মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
‘মেঘের অনেক রং’ আমি দেখি নি। সবসময়ই আমার কাছে তা ধূসর—হাল্কা অথবা গাঢ়, এই যা পার্থক্য। রং আমি যা দেখেছি, তা প্রাত:রাশের। রুটি-সব্জি থেকে শুরু করে, রুটি-ডিম, রুটি-গোস্ত, রুটি-ডাল, পরোটা-সব্জি, পরোটা-ডাল, পরোটা-ডিম, পরোটা-ডালগোস্ত, পরোটা-হালুয়া, পরোটা-মগজভূনা, পরোটা-কিমা, কিমা-পরোটা, আলু-পরোটা, ডিম-পরোটা, খিচুড়ি-ডিম, খিচুড়ি-ভূনা, ভূনা-খিচুড়ি, লুচি-দম, লুচি-মিষ্টি, ইডলি, দই-বড়া, নুডলস, ব্রেড-বাটার-জ্যাম, ব্রেড-বাটার-এগ, ক্রসাঁ, মাফিন, ডেনিশ (ওরফে ডেনিশ পেস্ট্রি) আরো কতো কী! রুটি বলতে কি শুধুই রুটি? সাদা আটার রুটি, লাল আটার রুটি, কাঁচা পানির রুটি, সিদ্ধ (ফুটানো) পানির রুটি, গমের আটার রুটি, চালের আটার রুটি, আরো কতো! নুডলস বলতে সাধারণ নুডলস, রাইস নুডলস, গ্লাস নুডলস ইত্যাদি; মাফিন বলতে কাপ-মাফিন, ভ্যানিলা-মাফিন, চকলেট-মাফিন, ব্লুবেরি-মাফিন, স্ট্রবেরি-মাফিন—এমনি চলতেই থাকবে। তাই বলছিলাম—রং-এর বাহার যদি থেকেই থাকে, তবে তা প্রাতঃরাশের। যারা আবার এরই মধ্যে পরোটা-কিমা ও কিমা-পরোটা, অথবা খিচুড়ি-ভূনা ও ভূনা-খিচুড়িকে একই ভেবেছেন, কিংবা ভেবেছেন আমি ভুল করে পুনরাবৃত্তি করেছি, হলফ করে বলে দিতে পারি, তারা কালার ব্লাইন্ড (Colour Blind)। প্রাতঃরাশের রং তারা দেখতে পান না।
আজ কোয়ারেন্টিনের চতুর্দশ এবং শেষ দিন। ঘুম থেকে উঠে সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখতেই দেখি, বাংলাদেশ থেকে এক বন্ধুর বার্তা—‘আর বিলম্ব না; না, আর বিলম্ব না। আর মাত্র এক দিন বাকি।‘ জবাবে আমি লিখলাম—আর মাত্র আট ঘণ্টা। নাস্তা নিয়ে টেবিলে বসতেই সিডনি থেকে বন্ধুর ফোন
—কী রে, ছাড়া পাচ্ছিস কখন? নিতে আসব না কি?
— না, না, ছেলে আসবে নিতে। ও তো এখন বড় হয়েছে। [বলার সময় লক্ষ্য করলাম বুকের ছাতিটা ছয় ইঞ্চি ফুলে গেল। ভাগ্যিস! টি-শার্ট পরে ছিলাম, নতুবা শার্টের বোতামই হয়তো ছিঁড়তো গোটা দুয়েক।] বরাবর বন্ধুরাই নিতে আসে। এই প্রথম আসবে ছেলে।
— নাস্তা হয়েছে?
— হ্যাঁ।
— তা, কী খেলি?
বন্ধুকে আমার প্রাতঃরাশের বর্ণনা দিলাম খুব ছোট্ট করে—লিউকওয়ার্ম চকলেট মাফিন উইথ মেল্টেড বাটার, সাথে এক মগ ব্ল্যাক কফি।
ও বললো—এই বয়সে তুই খাস এগুলো—মাফিন-বাটার?
