English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫, ৬ ভাদ্র ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-১১-২২ ০০:১৬:৫৮
আপডেটঃ ২০২৫-০৮-১৯ ০৩:২৭:৩৪


কোয়ারেন্টিনের দ্বাদশ দিন

কোয়ারেন্টিনের দ্বাদশ দিন


মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ


নক্ নক্ নক্।

দরজায় শব্দ শুনে ঘড়ির দিকে তাকালাম। বিকেল ছয়’টা বেজে পনের মিনিট। রাতের খাবারের প্যাকেটটা দিয়ে গেল বোধহয়। আকাশটা আজ মেঘলা। মেঘলা দিন আমার বড়ই অপছন্দের। মনটা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে যায়। আমার খোলা জানালায় বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। ভাগ্যিস দুপুরের পর-টা কেটেছিল পারিবারিক জুম-আড্ডায়। কাজিনদের সাথে জমিয়ে আড্ডা হ’লো দেড় ঘন্টারও উপরে। শুরুর সময়টা ঠিক করেছিলাম সিডনীর দুপুর দু’টোয়। ভ্যাঙ্কুভার (কানাডা) থেকে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের জন্য ছিল শুক্রবার সন্ধ্যে সাত’টা; শিকাগো (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে যারা, তাদের জন্য শুক্রবার রাত্রি ন’টা; টরন্টো (কানাডা) থেকে যে, তার জন্য শুক্রবার রাত্রি দশ’টা; বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশী, তাদের জন্য শনিবার সকাল ন’টা, মালয়েশিয়া থেকে যে, তার জন্য শনিবার সকাল এগার’টা; আর বাকীরা সিডনী আর মেলবোর্ন থেকে, তাদের জন্য দুপুর দুই’টা। ভাগ্যিস ইউরোপে কোন কাজিন নেই। না হলে, গভীর রাতে আড্ডায় ডাকার জন্য তিরষ্কার পেতে হ’তো।


দুপুরটা ভাল কেটেছিল বলেই হয়তো এই মেঘলা বিকেলটা ঠিক উপভোগ্য না হলেও স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারছি, রোজকার সেই একই দৃশ্য দেখে। অন্যদিন এইসময় ঘরে বিকেলের উজ্জ্বল রোদ থাকে (এখন সিডনীতে সূর্য্য ডোবে সন্ধ্যে সাত’টা চল্লিশে)। দুই ভবনের মাঝের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে সরাসরি স্বর্গ থেকে নেমে আসে আমার ঘরে। জানালার ব্লাইন্ডটা আমি নামিয়ে দেই না। উজ্জ্বল রৌদ্রালোকে জানালায় বসে স্মরণ করি অতীতের স্বর্ণোজ্জ্বল দিনগুলোর কথা। স্কুল থেকে বাড়ীতে ফিরে কোন রকমে কিছু খেয়েই দৌড় দিতাম মাঠে। দিনের বাকী যে সময়টুকু, তার রস তো পুরোটা নিতে হবে নিংড়ে। ঘরে ফেরার সময় তো বাঁধা—মাগরিবের আজানের শেষ ধ্বনিটুকু ইথারে মিলিয়ে যাবার আগেই। মেঘলা এই দিনে ‘তেলে ভাজা পাপড়ির মত মচমচে’ সেই বিকেলগুলো কেন যেন মনে পরে না। যদিও বা পরে, তা মিশে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ফিরে না পাওয়ার বেদনায়। তবে আমি ঠিক করেছি, আজ যে করেই হো’ক, বিষন্ন হব না।


তাই ঠিক করলাম, সকালে দেয়া হোটেল কর্তৃপক্ষর কাগজগুলো নিয়েই ভাবি। কোয়ারেন্টিনের সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, তা বুঝতে পারলাম কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়েই। আর দু’দিন পরে হোটেল ছেড়ে যাবার সময় কি কি করতে হবে, তার ফর্দ দিয়েছে। তিন পর্বে টানা হবে সমাপ্তি। আগামীকালের প্রথম পর্বে থাকছে নির্গমনপূর্ব স্বাস্হ্য পরীক্ষা। ডাক্তার ও নার্সের দল পরীক্ষা শেষে সন্তুষ্ট হলে কোয়ারেন্টিন সমাপ্তির সনদ সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাগজপত্রের সাথে দেবে একটি রঙ্গিন কব্জিবন্ধ (Wristband)। সন্তুষ্ট না হলে কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ বৃদ্ধি পাবে—এখানে বা অন্য কোনখানে। পরেরদিনের (মুক্তিরদিন) দ্বিতীয় পর্বে থাকবে কোয়ারেন্টিনের হোটেল আবাসন থেকে নির্গমনের আনুষ্ঠানিকতাসমূহ, যা সম্পন্ন হবে পুলিশ এবং নিরাপত্তারক্ষীদের তত্বাবধানে, হোটেল প্রশাসনের সহায়তায়। আর শেষপর্ব হ’লো নিজেদের আয়োজিত ব্যবস্থায় হোটেল অঙ্গন থেকে প্রস্থান, যেটা সবাই উল্লসিত হয়ে করবে বলেই মনে হয়।


নৈশভোজের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আজ ষ্টিকি রাইসের সাথে ছিল সিদ্ধ ব্রক্কলি, আর সয়া সসে রান্না করা মিশ্র সব্জি; যাতে ছিল—ব্রক্কলি, ক্যাপসিকাম, স্কোয়াশ, তফু (বীনকার্ড), আর এ্যাসপারাগাস। এ্যাসপারাগাস জিনিষটা বরাবরই একটা দামী সব্জি, কিন্তু কেন যে এই স্বাদহীন বস্তুটি এত দামী, সেটা আমি আজও ঠাওর করে উঠতে পারি নি। যাহো’ক, এই এ্যাসপারাগাস দেখে অনেক অনেক দিন আগে পড়া সমারসেট মম্ (Somerset Maugham) -এর লেখা The Luncheon গল্পটার কথা মনে পরে গেল। গল্পটা পড়তে গিয়ে অনেক খটকা লেগেছিল। Maugham এর উচ্চারণ কেন মঘাম না হয়ে মম্ হ’ল, ছাত্রাবস্থায় এই বিতর্কের উপসংহারে আসতে না পেরে এখন এই তর্কই ছেড়ে দিয়েছি। তাছাড়া, গল্পের ভিলেন সাধারণত: পুরুষ চরিত্র হলেও, শ্রীযুক্ত মম্ একটি নারী চরিত্রকে ভিলেন হিসেবে নিয়েছিলেন! কেন তাকে ভিলেন করেছিলেন, সেটা তখন না বুঝলেও এখন কিছুটা অনুধাবন করতে পারি বলে মনে হয়। সারা মাসের জন্য বরাদ্দকৃত আশি’টি (৮০) ফ্রাঁ (ফ্র্যাঙ্ক) একটি মধ্যাহ্নভোজে নি:শেষ হয়ে গিয়ে যখন ওয়েটারকে বকশিশ দেবার জন্য অপর্যাপ্ত মাত্র তিনটি ফ্রাঁ অবশিষ্ট থাকে এবং পুরো মাস সামনে পরে থাকা সত্ত্বেও যখন সে মাসে চলবার জন্য পকেটে একটা ফুটো পয়সাও না থাকে, তখন যে তার জন্য দায়ী, সে শুধু নারী কেন স্বয়ং দেবী হলেও তাকে ভিলেন বানাতে লেখকেরএতটুকু দ্বিধা হওয়ার কথা না।


যাহোক, এসব অমীমাংসিত বিষয় বাদ দিয়ে বরং যা বলতে চেয়েছিলাম, সে বিষয়েই আসি। নিজ লেখা সম্বন্ধে যার স্তুতিবাকে লেখক বিমোহিত হয়েছিল এবং যিনি মধ্যাহ্নভোজে একটির বেশী পদ আহার করেন না বলে বারংবার দাবী করেছিল, তার জন্য লেখক যে খাবারের ফরমায়েশ দিয়েছিল, তা থেকেই আমার মত অজ্ঞ শিক্ষার্থীরা খাবারের বেশ কিছু নতুন পদের নাম শিখেছিল। যেমন, তোষামোদকারী নারীটি প্রথমে খেতে চেয়েছিল স্যামন (Salmon)। আমার মত অনেকেই সেদিন এই মাছটির নাম প্রথম জেনেছিল। ক্ষুধা উদ্রেক করার জন্য এ্যাপেটাইজার হিসেবে নিয়েছিল ক্যাভিয়ার (Caviar)—সে বস্তুটি সম্বন্ধেও সেদিন প্রথম জেনেছি। পরে জেনেছি, যে কোন মাছের অনিষিক্ত ডিমকে সাধারণ ভাবে ক্যাভিয়ার বললেও, ষ্টারজন (Sturgeon) মাছের অনিষিক্ত ডিমই হ’লো প্রকৃত Caviar। পানীয় হিসেবে নিয়েছিল—স্যাম্পেন, এটা মনে হয় ‘মাসুদ রানা’ পড়ার সুবাদে আগেই জেনেছিলাম। তারপর, নিয়েছিল এ্যাসপারাগাস (Asparagus), যার কথা বলতেই আজ এত কথা। এরপর আইসক্রীম এবং কফির ফরমায়েস দিয়ে লেখক ভেবেছিল, এ যাত্রা রক্ষা পেল। কিন্তু না, ঝুড়ি ভর্তি রসালো পিচ সহ হেড-ওয়েটারের বিগলিত আবির্ভাবে লেখককে পিচ-এরও ফরমায়েশ দিতে হয়েছিল। কপাল পোড়া হলে এমনই হয়।


এই এ্যাসপারাগাস নিয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতা বলেই আজকের লেখার ইতি টানার ইচ্ছে। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে পিটি (PT-Physical Training বা শরীরচর্চা) করতে হ’ত, যা ছিল ক্যাডেটদের সবচেয়ে অপ্রিয় বিষয়। এই জন্য প্রথমে প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশেষ বিন্যাসে (formation) দাঁড়াতে হ’ত। শারিরীক ভাবে অপারগ যারা, তারা দাঁড়াতো প্যারেড-বিন্যাসের পিছনের একটা লাইনে। পিটি শুরু করিয়ে দিয়ে হাবিলদার মশায়—যাকে আমরা ‘ওস্তাদ’ বলে সম্বোধন করতাম—পিছনের লাইনের প্রত্যেককে একে একে জেরা করতেন। সন্তুষ্ট হলে এলডি (LD—Light Duty) দিতেন, মানে পিটি করতে হ’ত না অথবা প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাতেন। আর সন্তুষ্ট না হ’লে সবার সাথে পিটি-তে পাঠিয়ে দিতেন। আমরা সবেমাত্র তখন ক্লাসে The Luncheon পড়েছি। আমাদের এক প্রয়াত দুষ্টু বন্ধু [আল্লাহ্ (সুওতা) যেন ওকে বেহেস্ত নসীব করেন] সম্পূর্ণ সুস্হ অবস্থায় প্যারেড-বিন্যাসের পিছনের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। পিটি শুরু করিয়ে দিয়ে ওস্তাদ জেরা করতে আসলো:

—বলো, কি হয়েছে তোমার?

ঘটনার আকস্মিকতায় না কি ওর পূর্বপরিকল্পিত তা আমরা কখনই ওর কাছে জানতে পারি নি, কিন্তু ও বলেছিল:

—ওস্তাদ, এ্যাসপারাগাস ফ্র্যাকচার!

প্রয়াত ওস্তাদজী কি বুঝেছিলেন, তা উনিই ভাল জানেন। জিজ্ঞেস করে যে জেনে নেব, ওপারে যাওয়ার আগে সে সুযোগও আর নেই। তবে আমরা জেনেছিলাম, গম্ভীর মুখে অনেক দুশ্চিন্তা নিয়েই তিনি ওকে স্বাস্হ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ

অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।



আরো পড়ুন