English
ঢাকা, শুক্রবার, ৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৬-১৫ ০৬:৪৩:৫৮
আপডেটঃ ২০২৫-০৫-০৮ ১১:৫৩:০৯


মিশেলিন গাইড:  ইতিহাস ও বাস্তবতা

মিশেলিন গাইড:  ইতিহাস ও বাস্তবতা


মাহতাবুর রহমান ঊল্লাস

মিশেলিন টায়ার। টায়ার বাণিজ্যে সারা পৃথিবীতে যাদের বর্তমান অবস্থান দ্বিতীয়। গাড়ির যন্ত্রাংশ নিয়ে যারা ভাবনা চিন্তায় থাকেন তাদের কাছে হয়তো মিশেলিন টায়ার এক পরিচিত নাম। তবে এখন বিশ্বায়নের কালে টিভি কমার্শিয়াল অথবা অমনি চ্যানেল কমার্শিয়ালের দৌরাত্ম্যে ভোক্তা না হয়েও আমাদের গিলতে হচ্ছে বিস্তর প্রচারণা। সেভাবেও আমরা হয়তো অনেকে চিনি মিশেলিন ব্র্যান্ডকে। আজ আমরা মিশেলিন টায়ার নিয়ে গল্প করছি না, আমরা গল্প করবো মিশেলিন স্টার গাইড নিয়ে। যে গাইডবুক গত ১০০ বছর ধরে রন্ধনশিল্পের নোবেল, যে স্টার তকমা পাবার জন্যে শেফদের বছরের পর বছর সাধনা করতে হচ্ছে, কী আছে এই মিশেলিন স্টারে অথবা মিশেলিন গাইডে? টায়ার ব্র্যান্ড কেনই বা রেস্টুরেন্ট রেটিং বিগত ১০০ বছর ধরে করে যাচ্ছে?

মিশেলিন গাইড: এক ব্যবসায়িক কৌশল
বিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ার কথা। মিশেলিন রেটিংয়ের গল্পের শুরু ফ্রান্সের দু’সহোদরের হাত ধরে। আন্দ্রে ও এদোয়ার্দো মিশেলিন দু’ভাই মিশেলিন টায়ারের গোড়াপত্তন করেন। টায়ার নিয়ে দু’জনের বিস্তর গবেষণা এবং টায়ারের আধুনিকায়নে তাদের কোম্পানির অবদান আছে। শুরুতে দু’জন যখন শুরু করলেন তারা দেখলেন সারা ফ্রান্সে গাড়ির সংখ্যা নেহায়েত ৩০০ হবে। এবং এই ৩০০ গাড়ির ব্যবহার সীমিত আকারে। অনেক ভেবে চিন্তে গাড়ির ব্যবহার এবং টায়ারের অপচয় বাড়াতে তাদের আবিষ্কার এই মিশেলিন রেটিং গাইড। এই একটি কৌশল বাড়িয়ে দিল গাড়ির আশানুরূপ ব্যবহার এবং দু’ভাইয়ের টায়ার বিক্রি। কী আছে এই গাইডে? গাড়ির সংখ্যা ৩০০ হলেও ফ্রান্স জুড়ে তখন ক্যাফে এবং রেস্টুরেন্ট এর জমজমাট প্রসার। ১২শ রেস্টুরেন্ট ছড়িয়ে আছে পুরো ফ্রান্সে। মিশেলিন ভাইরা ভেবে দেখলেন, আমরা যদি এই রেস্টুরেন্টগুলোর একটা গাইড লিস্ট দিতে পারি তাহলে দূর দূরান্তে মানুষ ঘুরে ফিরে খাবে, হবে গাড়ির ব্যবহার, বাড়বে আমাদের ব্যবসা। এই ভাবনাকে মাথায় রেখে তারা প্রথম গাইড বইটি ছাপায় যেখানে শুধু খাবারের দোকান নয়, তাদের টায়ার কোথায় কোথায় পাওয়া যাবে তার বিবরণ, গাড়ি কোথায় ঠিক করা যায় এবং গাড়ির ফুয়েল স্টেশনগুলোর লিস্ট দুরত্ব সহ বর্ণনা করা হলো। ৩০০ গাড়ির মালিকের জন্যে ৩৫০০টি গাইড বই ছাপানো হলো এবং এমনভাবে বিতরণ করলেন তারা যেন কোনো গাড়ির মালিক বাকি না থাকে সেটা সংগ্রহে রাখার। এভাবে যাত্রা শুরু হলো এবং মাত্র এক দশকে যখন গাড়ি আরো বাড়তে লাগলো মিশেলিন গাইড ছড়িয়ে পড়লো পুরো ইওরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং এ দেশগুলোর চার পাশের সকল বড় শহরে। রটনা আছে জনপ্রিয় হবার শুরুর দিকে মিশেলিন গাইডে টাকার বিনিময়ে রেস্টুরেন্টের অন্তর্ভুক্তি হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে এ ব্যবস্থা একদম বাদ দেয়া হয়। ধীরে ধীরে দুই বিশ্বযুদ্ধের শেষে মিশেলিন গাইডটি আরো বেশি গোছানো হয় এবং এক পর্যায় তারা শুধু ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্টের রেটিং গাইডে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে।