আমি বললাম—ভাইরে, সব তো আর আমার জন্য করি না। টেস্ট বাড (Taste Bud) গুলোকে তো সন্তুষ্ট রাখতে হবে! শেষ বিচারের দিনে যখন যখন জিভের বাণী বন্ধ থাকবে, তখন তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোই সাক্ষী দেবে। এখন খুশি রাখলে সেদিন কিছু ফায়দাও তো হতে পারে। ও বললো—সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু কোলেস্টেরল?
আমি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বললাম—‘আগের কাজ আগে তো তুমি সারো, পরের কথা ভাবিও পরে আরো!’
কিছুটা ভগ্ন হৃদয়ে ও বললো—আমার নাস্তার আগে তোর সাথে কথা বললে ভালো হতো।
মনে হয়, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে বেচারার নাস্তাটা ভালো হয় নি; আদৌ না হয়ে থাকলেও আমি অবাক হবো না। তবে ভাব দেখে মনে হলো, কাল সকালে নির্ঘাৎ সে আমার নি:স্বার্থ পরামর্শ কাজে লাগাবে—টেস্টবাডগুলোকে খুশি রাখা বলে কথা!
নাস্তার টেবিলেই গিন্নির ফোন:
—কী নাস্তা দিয়েছে? অবশ্য যা দেবে, তাই-ই তো তোমার কাছে আজ মধু মনে হবে।
দেখলাম, মনের ভাব প্রিয়জনেরা ঠিকই বোঝে।
গিন্নির ফোন শেষ না হতেই আমেরিকা থেকে বন্ধুর ফোন। সেখানে এখন রোববার বিকেল। সপ্তাহান্তে বাইরের কোন জরুরি কাজ সেরে অথবা আগামী সপ্তাহের মুদি-বাজার শেষে বাসায় ফিরছে।
— ভাবলাম, আজ নিশ্চয়ই এখন ঘুমচ্ছো না। আর কতক্ষণ পরে ছাড়বে?
এ ক’দিনে এমন জ্বালানো জ্বালিয়েছি, যে আমার মুক্তির প্রহরের হিসেব শুধু আমি কেন, সবাই রাখছে। এই না হলে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব? আগামীকাল থেকে শান্তিতে থাকবে সবাই!
ইংরেজদের সেই বুলির কথা বলেছিলাম কোনো একদিন—জীবন যদি তোমাকে লেবুই উপহার দেয়, তো সরবত বানিয়ে খাও! আমি সেটাই করেছি এ ক’দিন। অনেকের বাসাতেই বাথটাব থাকে আজকাল। কিন্তু কোমরের ব্যথা উপশমের জন্য ছাড়া, শুধুই সময়টা উপভোগ করার জন্য গত এক বছরে কে কতবার বাথটাবে শুয়েছেন, মনে করেন দেখি! সত্যি বলতে কি, আমারও সে সুযোগ হয় না। ‘হুদা’কাজে আমরা সবাই এত ব্যস্ত থাকি যে, নিজের জন্য সময় বের করা অনেকেরই সম্ভব হয় না। আমারও তাই। তবে, এবার হয়েছে। গত তের দিন, প্রতিদিন হাল্কা কুসুম গরম পানি ভরে বাথটাবে শুয়ে থেকেছি পুরো এক ঘন্টা, কী তারও বেশি সময় ধরে। আজ চতুর্দশ দিন। বেলা এগারটা বাজে। এখনই ঢুকবো। টাবে শুয়ে শুয়ে বই পড়া হোক বা না হোক, মোবাইল হাতে নিয়ে রোজনামচা তো লেখাই যায়; নিদেন পক্ষে গান শোনা বা পরিবার ও বন্ধুদের সাথে ফোনে আলাপচারিতা। চৌদ্দদিনে যে পরিমাণ গান শুনেছি আমি, গত চৌদ্দমাসে তা শুনেছি বলে মনে হয় না। অনেক কিছুর সঙ্গে, এক বন্ধুর পরামর্শে পাঞ্জাবের Nooran Sisters-এর কিছু গানও শুনলাম এই প্রথম। গানের কথা না বুঝলেও শুনে বেশ ভাল লাগলো। আরও একটা উপকার হয়েছে—হোটেল রুমের প্রতিটা ছোটখাট জিনিষেরও উপযোগিতা উপলব্ধি করেছি। ভাবছি পরিচিত কেউ কোনো নতুন হোটেল বানালে রুম ডিজাইনের কাজ করার জন্য একটা দরখাস্ত পেশ করবো।
