English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২০-০৮-১৩ ০৮:৪৪:৪৪
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৫ ০৯:০০:৫৪


সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ড লেনদেন: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ড লেনদেন: সম্ভাবনার  নতুন দিগন্ত


মেসবাহ উদ্দিন খান মিঠু


সম্প্রতি বাংলাদেশ পুঁজিবাজারে বন্ড লেনদেন করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে পূঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিভিন্ন  ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইস্যুকৃত পারপিচুয়াল বন্ড বা চিরস্থায়ী বন্ড সমূহ উভয় শেয়ারবাজারে কেনাবেচার করা যাবে

 

আমাদের পুঁজিবাজারে শুধুমাত্র Equity প্রোডাক্ট লেনদেন হয়। দুইএকটি বন্ড নামকাওাস্থে তালিকাভুক্ত হয়েছে কিন্তু জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। পূঁজিবাজার প্রতিষ্ঠার পরে দীর্ঘ ৪৫ টি বছর পার হয়ে গেলেও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আধুনিক পূঁজিবাজার গড়ার লক্ষ্যে নতুন নতুন প্রোডাক্ট, যুগোপযোগী লেনদেন প্ল্যাটফরম চালু করতে না পারাটা নিঃসন্দেহ চরম ব্যর্থতার।১৭ কোটি মানুষের দেশে ২৫ লাখ BO Account  যার অধিকাংশ আবার একই বাক্তির একাধিক ব্রোকার হাউসে নিবন্ধিত। হতাশার কথা আজ লিখবো না ! ভালো উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে ফাইনান্সের একজন ছাত্র হিসাবে নতুন ফাইনান্সিয়াল প্রোডাক্টটা নিয়ে কাজ করার আনন্দে আজ লিখতে বসেছি। বন্ড লেনদেন আইন বাস্তবায়ন হলে পণ্য বৈচিত্র্য (Product diversify) সংযোজিত হবে দেশে বিনিয়োগের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মক্ত হবে। কীভাবে তা বলছি :

 

পারপিচুয়াল বন্ড কী

পারপিচুয়াল শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ চিরস্থায়ী, শাশ্বত, অনন্ত আর এর বাংলা প্রায়োগিক শব্দ বেমায়াদী। অর্থাৎ বন্ডের নির্দিষ্ট  কোনো মেয়াদ নেই। ফিক্সড ডিপজিট/ FDR বা সঞ্চয় পত্র মেয়াদান্তে ভাঙাতে হয় বা রিনিউ করতে হয়, এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারিকে ওই কাজটি করার আর প্রয়োজন হবে না। 

 

বাৎসরিক আয়

রেট অফ রিটার্ন হিসাব করলে বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ডিপজিট রেটের তুলনায় বন্ড-এর রিটার্ন অনেক বেশি হবে। ফিক্সড ডিপজিট যেমন ঝুঁকিমুক্ত বা সীমিত ঝুঁকি -ঠিক তেমনি বন্ডে বিনিয়োগ তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্ত রিটার্ন (Low risk return) এবং অধিক হারে। বন্ডের স্বকীয়তার জন্যই FDR-এর চাইতে সুদ/ মুনাফার এই হেরফের। 

 

কারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন

সুদ/ মুনাফার হার বাজারের প্রচলিত হারের চেয়ে বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ থাকবে। তদুপরি যারা ব্যাংকে FDR  করে বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তারা তাদের পছেন্দের ব্যাংকেই বিনিয়োগ করবেন শুধু ধরনটা পরিবর্তন হয়ে FDR এর স্থলে বন্ডে হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, একজন ব্যক্তি ডাচবাংলা ব্যাংকে % সুদে এক বছরের জন্য লক্ষ টাকার একটা FDR করলেন, তিনি ইচ্ছা করলে ওই একই ব্যাংকের বন্ড কিনলে তাঁর রিটার্ন হবে ১১ -১৪ % সিম্পল  প্রবাসী, Retaired ব্যক্তিগণ, গৃহস্থালি সঞ্চয় কিছু স্মার্ট মানি এই বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ করবেই !

 

FDR রেট থেকে বন্ডের সুদ/ মুনাফার হার বেশি হবে কেন

এজাতীয় পারপিচুয়াল বন্ড টিয়ার ক্যাপিটাল (বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যসেল পরিপালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের Equity হিসাবে পরিগণিত হবে) হিসাবে চিহ্নিত হবে। Cost of Capital সব সময়ই মূল্যবান/Costly এবং তা লভ্যাংশ হিসাবে পরিগণিত হবে তাই বন্ডের রেট অফ রিটার্ন সবসময় বেশি হবে। 

 

পারপিচুয়াল বন্ডে বর্তমানে বিনিয়োগকারী কারা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা 

বর্তমানে পারপিচুয়াল বন্ডে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এবং উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি (High net worth investor ) বিনিয়োগ করে থাকেন। বর্তমানে প্রতিটি বন্ডের ভ্যলু দশ লক্ষ টাকা যা ছোট বিনিয়োগকারীগণের জন্য কঠিন তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসিচাচ্ছে এর মূল্যমান কমিয়ে এনে পাঁচ হাজার টাকা পার ইউনিট করার। তাহলে এর তারল্য অনেক বাড়বে এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে এটি সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসবে।  

 

 

কেন বন্ড ইস্যু করা হয় এবং এর উপযোগ

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলতে মূলধনের ঘাটতি (Shortfall) দেখা দিয়েছে। সাধারণত NPL (Non Performing Loan ) বা কুঋণ বেড়ে গেলে তার প্রভিসনিং করার কারণে মূলধনে ঘাটতি দেখা দেয়। মূলধন বাড়ানোর সহজ মাধ্যম হলো বোনাস, রাইট ইসু করার দ্বারা। যেহেতু তা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট কম্পানির আর্থিক সক্ষমতা এর সাথে জড়িত তাই বন্ড ইসু করার মাধ্যমে ওই মূলধন ঘাটতি পূরণ করা যায়। ছাড়াও ব্যাংক সমুহের ব্যবসা সম্প্রসারণের কারণে ক্যাপিটাল বড় করার প্রয়োজন। আরেকটা সুবিধা হচ্ছে ক্যাপিটাল হিসাবে চিহ্নিত হবে কিন্তু ক্যাপিটাল ডাইলুসান হবে না বা শেয়ারের সংখ্যা বাড়বে না। যা উদ্যোক্তা শেয়ার হোল্ডার উভয়ের জন্য ভালো। তাই ব্যাংকগুলো দ্রুততম সময়ে পারপিচুয়াল বন্ড ছেড়ে ঘাটতি পূরণ করাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। 

 

Equity market Vs Debt market 

এটি সম্পূর্ণরূপে বিনিয়োগকারীগণের আর্থিক লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে। যদি তারা বিশাল রিটার্ন আশা করেন এবং ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকেন তবে একটি ইক্যুইটি মার্কেট তাদের জন্য দুর্দান্ত বিকল্প। যেখানে ক্যাপিটাল গেইন ডিভিডেন্ড ইনকাম দুইভাবে লাভবান হওয়া যায়। অন্যদিকে যে সমস্ত বিনিয়োগকারী অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে মূলধনটি সংরক্ষণ করতে পছন্দ করেন তারা Debt / বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগকে পছন্দ করেন। একজন পোর্টফোলিও ম্যানেজার হিসাবে আমাদের, সর্বদা পরামর্শ, বিনিয়োগের পূর্বে আপনার লক্ষ্যটি আগে ঠিক করুন

 

পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা

উভয় বিনিয়োগ instrument থাকার ফলে দুইয়ের সংমিশ্রণে অত্যন্ত চমৎকার পত্রকোষ ব্যবস্থাপনা (Portfolio Management) সম্ভব। বন্ড সমুহের সুদ/ মুনাফা বণ্টন হওয়ার পর তা শেয়ারে বিনিয়োগ করে একই ফান্ডকে একাধিক ম্যনুভারিং করা যায়। 

 

বন্ড বিনিয়োগ তারল্য

FDR বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ মেয়াদান্তের পূর্বে ভাঙ্গালে নির্দিষ্ট হারের চেয়ে কম রিটার্ন পাওয়া যায় এবং পুরো টাকাটা ভাঙ্গাতে হয় যদিও প্রয়োজন ছিল হয়তো আংশিক।বন্ড বিনিয়োগ প্রয়োজন মাফিক যে কোনো সময় বিক্রি করা যায় এবং রেট অফ রিটার্নের হেরফের হয় না। 

 

ইসলামী বন্ড

ইসলামী ব্যাংকগুলো শারিয়া কমপ্লায়েন্স ঠিক রেখে বন্ড ছাড়বে। যারা ইসলামী ব্যাংকসমুহে মুনাফা ভিত্তিক FDR রাখেন তাঁরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। 

 

সুদের হার বাড়ার সাথে সাথে বন্ডের দাম হ্রাস পায় যেহেতু সুদের হার এবং বন্ডের দামের মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। বন্ডের দাম এবং স্টকগুলি সাধারণত একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়। ক্রমহ্রাসমান সুদের হার বন্ডের দাম বাড়ায়। 

 

বর্তমানে DSE তে  ইসলামী ব্যাংকের IBBL মুদারাবা বন্ড লেনদেন হচ্ছে। ২০১৮ সালে এর রেট অফ রিটার্ন .০২% সম্প্রতি সিটি, যমুনা, ওয়ান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪০০ কোটি করে মোট  ১৬০০ কোটি টাকার পারপিচুয়াল বন্ডের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এইসব instrument এর সুদের হার সর্বনিম্ন ১১% এবং সর্বোচ্চ ১৪% পর্যন্ত যেতে পারে ( ব্যাংক সমূহের ডিপোজিটের সাথে স্প্রেড যোগ করে)! এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাংক বন্ড ছেড়ে ক্যাপিটাল রিকয়ারমেণ্ট ঠিক করবে। ধারণা করা হচ্ছে আরো অতিরিক্ত ১২,০০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু হতে পারে। সুতরাং নতুন বিনিয়োগের জন্য বৃহৎ এক Fixed Income Secured Market তৈরি হতে যাচ্ছে। 

 

পরিশেষে একটা আশাবাদ রেখে শেষ করবো। নতুন এই বিনিয়োগ সম্ভাবনা আমাদের পূঁজিবাজারকে অনেক গতিশীল করবে বলে আমি দারুণ আশাবাদী। বিনিয়োগ করার জন্য অপশন থাকবে। স্টক প্রাইস কমতে থাকলে ফিক্সড ইনকাম প্রোডাক্ট- Swap করার সুযোগ তৈরি হবে।মজার ব্যপার হলো উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ পূঁজিবাজারে থেকে গেল। স্টক থেকে বন্ডে গেল কিন্তু FDR আকারে ব্যাংকে আর গেল না। সচেতন বিনিয়োগকারি যুক্তসঙ্গত রিটার্ন সাথে সাথে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারবেন। ভবিষ্যৎ বলে দেবে আমরা আসলে কী চাই

 

 

 

লেখক পরিচিতি


মেসবাহ উদ্দিন খান মিঠু

সিইও 

শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেড

 

 


ক্যাটেগরিঃ অর্থনীতি,


আরো পড়ুন