রুবাইয়াত হাসান সিরাজ
হাইওয়ের পাশে সিলেট ফেরত বাসগুলো জড়ো হয়েছে হাইওয়ে মোটেলে। ভিড় বেশ। রাত ২টা। রতন মল্লিক বাস
থেকে নেমেছেন। ঘুম ঘুম চোখে কুয়াশার চাদরে আবৃত হোটেলটাকে খুব অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। রতন ভেবে পাচ্ছেন না
কী করবেন? হাল্কা হবার দরকার, আবার বাসে রেখে আসা হাত ব্যাগের কথাও ভোলা যাচ্ছে না।
বাসের যাত্রীরা যে যার প্রয়োজনে দেন দরবারে ব্যস্ত। ঘুমিয়ে থাকা বাস জেগে উঠল আচমকাই! সবার কী যেন
হয়! রাতের খাবার খেয়ে উঠুক আর নাই উঠুক রাত ২টার হোটেলে খাবারের আনন্দ থেকে বঞ্ছিত হতে চায় না
অধিকাংশই। এক ধরনের কৌতূহল নিয়েই উপভোগ করছেন রতন মল্লিক।
প্রায় ১৫টি বাস আর গাড়ির সমাহার। কত উদ্দেশ্যে কত মানুষ রওনা হয়েছে! কারো গন্তব্য ঢাকা শহর। কেউ বা
সিলেট। কারো ঘরে ফেরা। কারো উদ্দেশ্য জীবিকা। চোখ চেয়ে থাকে মানুষগুলোর দিকে। এই রাস্তা, এই মোটেল
নিত্য-নতুন সময়ের সাক্ষী হয়ে চুপটি করে বসে থাকে। মানুষ দেখে, বাহন দেখে আর দেখে মানুষের নিরন্তর ছুটে
চলা। রতনের খুব মনে হতে থাকে ম্যাক্স হেরমান এর ‘Desiderata’ –
Go placidly amid the noise
and haste,
And remember what peace
There may be in silence.
As far as possible,
without surrender,
Be on good terms with all
persons.
Speak your truth quietly
and clearly;
And listen to others,
Even the dull and the
ignorant;
They too have their story.
মনে মনে আবৃত্তি করতে থাকেন তিনি। সেই কবে পড়েছিলেন ১৯২৭ সালে লেখা এই কবিতা! এখনো সজীব, এখনো
প্রাসঙ্গিক। জানালার পাশে বসতে খুব ভালো বোধ করেন রতন। পাশে বসা তরুণের সাথে কথা বলতেও খুব
আনন্দ পাচ্ছিলেন তিনি। তরুণ থাকে সিলেটের আম্বরখানায়। রাজধানীর এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
সে। এই করোনাকালে কেন অনলাইন ক্লাস ফেলে ঢাকা যাবার তাড়না, জিজ্ঞেস করতেই অকপট বলে উঠে সে,
‘দাদা আর কতদিন ঘরে বসে থাকবো বলেন তো?’
সে কথাও বড় সত্য। কিশোর বলতে থাকে, ‘ লকডাউন-নকডাউন সব থোরাই বিবেচনায় রেখে মানুষ কেন বেরিয়ে পড়ছে? দেখুন দাদা, সমুদ্র সৈকতে যেতে তো কোন বাঁধা নেই তাহলে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি কেন বন্ধ রাখতে হবে? সবাই মিলে সেদিন শহরের পাঁচ ভাইয়ের হোটেলে খেয়ে এলাম, কই কেউতো কোন বাঁধা দিলনা। অথচ লেখাপড়াতেই সব শর্ত! এভাবে কি পড়াশোনা হয়? বাংলাদেশে এখনো যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে নিত্য চিন্তার যোগাড়, সেখানে ভার্চুয়াল ক্লাস কতটা যৌক্তিক? কতজন এই সেবায় যুক্ত হতে পারে? আমরা বুঝতে পারছি না কী করবো এখন।’
রতন মল্লিককে খানিক চিন্তিত মনে হল। তরুণের আবেগ-উৎকন্ঠা বুঝতে পেরেই তিনি বললেন, ‘ভাইটি
আপনার কথা সত্য বটে কিন্তু মানুষের কথা তো ভাবতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে উপায় আছে! একথাও
সত্য, মানুষ এখন বিভ্রান্ত। Social
distancing না বলে যে physical distancing বলা দরকার ছিল, এতো
খোদ WHO সংশয়ী হয়ে হয়রানি করলো মানুষকে। Global Knowledge
Index 2020 এ বাংলাদেশকে অনেক
নিচের পয়েন্ট পেতে হয় কারণ আমরা শিক্ষা, প্রযুক্তিগত কাঠামো, উন্নয়ন আর আবিস্কার সব মিলিয়ে
এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আর অনলাইন শিক্ষা, সে এখনো পোক্ত হতে সময় নিবে খানিকটা। কিন্তু প্রতিটি
বাঁধা-পরাজয় যে নতুন সকালের শুরু তা বুঝতে প্রায়ই সময় লাগে মানুষের-জাতির-সমাজের। কথা হল আমাদের কী করতে হবে এখন?’
হঠাৎ বাসের হর্ণে সম্বিৎ ফিরে পেলেন রতন মল্লিক। তরুণের সাথে আসতে আসতে কথোপকথনের আলোচনা
কানে বাজতে থাকে। আবারো মানুষের কোলাহলে তাকিয়ে থাকেন তিনি। ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতি শেষ হবার কথা মনে করিয়ে দিল ড্রাইভার।
রতন সাহেবের মনে হল, জীবন বিভিন্ন আঙ্গিকে মানুষকে মনে করিয়ে দেয়,‘আরেকবার চিন্তা করার অবকাশ দরকার তোমার।‘‘Speak your truth quietly and clearly’’ সত্য আজকের যুগেও খুব কৌশলী।
কুয়াশার আড়ালে চাঁদ মামা উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে ঠিক কিন্তু ধরা দিচ্ছে না। রতন মল্লিকের চোখ আটকে গেল চাঁদের
কলঙ্কে।কী সুন্দর তুমি তবু তোমার কলঙ্ক? তোমার চেহারাতেও দাগ! তাহলে সব কিছু নিখুঁত হবে ভাবি কী
করে? মানুষের চিন্তায় যে নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতা, তাহলে চাঁদের কি অনেক দুঃখ একইভাবে প্রতীয়মান হয়?
আজকে আমাদের শিক্ষা-মূল্যবোধের বাঁধভাঙ্গা অবক্ষয়, অমানবিকতার জলোচ্ছাস আর মিথ্যেকে সত্য করে
নেবার আকন্ঠ হঠকারিতা, সত্য কেন তা আর জানান দেয় না? কেন চাঁদ তার যা আছে তা নিয়ে দীপ্যমান আর
আমার সমাজে যা নেই তা নিয়ে নিত্য মরে যাবার ধিক্কার; রতন মল্লিক হঠাৎ বুঝতে পারেন,
‘If you compare yourself
with others
You may become vain or
bitter
For always there will be
greater
And lesser persons than
yourself’
আমি তার থেকে ভালো, এই ভাবনায় আর কৃত্রিম আনন্দের মাঝে নেশা আছে কোথাও। নিজেকে ভালো ভাবা,
নিজের চিন্তার বাইরে আর কারো চিন্তার অবকাশ না দেয়া আর অন্যকে হেয় মনে করা দুজনের মধ্যে আর যাই
থাকুক, বন্ধুত্ব থাকার কোনো সুযোগ নেই। জানার আগ্রহ থেকেই জানতে চেয়েছে কোটি মানুষ হাজারো বছর।
কিন্তু তাকে জানানোর জন্যে যে পদ্ধতি তা বদলানোর ঘণ্টা অনেক আগেই বেজেছে নিশ্চয়ই। বাংলাদেশ এখন
নতুন দেশ। বদলে দেবার পালায় রতনের মতন আপনিও চেয়ে আছেন, তাই না?