লেখাটা শুরু করেছিলাম—‘মেঘের অনেক রং’—দিয়ে। বর্তমান প্রজন্মকে অবশ্য বলে দিতে হবে, এটা ১৯৭৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটা চলচিত্রের নাম, যেটা পাঁচটি বিষয়ে জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার পেয়েছিল। হঠাৎ অভিনেতাদের নাম জানতে ইচ্ছে হওয়ায় গুগল সার্চ করে পেলাম মাস্টার আদনান, ওমর এলাহী, রওশন আরা, মাথিন এঁদের নাম। মাথিন নামটা দেখেই অনেক আগে পড়া একটা উপন্যাসের নাম মনে এল—‘যখন পুলিশ ছিলাম’। ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের লেখা একটা আত্মজীবনী; যেখানে প্রধান চরিত্রের একটা ছিল—মাথিন। বিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর দিকের কথা। চাকুরীর সুবাদে টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন ধীরাজ ভট্টাচার্য্য। সমুদ্রের একদম কোলে বলে, টেকনাফে মিঠে (সুপেয়) পানির অভাব ছিল। থানার লাগোয়া ছিল মিঠে পানির কূপ। সেখানেই পানি নিতে আসত রাখাইন জমিদারের রূপবতী কন্যা মাথিন। তার পরেরটুকু ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যান। ধীরাজের বাবা বিষয়টি জেনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে অসুস্থতার ছুতোয় কলকাতা যেতে বলেন। ধীরাজের আর টেকনাফে ফেরা হয় না। অথচ মাথিনকে বিয়ে করার অঙ্গীকার ছিল। অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে কষ্টে, অনাহারে, অনিদ্রায় একসময় মৃত্যুই হয় মাথিনের। শুনেছি, সেই ‘মাথিনের কূপ’ এখনও আছে টেকনাফে। দেখা হয় নি আমার। আরও তো অনেক কিছুই দেখা হয় নি। বছর কয়েক আগে হঠাৎ খবরের কাগজে তার মৃত্যুর খবর পড়ে আঁতকে উঠেছিলাম—আসমানী তাহলে বাস্তবে ছিল! কবি জসীমউদ্দিনের ‘আসমানী‘ কবিতাটা নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে এখনও (আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও; রহিমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও ..)। আরও শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ
‘পোস্ট মাস্টার’ ছোটগল্পটি লিখেছিলেন শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছাড়ি বাড়িতে বসে। পোস্ট মাস্টারকে ঘরোয়া কাজে সাহায্য করতো যে মেয়েটি তার নাম ছিল রতন। পোস্ট মাস্টার গল্পটি পড়েছে অথচ রতনের নাম মনে নেই, এমন হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে ‘বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না, সেই মূহূর্তে সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল’ এই বাক্যের ভাবসম্প্রসারণ করে বাংলা পরীক্ষায় যাদের পাশ করতে হয়েছিল, তেমন কেউ জ্বরের ঘোরে যদি নিজের নামও কদাচিৎ ভুল করে, তথাপি রতনের নাম কোনো ভাবেই সে ভুলতে পারে না। শাহজাদপুরের সেই রবীন্দ্র কাছাড়ি বাড়ি আমি অনেকবার দেখতে গিয়েছি। কখনো সে এলাকায় রতন নামে কেউ ছিল কি না, তা জানার চেষ্টা করি নি। কিছুদিন আগে একবার গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। এলাকার এক বৃদ্ধ বলেছিলেন—তিনিও শুনেছে রতন নামেও বাস্তবে কেউ ছিল। চৌদ্দদিন কোয়ারেন্টিনে বসে মনে হলো—বৃথা হলো জীবনের এই চৌদ্দটি দিন। কতো কিছুই করা যেত, কতো কিছুই তো দেখা যেত এই চৌদ্দ দিনে। পরক্ষণেই মনে হলো, এখন না হয় কোয়ারেন্টিনে থাকার কারণে অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি, কিন্তু হেলায় সুযোগ হারিয়ে মুক্ত অনেক সময় কি আমি নিজেই কোয়ারেন্টিন বানিয়ে ফেলি নি?
এসব এখন থাক! আমি বরং ভাবি আজ বাসায় গিয়ে কী করবো। মেঝ মেয়েটার এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে নভেম্বরের ছয় তারিখে। আগামী বছর সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে। ওর সঙ্গে অনেক আলাপ জমা রয়েছে আমার। বড় মেয়েটা ওর গ্রাজুয়েশন শেষ করবে আগামী জুন (২০২১) মাসে। তখন হয়ত আমি আসতে পারবো না। ওর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েও ও হয়তো কথা বলতে চাইবে। ছেলেটাতো নিতেই আসছে। স্কুল থেকে রওনা হয়েছে বেশ কিছুটা আগেই। বাচ্চাদের মার সাথেও আছে অনেক আলাপ। সব কিছু তো আর ফোনে বলে শেষ করা যায় না। ওদেরকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে। সেসবের পরিকল্পনাও করতে হবে। কিছুটা অবশ্য করা হয়েছে ইতিমধ্যেই।
এখন বাজে বিকাল পাঁচটা বেজে বিশ মিনিট। নির্গমনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাস্তায় নেমে এসেছি। ছেলেটা পৌঁছে গেছে এরই মধ্যে। ছেলেই ফোন করে ট্যাক্সি ডাকলো। আমিও রওনা হলাম বাসার পথে। শরৎবাবুর সাথে এখানে আমার একটা বড় পার্থক্য। শ্রীকান্তরূপী শরৎচন্দ্র তাঁর কেরেন্টিন শেষে রেঙ্গুনের পথে রওনা হয়েছিলেন অনেক দুশ্চিনতা মাথায় নিয়ে। সঙ্গে ছিল জাহাজে পরিচয় হওয়া উটকো ঝামেলা—অভয়া এবং অসুস্থ্য রোহিণী’দা। কোথায় থাকবেন, কী করবেন, চাকরিটা কতোদিনে হবে, আদৌ হবে কী না এমন অনেক অনিশ্চয়তা ছিল সঙ্গে। আমি যাচ্ছি নিজের পরিবারের কাছে, নিজের বাসায়। দুশ্চিন্তা তো নেই ই, বরং চারটে সপ্তাহ পরিবারের সাথে একান্তে সময় কাটাতে পারবো, এই সুখানুভূতিতেই ছেয়ে আছে সমস্ত মনটা। শুধু মনে হচ্ছে, এই চৌদ্দটা দিন একদম হারিয়ে গেল জীবন থেকে। যে দরজা দিয়ে এই ঘরে ঢুকেছিলাম, আজ চৌদ্দদিন পরে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম, এখানেই রেখে গেলাম জীবনের চৌদ্দটা দিন। তবুও মনের একদম ভিতর থেকে আর একটা ভাবনা উঁকি দিচ্ছে—হারিয়ে গেল, সন্দেহ নেই, তবে ভোলা কি সম্ভব এই চৌদ্দটা দিন, আমার কোয়ারেন্টিন !
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে
২৩ নভেম্বর ২০২০
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত