English
ঢাকা, শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৭-২৩ ০৬:৫২:২১
আপডেটঃ ২০২৫-০৫-০৯ ২০:০৭:৫৪


শেয়ারবাজার: যতো কর সুবিধা রয়েছে

শেয়ারবাজার: যতো কর সুবিধা রয়েছে

জসীম উদ্দিন রাসেল 


অপ্রদর্শিত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে এবারের অর্থ আইন ২০২০-এ। তবে এর জন্য দুইটি শর্ত মানতে হবে।

এক, শেয়ারবাজারে উক্ত অর্থ বিনিয়োগের ৩০ দিনের মধ্যে উক্ত বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর ১০% কর দিতে হবে। এবং

দুই, উক্ত বিনিয়োগকৃত অর্থ বিনিয়োগের দিন হতে এক বছর পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। প্রথমে, অর্থ বিল ২০২০- তিন বছর এর শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল এই সময় কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্নমহল থেকে দাবি উঠে। তারপরে এক বছরে নামিয়ে আনা হয়।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে দীর্ঘ সময় শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকার পর কিছুদিন আগে আবার লেনদেন শুরু হয়েছে। তবে তেমন উন্নতি আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

সব বিনিয়োগেই ঝুঁকি থাকে। প্রতিটি বিনিয়োগকারী ঝুঁকির বিপরীতে কেমন লাভ হবে তা বিবেচনা করে বিনিয়োগ করেন। ঝুঁকির পরিমাণ বেশি হলে বেশি লাভের প্রত্যাশা করেন। যেমন, শেয়ারবাজার সব সময়ই সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে এফডিআর থেকে বেশি ঝুঁকিপ্রবণ। তাই স্বভাবতই বিনিয়োগকারীরা এখান থেকে তুলনামূলক বেশি লাভ দাবি করবেন। কিন্তু বাংলাদেশে এটা অনুপস্থিত।

করোনাভাইরাসের আগে খবর বেরিয়েছিল, শেয়ারবাজার গত নয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। একের পর এক শেয়ারবাজার অস্বভাবিক ধ্বসের খবর তখন বের হয়েছিল। এমন সময় শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করতে প্রথম ছয়টি দিক নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে আসেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানায়। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকা তহবিল গঠনের সুযোগ, স্বল্প সুদে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদান, সরকারি পাঁচ ব্যাংককে শেয়ারবাজারে নিয়ে আসা ইত্যাদি

তখন ব্যক্তি এবং উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে স্কয়ারের চার উদ্যোক্তার শেয়ার কেনা প্রশংসিত হয়েছিল এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) শেয়ারবাজার সংস্কার করতে ১৭০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার কথা  শোনা গিয়েছিল। এর আগে ২০১৫ সালে এডিবি ৮০ মিলিয়ন ডালার দিয়েছিল।


গত কয়েক বছর ধরেই শেয়ারবাজারের অবস্থা উন্নতি করার জন্য সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা নগদ প্রত্যাশা করেন। বিনিয়োগকারীরা যাতে কোম্পানির কাছ থেকে নগদ লভ্যাংশ পায় সেজন্য কোম্পানির উপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে। কর বিনিয়োগকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে থাকে। কারণ কর সরাসরি মানুষের আয়ের উপর ভর করে। যেমন, অনেকেই বলছেন সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া পিছনে উৎসে কর বৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে। সেটা বিবেচনায় নিয়েই প্রতি বছর বাজেটে শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

গত বাজেটে স্টক ডিভিডেন্ড-এর কমপক্ষে সমপরিমাণ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার উপর জোর দেয়া হয়েছে। যদি স্টক লভ্যাংশের পরিমাণ নগদ লভ্যাংশের চেয়ে বেশি হয় তাহলে পুরোটার উপরেই ১০ শতাংশ হারে কোম্পানিকে কর দিতে হবে এবং এই কর তার রিটার্ন দাখিলের আগেই দিতে হবে। যেমন, কোনো কোম্পানি যদি তার শেয়ারহোল্ডারদেরকে ছয় লাখ টাকা স্টক ডিভিডেন্ড এবং চার লাখ টাকা নগদ লভ্যাংশ দেয় তাহলে স্টক ডিভিডেন্ডের পুরো ছয় লাখ টাকার উপরেই কোম্পানিকে ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

আইনে আছে কিন্তু কোম্পানি যদি কোনো লভ্যাংশই প্রদান না করে তাহলে শেয়ারহোল্ডাররা সুবিধা পাবেন না। এটা যাতে না হয় সেজন্য গত বাজেটে আরেকটা নিয়ম করেছে। প্রতি বছর কর পরবর্তী কোম্পানির যে মুনাফা হবে তার সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ কোম্পানিতে রাখতে পারবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে বিতরণ করতে হবে। যদি তা না করে তাহলে এখানেও যতো টাকা কোম্পানিতে রাখা হয়েছে তার পুরোটার উপরেই ১০ শতাংশ হারে কোম্পানিকে কর দিতে হবে। এই করও কোম্পানিকে তার রিটার্ন দাখিলের পূর্বেই জমা দিতে হবে।

উপরের আইনগুলো করা হয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে করের চাপ বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজার মুখী করতে। শেয়ারবাজারে একজন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীও যাতে সরাসরি কর সুবিধা পান সে ব্যবস্থাও রয়েছে। শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ঐ বিনিয়োগকৃত টাকার উপর একটি নির্দিষ্ট হারে কর রেয়াত পাওয়া যায়। কর রেয়াত একজন করদাতার করদায় বহুলাংশে কমায়।

আবার বিনিয়োগকারী যে শেয়ার কিনেছেন তা থেকে যখন নগদ লভ্যাংশ পাবেন তখন তা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত করা হয়েছে। তার আগে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত ছিল। কোনো সময় যদি বিনিয়োগকারীর মনে হয় তিনি শেয়ার আর রাখতে চাচ্ছেন না, বিক্রি করে দেবেন এবং তা থেকে যদি লাভ করেন তাহলে তাও সম্পূর্ণ করমুক্ত করা হয়েছে।

যে কোনো দেশের উন্নয়নের পেছনে বিদেশি বিনিয়োগের অবদান থাকে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পিছনে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কর সুবিধা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে আশার কথাও আমরা প্রায়ই শুনি। তাদেরকেও বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নিয়ে আসতে কিছু কর সুবিধা দেয়া হয়েছে।

তবে শেয়ার বিক্রি থেকে প্রাপ্ত লাভ একজন বাংলাদেশির কাছে করমুক্ত হলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীকে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অবশ্য যে সব দেশের সাথে দ্বৈত কর চুক্তি রয়েছে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আয়কর প্রদেয় নয় বা হ্রাসকৃত হারে আয়কর প্রদানের সুবিধা রয়েছে। গত অর্থ আইন ২০১৯-এ আবেদনের ৩০ দিনের মধ্যে সনদ দেয়ার বিধান করা হয়েছে। আইনে থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে এই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না এবং এর ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে প্রতি বিক্রয় থেকে যদি লাভ হয় তাহলে তার উপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হয়। কিন্তু যদি কোনো বিক্রয় থেকে ক্ষতি হয় তাহলে তা লাভের সাথে তিনি সমন্বয় করতে পারেন না। এতে করে তারা ক্ষতির মুখে পড়েন এবং এ নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে।

আইনে কোনো সুবিধা দেওয়া হলে তা যতো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় তা থেকে ততো দ্রুত ফল ভোগ করা যায়। আইনে যেহেতু এই সুবিধা দেওয়াই হয়েছে তাই বিদেশি বিনিয়োগকারিদের এই সুবিধা দ্রুত দেওয়াই ভালো কারণ তারা এটা দেখেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসেছেন।

এতোসব কর সুবিধা দেওয়ার পরও শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরে আসেনি।

তবে দেশে-বিদেশে সব জায়গাতেই বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারের পতন হয়েছে। ২০০৫-০৮ সময়ে আমেরিকাতে হাউজিং এবং ক্রেডিট মার্কেটের উত্থান হয়েই চলছিল। আসলে তখন আমেরিকাতে হাউজিং মার্কেটের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। এই খাত থেকে রিটার্ন খুবই কম আসছিল

ব্যাংকগুলো মনে করেছিল হাউজিং মার্কেটের কখনোই পতন হবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ধারণা ভুল প্রমানিত হয় ২০০৮ সালে এবং এর ফলে ব্যাংকগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়ে। তখন ব্যাংকগুলোর সাথে আমেরিকাতে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীও পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।


বাংলাদেশের মানুষ এই ধরনের অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে। ১৯৯৬ সালের পর ২০১০ সালে কেন সাধারন মানুষ আবার শেয়ারবাজারে টাকা বিনিয়োগ করলেন? তারাও কি মনে করেছিলেন যে শেয়ারের দাম কেবল দিনের পর দিন বাড়তেই থাকবে? একটা কোম্পানির শেয়ারের দাম কতো বাড়বে? কেনই বা একটা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়বে?

দুইবারই শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তারা হারান তাদের তিল তিল করে জমানো টাকা, বাবার পেনশনের টাকা, মার গহনা বিক্রির টাকা, বাবার জমি বিক্রির টাকা, অন্যের কাছ থেকে ধার করা টাকা। টাকা হারিয়ে তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। পরিবারগুলো সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশে ব্যাংক সুদের হার কমে নয়-ছয় বাস্তবায়ন হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিন্মমুখী। এই সময়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়গের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের উপর আস্থা ফিরে পাচ্ছেন না। তারা ২০১০ সালের পর শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আবার কবে তাদের আস্থা ফিরে আসবে তা বলা যাচ্ছে না। এসবই আমরা মিডিয়ার রিপোর্টে পড়ে থাকি।

তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পূর্বে সব সময়ই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। শেয়ারের মূল্য হিসেব করা খুবই জটিল। একটা কোম্পানির আর্থিক বিবরণী, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ইত্যাদি শেয়ার মূল্য নির্ধারণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জটিল সূত্র ব্যবহার করে শেয়ার মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। তবে এই হিসাব পদ্ধতি যে সব সময় সঠিক হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেয়ার মূল্য যে কোনো সময় কমতে বা বাড়তে পারে।

 



ক্যাটেগরিঃ অর্থনীতি,


জসীম উদ্দিন রাসেল

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও লিড ট্যাক্স কনসালট্যান্ট, ট্যাক্সপার্ট



আরো পড়ুন