কেমন হয় মিশেলিন স্টার রেটিং
১৯৫৫ সাল থেকে মিশেলিন তার স্টার রেটিং চালু করে। এ রেটিংয়ের ব্যাপারগুলো নাকি বেশ চটকদার। আমি খুঁজে যা পেলাম তা এমন, ‘এক তারকা মিশেলিন স্টার’ খুব ভালো রেস্টুরেন্ট এই তালিকায়!

‘দুই তারকা মিশেলিন স্টার’– অসাধারাণ রান্না, আপনি যত দূর থেকেই আসুন, পরিশ্রম সার্থক!
‘তিন তারকা মিশেলিন স্টার’ অবিস্মরণীয় রন্ধনশৈলী, এমন অভিজ্ঞতায় আপনার ব্যয়ের সার্থকতা!
এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ‘এক তারকা মিশেলিন স্টার’ হতে পারাই বেশ প্রসারের ব্যাপার। এই রেটিংয়ে নিয়োজিত থাকেন যারা, তারা নাকি ভোক্তা ছদ্মবেশে যায় রেস্টুরেন্টে এবং পুরো রেটিং খুব গোপনে করা হয়। রেটিংয়ে যে বিষয়গুলোকে তারা প্রাধান্য দেন তার সংক্ষিপ্ত রূপটি এমন: 
- খাবারের পরিবেশন রীতি কি জিভে জল আনার জন্যে যথেষ্ট?
- খাবারের পরিমাণ কি দাম অনুযায়ী যথাযথ?
- খাবারের গন্ধ আপনাকে মোহনীয় করেছে?
- খাবারে বসানো প্রতিটি কামড় আপনার হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে?
আমার কাছে পুরো ব্যাপারটিকে এক মনস্তাত্তিক প্রক্রিয়া মনে হয়েছে, যেখানে একজন খাবার খেয়ে বলতে পারেন যে, আসলেই মিশেলিন স্টার রেটিং খাবার খেলাম, এ এক তৃপ্তি এবং এভাবে তিনি খাবার বাদ দিয়ে রেটিংই খান।

হাল দুনিয়ার মিশেলিন রেটিং এর প্রভাব
খাবার এখন এক বিনোদনের নাম। এ সময় তাই খাবার নিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দাও প্রচুর। যে মিশেলিন গাইড একসময় বিনামূল্যে বিতরণ হয়েছে এখন তা দামি এক বই। শহর  ভেদে মিশেলিন গাইডের দাম ২০ ডলার থেকে ৪০ ডলারও হয়ে থাকে। ২০১৮-২০১৯ সালের তালিকায় মিশেলিন এক তারকা মানের রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ২২৯০টি, দুই তারকা মানের ৪১৪টি এবং তিন তারকা রেস্টুরেন্ট ১১৩টি। মিশেলিন স্টার শেফ হতে পারা যে কতো মর্যাদাপূর্ণ তা টের পাওয়া যায় যখন ২০০৩ সালে ফরাশি শেফ বার্নাড লইসু আত্মহত্যা করলেন যখন জানলেন তার রেস্টুরেন্ট মিশেলিন তিন তারকা থেকে দুই তারকা মানে অবনমন করেছে! এবং এ সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী শেফ গর্ডন রামসে-কেও নাকি হারাতে হয়েছিল মিশেলিন স্টার, যদিও তিনি তা আবার উদ্ধার করেন। আমাদের ভাগ্য ভালো যে মিশেলিন রেটিং এখনো উপমহাদেশে আসে নি। এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মিশেলিন স্টার রেস্টুরেন্ট টোকিও, জাপানে এবং সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অবশ্যই ফ্রান্সে কারণ সেখান থেকেই শুরু।

আমরাও রেটিং খাই
প্রযুক্তির এই যুগে আমরাও প্রতিনিয়ত রেটিং খাচ্ছি। শুধু ঢাকায় যদি দেখি অসংখ্য নামের রেস্টুরেন্ট। আগে আমাদের খাবারের জন্যে শহরে ভ্রমণের মতো বিলাসিতা ছিল না কিন্তু এখন নাকি শুধু এক রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে উত্তরা থেকে পুরান ঢাকা যাচ্ছি আমরা, আবার মিরপুর থেকে খিলগাঁও যাচ্ছি রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ নিতে। কীভাবে এটা ঘটালো ব্যবসায়ীরা? এই রেটিং কৌশলে আপনি না বুঝেই খেয়ে চলছেন অপরের রুচির খাবার। আসলে খাবার হওয়া উচিত ব্যক্তির রুচির ওপর নির্ভরশীল। ধরুন, এখন আমের সময়, কি দুর্দান্ত ঘ্রাণ আর স্বাদের আম চারদিকে, কিন্তু অনেকে আছেন আম খেতে পছন্দ করেন না, এখন আপনি হাড়িভাঙ্গা আমকে যতই পাঁচ তারকা রেটিং ফেলুন, যিনি আম খান না তার কাছে এটা মূল্যহীন। আমাদের খাবার ব্যবসায়ীরা এবং কিছু অতি উৎসাহী ভোজনবিলাসী এই রেটিং ব্যবস্থাকে উসকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু খাবারের রেটিং করার জন্যে এখন এজেন্সি হয়েছে যাদের কাজ টাকার বিনিময়ে হাইপ তোলা এবং এই হাইপের তালে মানুষ নিয়মিত প্রতারণার শিকার হয়ে যাচ্ছে। ধানমন্ডিতে এমন এক হাইপওয়ালা বিরিয়ানির দোকানে মানুষ নাকি লাইন ধরে বিরিয়ানি খাচ্ছে, আরে! বিয়ের দাওয়াতে কাচ্চি খেতে হবে দেখে আমরা অনেকে দাওয়াতে গিয়েও খাবার খাচ্ছি না!

ধরুন, আজ আপনাকে বাইরে খেতে হবে, আপনি খুঁজে এক রেস্টুরেন্টে বসলেন খাবারের ফরমাশ দেবেন এবং মনে মনে ভেবে ফেললেন যে একটু ভাত, সবজি, ডাল খেলাম। ওয়েটার আসতে আসতে একটু গুগল করলেন, দেখি, এখানকার ভালো খাবার আর কী আছে, আর পেয়ে গেলেন এক গাদা খাবারের ছবি, আগের খেয়ে যাওয়া ভোক্তাদের রেটিং, আরে, এদের খিচুড়ি দেখছি সবাই বলছে ‘ওসাম!’ খেয়েই দেখি, খেতে গেলেন ভাত সবজি, খেয়ে ফেললেন ‘বিফ আচারি খিচুড়ি’ নামের এক অতি সাধারণ মানের ‘ওসাম’ খাবার! আপনিও তৃপ্ত রেস্টুরেন্টেরও পোয়াবারো। আর এভাবেই আমরা রেটিং খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মিশেলিন ভাইরা যে পথ দেখিয়ে শুরু করেছেন তার ডিজিটাল রূপ আমাদের এখন মহামারী। নামে বেনামে রেস্টুরেন্ট চারদিকে এবং সবারই নাকি ডিজিটাল অস্তিত্ব আছে। বোঝা যায় সেটা যখন দেখি আমাদের এলাকার রহিম মামার চা দোকানেরও চার তারকা দেয়া বিজনেস প্রোফাইল আছে গুগল ম্যাপে এবং তিনি ভাবছেন আগামীতে পাঠাও ফুড ডেলিভারি দিয়ে স্পেশাল কড়া পাত্তির মিল্ক টি হোম ডেলিভারি দেবেন!


ক্যাটেগরিঃ লেখালেখি,


Tanvir