্তায় ও গলিতে জ্যামের সৃষ্টি করে, যা আগে মফস্বল বাসীদের জন্য একেবারে অচেনা ছিল। এছাড়াও মূল সড়কে ইজিবাইক অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মহাসড়কে ইজিবাইক বা নসিমন এর চলাচল আইনত নিষিদ্ধ। 

 

পরিবার এটে যাওয়ার কারণে আর সস্তায় এক জায়গা থেকে সহজে অন্য জায়গায় যাওয়ার সুবিধা নিয়ে ইজি বাইক এসে হাজির হয়। আর মফস্বলের রাস্তাঘাট দখল করতে তার বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। যার ফলে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় যে ইজিবাইক কেনা সম্ভব ছিল সেটির দাম এখন লাখটাকার উপরে। যখন ইজি বাইক রাস্তায় নামছিল তখন অনেকে ইজিবাইক কিনে ফেলে। কারণ ইজিবাইক চালানো অনেক ইজি।

ইজিবাইক এখন মফস্বলে জনপ্রিয় বাহন হলেও ইজিবাইক চালকেরা ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয় নন। এর কারণ দুটি।প্রথম কারণ হচ্ছে ভাড়া।  দূরত্ব এর সাথে ভাড়ার হার নির্ধারণ না করার ফলে অনেক সময় যাত্রী ও চালক ঝগড়া লিপ্ত হয়। আর অনেক সময় ইজিবাইক চালকদের আচরণ নিয়ে যাত্রী আর যাত্রীর আচরণ নিয়ে চালকের অভিযোগ একে অপরের প্রতিপক্ষে পরিণত করে। তবে এগুলো হচ্ছে নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনা। মানে এ ধরনের ঘটনা খুব কম ঘটে। বেশির ভাগ সময় ইজিবাইক আর এর চালক যাত্রীর সবচেয়ে কাছের একজন মানুষে পরিণত হয়। তবে এর জন্য যাত্রীকে সামনের আসনে বসা  চালকের সাথে যে সামান্য কয়েক ফুটের ব্যবধান এর সাথে বিশাল সামাজিক ব্যবধান  ঘুচিয়ে নিতে হবে।

 এদের বেশির ভাগের গল্পটা প্রায় এক রকম। যখন ইজি কেবল বাজারে এসেছিল তখন অনেক লাভ ছিল। সেই স্বর্ণযুগের সময়টা খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইজি বাইকের দাম খুব বেশি না হওয়ায় অনেকেই কেউ ইজি বাইক কিনে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া শুরু করে। আর এতে আয় কমা শুরু হয় প্রথম থেকে যারা ইজি বাইক চালাচ্ছিল তাদের। কিন্তু তারপরেও বেশির ভাগই এই পেশায় থেকে গেছেন।

এরকম একজন হচ্ছেন শামসুল আলম। দিনাজপুর মেডিকেল থেকে বাসায় ফেরার পথে তার বাহনে আসীন হই। পথের দূরত্ব অনেক বেশি। সামাজিক দূরত্ব ঘুচে গেলে তিনি তার গল্পের ঝাপি খুলে দেন। জনাব শামসুল আলম ২০০২ সালে ইজিবাইক চালানো শুরু করেন। ‌

ভাই শুরুতে ইজিবাইক ছিল সাম্যবাদী বাহন।

 কথাটি শুনে একটু অবাক হই। শামসুল আলম জানালেন, এক সময় ইজিবাইক চালিয়ে ইজিবাইকের মালিক হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। কারণ ইজিবাইকের দাম বেড়ে গেছে, আর চালকদের আয় পড়ে গেছে।

বিস্ময় আরো বাড়িয়ে দিয়ে শামসুল আলম জানালেন দীর্ঘদিন তিনি দিনাজপুরের অন্যতম সেরা হোটেল  দিলশাদ ভাণ্ডারের ম্যানেজার এর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ম্যানেজার এর চাকরি ছেড়ে ইজিবাইক চালানোর কেন শুরু করলেন জানাতে তিনি বললেন সেটা হচ্ছে “পরস্বাধীন” একটা পেশা। মানে ম্যানেজার হচ্ছে অপরের অধীন আর ইজিবাইক চালানো হচ্ছে নিজস্বাধীন পেশা।    

শামসুল আলমের বয়স এখন ৫০ পার। দিনাজপুর থেকে প্রায় আধাঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত খানসামায় তার বাসা। প্রতিদিন সেখান থেকে তিনি দিনাজপুরে এসে ইজিবাইক চালান। তবে এখন তিনি আবার আগের মত “পরস্বাধীন” হয়ে গেছেন। কারণ এক সময় সন্তানের মত নিজের ইজিবাইকটিকে আরেক সন্তানের কারণে বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

শামসুল আলমের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে সাভারের এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টারিতে কাজ করে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ের বিয়ের সময় ইজিবাইক বিক্রি করে দিতে হয়েছে।

জামাই যৌতুক চায়। কী করবো? জমি জমা তেমন কিছু নাই।

 

আগের পেশায় ফিরতে আর চায়নি মন। তাই এখন মহাজনের ইজিবাইক চালান। দিনে মালিককে দিতে হয় আড়াইশো টাকা। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ইজিবাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরে যান। কোনদিন ৪০০ টাকার মত হয়, আবার কোনদিন ২০০ টাকা। সারাদিন ইজিবাইক চালাতে হয়, তা না হলে সংসার চলে না। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন “দিনে দিনে সবকিছু ভাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবুও জীবন চালাতে হবে, তাই না ভাই!” 

শামসুল আলমের গল্পটা অজস্র ইজিবাইক চালকের।       

গল্প হয়ে চলতে থাকবে যতক্ষণ না ইজিবাইকের চেয়ে উন্নত কোন বাহন এসে এই গল্পকে কালের স্রোতে হারিয়ে দেয়। অথবা রিকশাচালকদের গল্পটা  ইজিবাইক চালকের গল্পে রূপ নিয়ে চলতে থাকে আজীবন!  


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


বিজয় মজুমদার

লেখক, বিজ্ঞাপনকর্মী ও সমাজকর্মী