English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-১২-২৪ ২১:০১:১৫
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২২ ১০:১৬:১০


তরুণ সমাজ শুধু দেশের ভবিষ্যত নয়, তারা বর্তমানও

তরুণ সমাজ শুধু দেশের ভবিষ্যত নয়, তারা বর্তমানও


-বাবু মার্কুজ গমেজ    

 

১৮৪৪ সালে স্যার জর্জ উইলিয়াম লন্ডনে প্রথম ইয়াং মেন ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন- ওয়াইএমসিএ প্রতিষ্ঠা করেন যুব সমাজকে বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা এবং সমাজের কাজে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা থেকে তিনি এই সংঘ গড়ে তোলেন ওয়াইএমসিএ- মূল মন্ত্রবডি, মাইন্ড অ্যান্ড স্পিরিট বাদেহ, মন এবং আত্মা ১৯৬৫ সালে ঢাকায় এর কার্যক্রম শুরু হলেও মূলত স্বাধীনতার পর থেকে ওয়াইএমসিএ- বিকাশ ঘটে

ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ওয়াইএমসিএ, বাংলাদেশ-এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজ (৫১) তার চমৎকার সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে সংগঠনটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি পাঁচ দফায় ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ওয়াইএমসিএ, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ওয়াইএমসিএভুক্ত কোনো দেশের সর্বকনিষ্ঠ ন্যাশনাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাশপাশি বাবু মার্কুজ গমেজ বিভিন্ন সময় এশিয়া প্যাসিফিক অ্যালায়েন্স অফ ওয়াইএমসিএ- নির্বাচিত সর্বকনিষ্ট প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাহী কমিটির সদস্যর দায়িত্ব পালন করেন তিনি ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স অফ ওয়াইএমসিএ- নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি বাংলাদেশ ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি ক্রিশ্চিয়ান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৭ সালে সেরা কো-অপারেটিভ লিডার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রিধারী বাবু মার্কুজ গমেজ পেশায় একজন ব্যবসায়ী স্ত্রী মার্শিয়া মিলি গমেজ তার যোগ্য সহযাত্রী ছেলে অভিষেক মেয়ে রাত্রিকে নিয়ে তাদের সংসার সম্প্রতি তিনি তার নিজের জীবন অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন বিপরীত  স্রোত সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামানের সঙ্গে

 

 

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: আপনার শিক্ষা, কাজ জীবনে পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলুন

বাবু মার্কুজ গমেজ: আমার জন্ম ঢাকাতে গ্রামের বাড়ি গাজীপুর শিক্ষা জীবন শুরু সাভারে মামার বাড়ি থেকে তারপর সেন্ট গ্রেগরি হয়ে তেজগাও সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিই এরপর নটরডেম কলেজে কমার্সে পড়েছি এবং জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে অনার্স মাস্টার্স করি আমার জীবনে আমার বাবা মায়ের ভূমিকা প্রবল তিন বোন, এক ভাই আমরা বাবা খ্রীষ্টফার গমেজ এবং মা পারুল ডরোথি গমেজ তাদের আদর্শে আমাদের বড় করেছেন একমাত্র ছেলে হিসেবে যেমন আদর পেয়েছি তেমনি কঠোর অনুশাসনের মধ্যেও বড় হয়েছি তাদের প্রথম লক্ষ্যই ছিল আমরা যেন উচ্চ শিক্ষিত হতে পারি আমরা চার ভাইবোনই ঢাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি মূল্যবোধ তৈরির জন্য এবং বিভিন্ন কাজে অনুপ্রেরনা দিয়েছেন আমাদের বাবা মা যেন আমরা ভালো মানুষ হতে পারি এবং সমাজের দায়িত্বগুলো সঠিক ভাবে পালন করতে পারি

বাবা লজিস্টিকের ব্যবসা শুরু করেন তিনি বাংলাদেশ ট্রাক কাভার ভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন টানা পনের বছর তিনি সভাপতি ছিলেন পাশাপাশি তিনি ক্রিশ্চিয়ান কো-অপারেটিভ ক্রেটিড ইউনিয়নের নির্বাচিত সেক্রেটারি ছিলেন দীর্ঘ সময় এখানে তিনি জড়িত ছিলেন তার এই সামজিক কাজে অংশগ্রহণ আমাকে উৎসাহিত করেছে ছাত্রাবস্থায় আমি ক্রিশ্চিয়ান ছাত্র কল্যাণ সংঘে স্বেচ্ছাসেবী ছিলাম এবং পরে ওয়াইএমসিএ-তে যোগ দিই সব সময়ই বাবা আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তিনি চেয়েছেন আমি যেন সমাজে কিছু কনট্রিবিউট করতে পারি যখন (২৩ ডিসেম্বর) আপনার সাথে কথা বলছি, দিনটি আমার মায়ের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী মাকে আমরা খুব মিস করি তিনি সব সময় আমাকে উৎসাহিত করতেন ঠিকমতো পড়াশানা করছি কিনা খোঁজ নিতেন আবার বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করে তাদের নামে বিচার দিলে উল্টো আমাকেই মারতেন, ‘কেন মারামারি করলাম সে কারণে আমার মা অনেক উদারমনা ছিলেন ১৯৯৩ সালে যখন মিলিকে বিয়ে করি তখন একটা সমাজিক জটিলতা দেখা দেয় আমি ক্যাথলিক আর আমার স্ত্রী মিলি প্রোটেস্ট্যান্ট তখনকার সমাজে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কিন্তু মা সহজে বিষয়টি মেনে নিলে আমার কোনো সমস্যা হয় নি

 

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: ওয়াইএমসিএ- কার্যক্রম নিয়ে যদি কিছু জানাতেন

বাবু মার্কুজ গমেজ: ইংল্যান্ডে ১৮৪৪ সালে শিল্প বিপ্লবের সময় ২১ বছর বয়সী তরুণ জর্জ উইলিয়াম ওয়াইএমসিএ- প্রতিষ্ঠা করেন ১৮২৫ সালে প্রথম ওয়ার্ল্ড কনফারেন্সে হয় বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে ১২৫ দেশে এর চার কোটি সদস্য এবং ১০ হাজারের ওপর স্থানীয় ওয়াইএমসিএ আছে বাংলাদেশে স্থানীয় ওয়াইএমসিএ আছে ১২টি

ইংল্যান্ডে ওয়াইএমসিএ শুরু হওয়ার সাত বছরের মাথাতেই ১৮৫০ সালে কলকাতায় এর কার্যক্রম শুরু হয় লাহোর করাচির ওয়াইএমসিএ- বয়সও ১০০ বছরের বেশি সে হিসেবে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় অনেক পরে ১৯৬৫ সালে ঢাকা ওয়াইএমসিএ শুরু হলেও তা ততোটা সংগঠিত ছিল না বিশ্ব ওয়াইএমসিএ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডেস্ক খোলে যুদ্ধে যেসব শিশু এতিম হয়ে গিয়েছে তাদের জন্য অনেকগুলো এতিমখানা খোলা হয় সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় খাদ্য সহায়তা দেয়া হতো রাস্তা করে দেয়ার কাজও সংগঠনটি করেছে তখন দেশে এনজিও কর্মকাণ্ড ছিল না বললেই চলে ওয়াইএমসিএ- সে সময় প্রতিনিধি ছিলেন আইরিশ নাগরিক বিল হার্ট তিনি বাংলাদেশে অনেক বছর ছিলেন ছিলেন তার নেতৃত্বে ওয়াইএমসিএ নতুন যাত্রা শুর করে একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ফুটবল কোচ বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল তার শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রথম কোচ ছিলেন বিল হার্ট কোচ হিসেবে তিনি আলোড়ন তৈরি করেন বিল হার্ট বাঙালি নারীকে বিয়ে করেন তাদের তিন সন্তান

সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজন চাহিদা তৈরি হয় বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে ওয়াইএমসিএ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, সুশাসন, এসডিজি ইত্যাদি বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে এর মূল লক্ষ্য তরুণ সমাজের ক্ষমতায়ন কেননা আমরা জানি দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে তাদের হাতে তাদের যদি সঠিক ভাবে তৈরি করা না যায় তবে হিতে বিপরীত হতে পারে পৃথিবী জুড়েই তাই তরুণদের জন্য নানান প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে পরিবেশ দূষণ এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ আমরা তরুণদের বোঝাতে চাই, বিশ্ব নাগরিক হিসেবে সবাইকে একই ধরনের আচরণ করতে হবে  আমাদের কোনো কাজের জন্য অন্যে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, আবার সবাই মিলে লাভবান হতে পারি ওয়াইএমসিএ- মূলমন্ত্রদেহ, মন আত্মা এর উৎকর্ষ সাধন কখনো শেষ হব না এটা যদি করতে পারি তবে বাসযোগ্য একটি সমাজ আমরা দেখতে পাবো

     পোপ ফ্রান্সিসের সাথে সস্ত্রীক বাবু মার্কুজ গমেজ

                                     

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: ওয়াইএমসিএ-তে আপনার পথচলার শুরু  সম্পর্কে কিছু বলুন বিভিন্ন সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন নানা অভিজ্ঞতাও হয়েছে   বিষয়ে কিছু জানান

বাবু মার্কুজ গমেজ: ১৯৯০ সালে ঢাকা ওয়াইএমসিএ-তে ডিরেক্টর  হই সে সময় যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের সবার বয়সই ছিল বেশি আমিই ছিলাম একমাত্র ২৫-এর নিচে সেই সময় থেকেই আমি চেষ্টা করে গিয়েছি তরুণদের ক্ষমতায়নের হয়তো সেটা করতে পেরেছি আমি ২৮ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই এর আগে নির্বাচিত কোনো ন্যাশনাল প্রেসিডেন্টই এতো অল্প বয়সে নির্বাচিত হন নি আমার ভাইস প্রেসিডেন্টদেরআংকল বলতাম

আমি পৃথিবীর পাঁচ মহাদেশের ৫০টিরও বেশি দেশে গিয়েছে এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডে ৩০-৩৫ বার, আমেরিকায় ২০-২২ বার হবে সময়ে আমি দেশে বিদেশে অনেক ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছি যা নিজের কাছেও বিস্ময়কর মনে হয় অনেক সময়

১৯৯৪ সালে ওয়াইএমসিএর ১৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডে আমার স্ত্রীসহ যাই বৃটেনে রানী হচ্ছেন বৃটিশ ওয়াইএমসিএ- চিফ পেট্রোন ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবিতে প্রার্থনা অনুষ্ঠানে তিনি এলেন প্রার্থনার পর ক্যান্টেরবেরি আর্চ বিশপের বাড়িতে গার্ডেন পার্টি দেয়া হয় ১৫০০-র মতো অতিথি আমরা এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আমাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী শাড়ি পরা দেখে রানী নিজেই এগিয়ে এলেন তিনি আমাদের সাথে কথা বলেন মূলত শাড়ির কারণেই তার আকর্ষণ এবং আমাদের রানীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়

১৯৯৮ সালে ভ্যাটিকান সিটিতে দ্বিতীয় পোপ জন পলের আশীর্বাদ পাই আমরা এবার বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে আসেন ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চ বিশপ জর্জ কোচেরি সুযোগ করে দেন পোপের সঙ্গে দেখা করার রাষ্ট্রদূতের বাসার প্রোগ্রামে আমার স্ত্রীসহ দেখা করি তাঁর সঙ্গে কথা বলি এসব আমার লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনন্দময় পরিবেশে


১৯৯৮
সালে প্রথমবার ওয়াইএমসিএ- ন্যাশনাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করি কাকরাইলে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে সেদিন  প্রধানমন্ত্রী খুব হাসিখুশি ছিলেন বেশ কয়েকবার বিল হার্টের কথা জানতে চান তিনি এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি ২০১৬ সালে কেরালায় অপ্রত্যাশিত মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা দেয় ভারত সরকার ১৯৯৮ জার্মানিতে স্পিকারের সঙ্গে দেখা করি ওয়াইএমসিএ- ১৭৫ বছর পূর্তিতে ইউএনের প্রেসিডেন্টকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি তুলে ধরি জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরি এর বাইরে একটি ঘটনা আমার সব সময় মনে পড়ে ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সিলেটের মৌলভীবাজারে যাই চা-শ্রমিকদের সন্তানদের করা যুব সমিতির অনুষ্ঠানে তারা কেউ ইউনিভার্সিটি, কলেজ বা স্কুলের ছাত্র আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ যান নি আমি ঝুঁকি নিয়ে যাই তারা আমাকে দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ে এই ভালোবাসা বা অভিজ্ঞতাগুলো অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব নয়

 


বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা সব সময়, সবখানে 


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: দেশকে আপনি ভালোবাসেন অনেক নেতিবাচক প্রচারণার মাঝেও বাংলাদেশ নিয়ে আপনি খুবই আশাবাদী এর পেছনে কোন কারণগুলো কাজ করে?

বাবু মার্কুজ গমেজ: গত বিশ বছরে পৃথিবীর সবকটি মহাদেশে আমি ঘুরেছি যে সব জায়গায় মানুষ অভিবাসন করে সে সব দেশও কাছ থেকে দেখেছি কিন্তু আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো জায়গা, প্রিয় জায়গা অনেকে বিদেশে থাকার কথা বলেছেন কিন্তু নিজের দেশ তো নিজের দেশ এখানে স্বাধীন ভাবে থাকতে পারি, অন্য দেশের সেকেন্ড সিটিজেন হয়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না আর নেতিবাচক প্রচারণা নিয়ে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলতে পারি

ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট গ্লোবাল টাউনহল নামে প্রতি বছর একটি প্রোগ্রাম করে বিভিন্ন দেশের সাথে ফরেন পলিসি ফর্মুলেশন করার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই কথা বলেন সে সব দেশের সিভিল সোসাইটিসহ নানা পর্যায়ের মানুষের সাথে দেশটির আর্থ সামাজিক অবস্থা কেমন, ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে কি না-ইত্যাদি বিষয়ে তারা ধারণা নিয়ে থাকেন এসব মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে রকম একটি আয়োজনে আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে কথা বলার আমন্ত্রণ পাই তিনি আমার কাছে জানতে চান, ‘বাংলাদেশে কতোটা ধর্মীয় সম্প্রীতি বা স্বাধীনতা আছে?’

এই প্রশ্নের উত্তরে এলে কেউ কেউ নেতিবাচক কথা বলেন আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আমার জীবনের একটি ঘটনা হিলারি ক্লিনটনকে জানাই আমি নিজেও লজিস্টিক বিজনেসের সাথে যুক্ত সেই কারণে বাংলাদেশ ট্রাক কাভার ভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি পদে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিই কোনো প্যানেল থেকে নয়, একক ভাবে সাধ্য মতো ক্যাম্পেইন করলাম নির্বাচনের অল্প কদিন আগে হঠাৎ করেই আমেরিকা আক্রমণ চালায় ইরাকে আমার বিরোধীরা বলতে থাকেন, ‘বাবুকে ভোট দেয়া মানে বুশকে ভোট দেয়া

তখন সারা দেশে বুশ বিরোধী মিছিল হচ্ছে পাশাপাশি বিরোধীদের অপপ্রচারে নির্বাচনের দিন আমি মন খারাপ করে বাসায় চলে গেলাম রাত বারোটায় আমার এজেন্ট ফোন করে জানতে চান আমি কোথায় আছি? কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি ভোটে নির্বাচিত হয়েছি এবং সর্ব্চ্চো ভোট পেয়েছি!

ভোট যারা দিয়েছেন তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেছেন, ‘আপনি এমন একজন সৎ এবং যোগ্য মানুষ যিনি আমাদের পক্ষে কথা বলতে পারবেন

তারা আমাকে যোগ্যতা দিয়ে বিবেচনা করেছেন অন্য কিছু দিয়ে নয় আমার কথা শুনে হিলারি ক্লিনটন বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ!’

আমি সব সময়ই বলি, যখন কারো জমি দখল বা বাসায় ডাকাতি হয় তখন দেখা হয় না তিনি মুসলিম না খ্রিস্টান যারা কাজটা করে তারা দেখে সেখানে গেলে লাভ হবে কি না কম বেশি অপরাধ সব  দেশেই আছে কিন্তু মাত্রা কতোটা সেটা গুরুত্বপূর্ণ

আমি মনে করি, বাংলাদেশ শুধু এশিয়ার মধ্যে নয়, সারা পৃথিবীর মধ্যে এমন একটি উদার, সহনশীল দেশ যে সহজেই সবাইকে গ্রহণ করতে পারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব অনুভব করি বাংলাদেশকে নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী এই আশাবাদের পেছনে বলতে হয় বাংলাদেশের একটি বড় অংশই তরুণ তাদের অধিকাংশের বয়স ২৫-এর নিচে এদের কাজে লাগানো গেলে দেশের অবস্থা বদলে যাবে করোনার সময় এতো ক্রাইসিসেও বাংলাদেশের অর্থনীতি যতোটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ইওরোপ আমেরিকায় তারচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার জায়গা এবং সেই সম্ভাবনাটি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ সঠিক ভাবে যদি আমরা পরিচালনা করতে পারি তবে তা সুফল বয়ে আনবে তরুণ সমাজ শুধু দেশের ভবিষ্যত নয়, তারা বর্তমানও কারণ এই সময়ই তাকে গড়ে তুলতে হবে, তাদের সামনে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে তাদের বর্তমান যতো ভালো করে দিতে পারবো, দেশের ভবিষ্যত ততো ভালো হবে


সপরিবারে বাবু মার্কুজ গমেজ


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: আপনার কাছে সাফল্যের সংজ্ঞা কী? সফলতার জন্য তরুণদের কোন পরামর্শ দেবেন? বড় দিনকে সামনে রেখে যিশু খ্রীষ্টের কোন শিক্ষাকে আপনি তরুণদের জন্য উপযুক্ত মনে করেন?

বাবু মার্কুজ গমেজ: সাফল্য একটি আপেক্ষিক বিষয় কেউ সম্মান চান, কেউ টাকা, কেউ ভালো সঙ্গী, কেউ বা গুলশানে বাড়ি আমার কাছে একজন মানুষ তখনই সফল হন যখন তিনি মানুষ হিসেবে নিজেকে আরেকজন বা প্রতিবেশী কিংবা তার আশে পাশে যারা আছেন তারা যখন তাকে বিবেচনা করতে পারবেন, ‘তিনি আমার সাথে মানবিক আচরণ করেছেন

অর্থের প্রয়োজন আছে তবে মাত্রাতিরিক্ত অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই মানুষের ন্যায়সঙ্গত যে চাহিদা আছে তা সৎ উপায়ে অর্জন করাটাই সাফল্য অন্যায় ভাবে বা যেন তেন ভাবে পাওয়াটা সফলতা নয় সৃষ্টিকর্তা একেক জনকে একেক ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন সেটার সর্বোত্তম ব্যবহারই হচ্ছে সাফল্য

এখন অর্থের মানদণ্ডে সব মাপা হয় এটা ঠিক নয় বিয়ে দিতে উপরি বা ক্ষমতা দেখা হয় এটা কিন্তু তার যোগ্যতা নয় আমাদের তরুণদের মনে রাখতে হবে যোগ্যতা দিয়ে নিজের পছন্দের বিষয়ে স্পেশালাইজড হতে হবে প্রযুক্তির ভালো ব্যবহার জানতে হবে  প্রযুক্তি অনেকটা কয়েনের দুই পিঠের মতো আমাদের বেছে নিতে হবে কোন দিকটা ব্যবহার করবো আমরা অনেক কিছু একসঙ্গে করতে চাই এটা সম্ভব নয় টিনএজ খুব ঝুঁকিপূর্ণ বয়স এই সময়টায় তাদের প্রতি অভিভাবকদের সবচেয়ে যত্নশীল হওয়া উচিত তারা সফল হওয়া মানে সুন্দর সমাজ, সুন্দর রাষ্ট্র পাওয়া

আর সাফল্যের জন্য কমিটমেন্ট রাখা সময়কে গুরুত্ব দিতে হবে আমি সময় মেনে চলি কোথাও কমিটমেন্ট করা থাকলে পনের মিনিট আগে সেখানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি কোনো কমিটমেন্ট করলে সেটা মানার চেষ্টা করি আমাদের প্রোগ্রামে কোনো ভিআইপি যদি সময় মতো না আসেন, তার জন্য অপেক্ষা না করে অনুষ্ঠান শুরু করে দিই তরুণদের সব সময় বলি, সময় মানতে হবে অজুহাত দিয়ে সমাধান হয় না

এটা প্রফেশনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা বলতে পারি বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা সয়াবিন তেল সারাদেশে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার কোম্পানির ২০০০ সালে তাদের জিএম আসেন সিঙ্গাপুর থেকে তিনি সব ভেন্ডরদের সঙ্গে কথা বলতে চান আমাকেও সময় দেন আমি নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট আগে গিয়ে রিপোর্ট করলে তিনি নিজেই রুম থেকে বের হয়ে আসেন হতাশার সুরে জানান, গত সাত দিনে অন্তত ত্রিশজন তার সাথে দেখা করতে এসেছেন কিন্তু একজনও সময় মতো আসেন নি প্রত্যেকেই নানা অজুহাত দেখিয়েছেন একমাত্র আমি সময় মতো এসেছি  এতে তিনি খুবই আনন্দিত পরের সাত বছর তিনি বাংলাদেশে ছিলেন তিনি নানা সময় আমার পরামর্শ নিতেন

 

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: বড় দিনকে সামনে রেখে যিশু খ্রীষ্টের কোন শিক্ষাকে আপনি তরুণদের জন্য উপযুক্ত মনে করেন?

বাবু মার্কুজ গমেজ: যিশু খ্রীষ্টের আগমন হয়েছিল শান্তি সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য এর জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন বড় দিনের উৎসবে আমরা যেন এর বাহ্যিক দিক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে না পড়ি নতুন কাপড় পরার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো যিশু খ্রীষ্টের আদর্শকে ধারণ করে এই অশান্ত সময়ে পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য আনতে পারা সে জন্য কাজ করতে হবে বড়দিন শুধু খ্রীষ্টানদের জন্য নয়, এটি সার্বজনীন উৎসব এই উৎসব সবার কারণ বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ

 

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

বাবু মার্কুজ গমেজ: আপনাকেও ধন্যবাদ

 

 

 ছবি: সাইফ ও সংগ্রহ 

 

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,
সাবক্যাটেগরিঃ আলাপন,


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।



আরো পড়ুন