মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
পর্ব : ০৪
- ‘গত দু’দিন কিছু লিখলি না যে?’
বন্ধুর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেক দিন আগের একটা ঘটনা মনে পরে গেল। তখনকার দিনে শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠেয় পরীক্ষাগুলোতে প্রথম থেকে বিংশ স্থান অধিকারী ছাত্র-ছাত্রীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হতো। সাধারণ ভাবে বলা হ’তো এরা ‘স্ট্যান্ড’ করেছে। তো, মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করে উচ্চ-মাধ্যমিকে এসে সাধারণ প্রথম বিভাগে পাশ করা [৬০% বা তার বেশি পেলে প্রথম বিভাগ, আর ৮০% বা তার বেশি পেলে লেটার (LETTER) মার্কস] এক মেধাবী ছাত্রকে তার এক কনিষ্ঠজন জিজ্ঞেস করেছিল—আপনি মাধ্যমিকে ষ্ট্যান্ড করে উচ্চ-মাধ্যমিকে করলেন না কেন?
জ্যেষ্ঠ সরল উত্তর—এক কাজ বার বার করতে আমার ভালো লাগে না!
আমি অবশ্য তেমনটা বলি নি; সত্যটাই বলেছি—‘গত দু’দিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি, তাই বিশ্রাম।’
কটাক্ষ করে বলেছিল—‘কোয়ারেন্টিনে আবার বিশ্রাম!‘
ভাবলাম, নয় কেন? সব দিন একরকম হলে তো আবার সেই একঘেয়েমিতেই কাটবে। তবে, কথাটা নিজের কাছেই কেমন যেন বেখাপ্পা লাগলো। ঠিক সত্যের বেষ্টিতে পরে না, আবার মিথ্যের যে খুব কাছে তাও না, অনেকটা সত্য-মিথ্যার মাঝামাঝি একটা ভাসমান অবস্থা। বিগত দু’দিন বারের দিক থেকে ছিল শনি ও রবি। অস্ট্রেলিয়ায় সাপ্তাহিক ছুটি বটে। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বিশ্রামে ছিলাম, সেটা তো ঠিক না। কারণ, আমি তো কোয়ারেন্টিনে। আমার সব দিনই একরকম। কিন্তু একদম অলস সময়ও তো ঠিক পার করি নি। সারাদিন কেটেছে দূরালাপনিতে ভর করে।
দুপুরের দিকে ফোনে কথা বলার সময় মেয়ে বললো আজ—‘বাবা, প্রচন্ড গরম পরেছে, টের পাচ্ছো? বাইরে ছত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস!’
বললাম—‘মা রে, আমি টের পাব কি করে? আমার তো তাপমাত্রার পরিবর্তন নেই! সেই যে প্রথম দিন ঘরে ঢুকে পঁচিশ ডিগ্রিতে সেট করেছি, কোনো বেলাতেই ডিজিটাল মনিটরে সেটা পঁচিশ থেকে এক চুল এদিক-সেদিক নড়তে দেখি নি। তাছাড়া আমি তো ঘর থেকে বেরই হই না। কোয়ারেন্টিন বলে কথা। তাপমাত্রার পরিবর্তন টের পাব কী করে?’
এর মধ্যে খাদ্য সরবরাহে হ’লো বিরাট পরিবর্তন। শনিবারে গিন্নী সহ ছেলে-মেয়েরা এসে ব্যাগভর্তি হরেক পদের খাবার দিয়ে গেল। রিশেপনের লোকেরা সেটা পৌঁছে দেয়ার কিছুক্ষণ পরে শুনি দরজায় আবার নক্। দরজা খুলে দেখি, কোক-এর দুইশ’ পঞ্চাশ মিলিলিটারের একটা মাত্র ছোট্ট বোতল নি:সঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গিন্নির হঠাৎ মনে হয়েছে, খাবারের সঙ্গে তো ড্রিংকস দেয়া হয় নি; তাই নি:সঙ্গ এই বোতল! গুণগত সঙ্গ দিতেই সেটাকে ঘরে নিলাম। রোববার সন্ধ্যেটা হলো আরো চমৎকার। আমার কোলেস্টেরলের ব্যাপারে এক্কেবারে উদাসীন এক বন্ধুর বরাতে নৈশভোজে পেলাম গরুর রেজালা, খাসির নেহারি, সঙ্গে নান-পরোটা, আর আফগানি হালুয়া। চুলোয় যাক কোলেস্টেরল; কোয়ারেন্টিনে বসে এমন বাহারী খানা পেলে মনটা কার না চাঙ্গা হয়?
তবে মনটা বিষন্ন ছিল গতকাল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরলোক যাত্রার সংবাদে। আরো একটি নক্ষত্রের পতন হলো। বসে বসে ভাবছিলাম—২০২০ সাল এখনও শেষ হয় নি! যে করোনার কারণে সুস্থ থেকেও আমি কোয়ারেন্টিনে, সেই করোনা এর মধ্যেই নিয়ে গেল অনেকগুলো প্রাণ। তাদের মধ্যে যেমন আছে অতি সাধারণ কিছু মুখ, তেমনি আছে অনেক নক্ষত্র। আছে আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, পড়শী, পরিচিত, অপরিচিত, নাম জানা এবং না জানা অনেকেই। তবে এক বছরে এত নক্ষত্রের পতন বোধ হয় স্মরণকালে হয় নি। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ দিয়ে ১৯৫৯ সালে সিনেমা জগতে যার অভিনয় শুরু, তাঁর মূল পদচারণা অভিনয় জগতে হলেও শিল্প-সাহিত্যের অন্য জগতেও তাঁর পদচারণা ছিল ঈর্ষণীয়। গতকাল থেকে বসে বসে তাঁর কথাই ভাবছিলাম, আর তাঁর গলায় আমার প্রিয় কবিতা আবৃত্তি শুনছিলাম।
‘মৃত্যু আয়, তিনপাত্তি খেলি আয়’ কবিতাটা শুনলাম কয়েকবার; সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হবার সুবাদে। কী ভরাট কন্ঠ, কী দরাজ ডাক! শুনলাম আবার পৃথ্বীরাজ চৌধুরীর লেখা কবিতা ‘ইতি অপু’। তাঁর কন্ঠে কবিতাটির চারটি ছত্র শুনে একটু যেন স্তব্ধ হয়েছিলাম—
‘সেই থেকে তো শ্মশানের কাঠ, গার্হস্থ্যে আমার হলো অক্ষয়;
যারা চলে যায়, কে বললো, শুধু তাদেরই শব দাহ হয়?
প্রথমে প্রথমে পুড়ে যেতাম নতুন বিয়োগ, চড়া আঁচে;
দ্যাখ, ‘সন্তাপ’ কথাটাতেই ‘তাপ’ কথাটা লুকিয়ে আছে।”
কথাগুলো নিয়ে ভাবনা এলো অনেক। হারিয়েছি আমরা অনেককেই। শুধু প্রিয়জন হারানোতেই নয়, নক্ষত্র হারানোর ক্ষতটাও হয় অনেক গভীর। তারপরও ছন্দ ফিরে পায় জীবন।গভীর ক্ষতগুলোও শুকিয়ে আসে একদিন। বাস্তব থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো ম্লান হয়ে যায় স্মৃতি থেকে। একেবারেই কি হারিয়ে যায় তারা, হারিয়ে যায় স্মৃতির বিস্মরণে?
উত্তরটা পেলাম সৌমিত্র চ্যাটার্জীরই আবৃত্তি করা রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার একটি চরণে—
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
থেকে
১৬ নভেম্বর ২০২০
লেখক পরিচিতি:
মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
অতিরিক্ত
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড।
ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক
ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক,
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট
মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট
স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত