মু. মাহমুদ হোসেন এফসিএ দি ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি)-এর বর্তমান কাউন্সিল মেম্বার। এর আগে তিনি আইসিএবি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাহমুদ হোসেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে বেশি পরিচিত। টেলিভিশনে নিয়মিত ক্যাপিটাল মার্কেটের ওপর টক শোতে অংশগ্রহণ করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এখন তিনি নিজেও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে থাকেন। এসব টক শোতে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে এক্সপার্ট কথা বলে থাকেন। এর বাইরে ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে আছেন এমএমএইচ অ্যান্ড কোম্পানি, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস ফার্ম-এ। ডিরেক্টর হিসেবে আছেন ঢাকা ওয়াসা এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। একটা দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন নামকরা সব মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। এর মধ্যে ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার হিসেবে এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড, চিফ ফিনানশিয়াল অফিসার হিসেবে ডিএইচএল গ্লোবাল ফরওয়ার্ডিং, হেড অফ কর্পোরেট ফাইন্যান্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট হিসেবে রবি আজিয়াটা লিমিটেড ইত্যাদি। সম্প্রতি বিপরীত স্রোতের পক্ষ থেকে সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
এবং চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট ও ট্যাক্স কনসালটেন্ট জসীম উদ্দিন রাসেল তার সাথে কথা বলেন। আলাপচারিতায় দেশের পুঁজি বাজার নিয়ে উঠে এসেছে নানা দিক। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
বিপরীত স্রোত: করোনাভাইরাসের প্রভাবে দীর্ঘ দিন শেয়ার লেনদেন বন্ধ থাকার পর পুনরায় শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে শেয়ার মূল্য বাড়ছে। আমরা শুনেছি, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। কিন্তু তাহলে শেয়ার মূল্য বাড়ছে কেন? টাকা কোথা থেকে আসছে?
মাহমুদ হোসেন: আপনি ঠিকই বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, যাদের আয়ে প্রভাব পড়েছে তাদের টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ হয়েছে কিনা। তবে যাদের আয়ে প্রভাব পড়েছে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু তাদের বিনিয়োগ মোট শেয়ার বাজারের তুলনায় বেশি না। তাই প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা কম। যারা প্রকৃতপক্ষেই বিনিয়োগকারী তাদের আয়ের ওপর তেমন প্রভাব পড়েনি। তাই লম্বা সময় শেয়ার বাজার বন্ধ থাকার পর আবার যখন লেনদেন শুরু হয়েছে তাখন শেয়ার মূল্য বাড়তে শুরু করেছে।
বিপরীত স্রোত: যদি তাই হয়, তাহলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের তো আগেও টাকা ছিল। তাহলে আগে কেন বাড়েনি? তখনও তো শেয়ার মূল্য ক্রমাগত নিম্নমুখী ছিল।
মাহমুদ হোসেন: ভালো কোম্পানির শেয়ার মূল্যও কমেছে যেটা হওয়ার কথা ছিল না। এটা এমন না যে ভালো কোম্পানিগুলোর পারফরমেন্স খারাপ ছিল। আসলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারমুখী ছিলেন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নিজেদের গুঁটিয়ে নিয়েছিলেন। তাদের একটি ভয় ছিল, তারা যদি তখন নতুন করে বিনিয়োগ করে তাহলে তারা টাকা হারাবে। এবং এটা কোনো কারণ ছাড়াই হচ্ছিল।
বিপরীত স্রোত: এমন হওয়ার কারণ কী ছিল?
মাহমুদ হোসেন: এর পেছনে কারণ ছিল, শেয়ার বাজারে নৈরাচার, বিচারহীনতা, বাজার ব্যবস্থাপনায় অরাজগতা। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরা ধরে নিয়েছিলেন, মার্কেটে টাকা নিয়ে আসলে নাই হয়ে যাবে।
বিপরীত স্রোত: তাহলে এখন উপায় কী?
মাহমুদ হোসেন: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নতুন করে গঠন করা হয়েছে। নতুন কমিটিতে যারা আছেন তাদের সবারই অতীত রেকর্ড ভালো। ইমেজ ভালো। তারা আসার পরে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তার প্রতিটিই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে গিয়েছে। এগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পজেটিভ সিগনাল দিয়েছে। তাই এখন আবার বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হচ্ছে। যার প্রভাবই হয়তো এখন দেখা যাচ্ছে।
বিপরীত স্রোত: যদি আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হয় এবং নতুন কমিটি ভালোভাবে কাজ করে তারপরেও কি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজারে আসাটা লাভজনক? শেয়ার বাজার থেকে যে রিটার্ন পায় অন্যান্য বিনিয়োগের তুলনায় তা কি বেশি? যদি বেশি না হয় তাহলে এতো ঝুঁকি নিয়ে কেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবে?
মাহমুদ হোসেন: সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্যাংকে সুদের হার ৬-৯ হয়েছে। অতএব, সেখানেও কিন্তু রিটার্ন কমে গেছে। আর এখন শেয়ার বাজার যেহেতু পজেটিভ সিগনাল দিচ্ছে, শেয়ার মূল্য বাড়ছে তাই এখন থেকে রিটার্নের পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যাচ্ছে।
বিপরীত স্রোত: শেয়ার বাজার থেকে রিটার্ন বাড়বে বা শেয়ার মূল্য বাড়ছে। কিন্তু আমরা যখনই শেয়ার বাজার নিয়ে কথা বলি তখনই ঘুরে ফিরে একটি কথা ফিরে আসে, ১৯৯৬ এবং ২০১০। এখন প্রশ্ন হলো, শেয়ার বাজার আবার বেড়ে কখন যে নতুন আরকটা এমন দুর্ঘটনা হবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? আর কেন এমন হয়? অন্য দেশেও কি এমন হয়?
মাহমুদ হোসেন: পৃথিবীর সবখানেই শেয়ার ফিক্সিং বা স্কেম হয়ে থাকে। কিন্তু এটার পরিমাণ খুবই কম। আরেকটা বড় যে বিষয় সেখানে হয়, শেয়ার বাজার ধসের কারণে খুবই অল্প বিনিয়োগকারী ধরুন ১-২% ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এবং তাদের ওখানে বিচার আছে। কারণ খুঁজে বের করে তার প্রতিকার হয়। বিপরীতে, আমাদের এখানে উলটো। এটাই পার্থক্য। এ থেকে উত্তরণের উপায় হলো, সুশাসন, আন্তরিকতা, রেগুলেটরি বডি শক্তিশালী করা, বিচার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। আইন আছে, আর বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব যদি পালন করা যায় তাহলে এমন ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। আর হলেও বিচারের আওতায় আনা যাবে।
তবে এর সাথে বিনিয়োগকারীদেরকেও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধরুন, আপনি অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যান। আবার বাড়ি তৈরি করতে গেলে ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যান। তাহলে আপনি যখন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে যাবেন, তখন আপনাকে এ বিষয়ে এক্সপার্ট এর কাছে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে, বিনিয়োগকারী সরাসরি নিজে লেনদেন করেন। এটা দেশের বাইরে দেখা যায় না। বিদেশে আলাদা ইনভেস্টমেন্ট হাউজ রয়েছে। তারা সেসব হাউজে এক্সপার্টদের মাধ্যমে শেয়ার কেনা-বেচা করেন। আপনাকে বুঝতে হবে, এটা আপনার কষ্টের টাকা। আপনাকে জেনে বুঝে ভালো জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলে ক্ষতি হলেও কম হবে।
বিপরীত স্রোত: বাংলাদেশে কেন এমন প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেনি?
মাহমুদ হোসেন: বাংলাদেশে আসলে শেয়ার বাজার এখনো সঠিকভাবে গড়ে উঠেনি। আমাদের এখানে কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন, দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ আসার কথা ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে। অথচ, সেটা এখানে হচ্ছে না। বিপরীতে, দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ আসছে মানি মার্কেট অর্থাৎ ব্যাংক থেকে। এটা হওয়ার কথা না। ব্যাংক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করে থাকে। এই টাকাগুলো তারা একত্রিত করে দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্পে লোন দিয়ে থাকে। যার ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ে। যখন কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য ক্যাপিটাল মার্কেটে আসবে তখন শেয়ার বাজার শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়বে না। যদিও তারল্য সংকটের আরো কারণ রয়েছে। আবার ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে টাকা তুলতে কোম্পানিগুলোর খরচ বেশি পড়ে অন্যান্য দেশের তুলনায়। অনুমোদন পেতে সময় বেশি লাগে। অথচ ব্যাংকে গেলে সহজেই লোন পেয়ে যাচ্ছে। এগুলো শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করছে।
বিপরীত স্রোত: ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
মাহমুদ হোসেন: এক্ষেত্রে প্রথমেই বলবো, আপনি জেনে বুঝে শেয়ার কিনুন। আপনি যখন অন্ধকারে পা ফেলেন তখনও কিন্তু আপনি চোখ খোলা রেখে ফেলেন। কারণ, যদি কিছু দেখা যায়। সেক্ষেত্রে যখন আপনার কষ্টার্জিত অর্থ আপনি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবেন তখনও আপনাকে বুঝে শুনে এবং দেখে বিনিয়োগ করতে হবে। অরেক জনে বলেছে, ওই কোম্পানির শেয়ার মূল্য বাড়বে, তাই আপনি কিনলেন। আবার কেউ হয়তো আপনাকে বলেছে, ওই কোম্পানির শেয়ার মূল্য কমবে, তাই আপনি বিক্রি করে দিয়েছেন। এটা করা থেকে বিরত থাকুন। আগে নিজে ভাবুন। কেন মূল্য বাড়বে বা কমবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিন। আর আরেকটা বিষয় বলবো, আপনি ফান্ডামেন্টাল শেয়ার কিনুন। যদিও ক্ষতিগ্রস্ত হন, কম হবেন।
সবচেয়ে বড় যে ভুল অনেকে করে সেটা হলো, দৈনন্দিন কেনা-বেচা করার চিন্তা। এখান থেকে নিয়মিত কিছু কেনা-বেচা করে অর্থ কামিয়ে নেয়া। এটা চিন্তা করা ভুল। কারণ, শেয়ার বাজার হলো দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। যখন আপনি এই চিন্তা করে বিনিয়োগ করবেন তখন যদি শেয়ার মূল্য কোনো কারণে কমেও যায় তাহলে কিন্তু আপনি বিক্রি করবেন না। কারণ, এখান থেকে আপনার স্বল্পমেয়াদে টাকা আয় করার চিন্তা নেই। তাহলেই দেখবেন, দীর্ঘমেয়াদে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত কম হচ্ছেন। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছেন।
ছবি: জসীম উদ্দিন রাসেল
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত