English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-১১-১২ ২৩:১৯:১৪
আপডেটঃ ২০২৫-০৬-২৫ ১৯:৫৬:১৬


কোয়ারেন্টিনের চতুর্থ দিন

কোয়ারেন্টিনের চতুর্থ দিন



মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ

 পর্ব: ০৩

কোয়ারান্টাইন অথবা কোয়ারেন্টিন শব্দটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় কয়েক যুগ আগে, স্কুল জীবনেনা, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নয়; শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা থেকে তবে তিনি কোয়ারান্টাইন অথবা কোয়ারেন্টিন উল্লেখ করেন নি, লিখেছিলেনকেরেন্টিন' জাহাজের খালাসীদেরমুখে ঠিক যেমনটি শুনেছিলেন শরৎবাবুর বর্ণনায় ব্যাপারটি ছিল এরকম—“পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন্ খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান শহর হইতে আটদশ মাইল দূরেএকটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয় দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায় তবে যদি কাহারও কোন আত্মীয় শহরে থাকে, এবং সে Port Health Officer   এর নিকট হইতে কোন কৌশলে ছাড়পত্র যোগাড় করিতে পারে, তাহা হইলে   অবশ্য আলাদা কথা

 

আমার বর্তমান অবস্থার সাথে সেদিনের সেই বর্মামুলুকের কেরেন্টিনের কোনো মৌলিক পার্থক্য আমি দেখছি না   শুধু স্থান-কাল পাত্রের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র সেদিনের প্লেগের বদলে আজকের ভীতি করোনায়, বর্মামুলুকের বদলে এই   কেরেন্টিন অস্ট্রেলিয়ায়, দশ দিনের বদলে চৌদ্দ দিন, আর শরৎচন্দ্রের জায়গায় বেচারা আমি প্রথম পুরুষে নিজের অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করছি বলে অবলীলায় শরৎবাবুর    জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বেশ একটা পুলক অনুভুত হচ্ছে কিন্তু বিপদ ঘনাতে কতক্ষণ! অবাস্তব তুলনাকে ব্যঙ্গ করে  বাংলায় যে সব প্রবাদ চালু আছে, সেগুলোর কথা না- বা স্মরণ করলাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে কোনো এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উদ্ধৃতি  দিতে শুনেছিলাম—‘কে হায় হৃদয় খুলিয়া বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ তাই, থাক না সে প্রসঙ্গ!

 

শরৎবাবু আরও কিছু কথা লিখেছিলেন, যার সত্যতা যাচাই করতে আমাকে   আরও দশদিন অপেক্ষা করতে হবে তিনি  লিখেছিলেন—“অধিকাংশ স্থলেই দেখা যায়, সত্যকার বিপদ কাল্পনিক বিপদের চেয়ে ঢের   সুসহ প্রথম হইতেই ইহা স্মরণ থাকিলে অনেক দুশ্চিন্তার হাত এড়ানো যায় সুতরাং কিছু কিছু ক্লেশ অসুবিধা যদিও নিশ্চয়ই ভোগ করিতে হইয়াছিল,   তথাপি কথাও স্বীকার করিতে হয় যে, কেরেন্টিনের নির্দিষ্ট মিয়াদের দিনগুলি আমাদের একপ্রকার ভালই কাটিল

 

তবে, শরৎচন্দ্র তো শরৎচন্দ্রই সমুদ্রের মাঝে সাইক্লোনের কবলে পরে জাহাজের খোলা পাটাতনে বসে   পর্বতপ্রমাণ ঢেউ  মাথায় আছড়ে পরার আগে যিনি বলতে পারেন— “ভগবান! এই চোখ দুটি যেমন তুমিই দিয়াছিলে, আজ তুমিই তাহাদের সার্থক   করিলে এতদিন ধরিয়া সংসারে সর্বত্র চোখ মেলিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু তোমার এই সৃষ্টির তুলনা কখনও দেখিতে পাই নাই যতদূর দৃষ্টি যায়, এই যে অচিন্তনীয় বিরাটকায় মহাতরঙ্গ মাথায় রজতশুভ্র   কিরীট পরিয়া দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে, এত বড় বিস্ময় জগতে আর আছে কি!”—তাঁর কাছে সুখ আর দু:খের পার্থক্যটা যে কী, তা যে ভগবানকে তিনি ডেকেছিলেন, সেই ভগবানই হয়ত বলতে পারবেন

 

আমি আছি আমার জ্বালায় সংযুক্ত পোষাকের আলমারি  (built-in wardrobe) আর স্নানকক্ষ সহ আমার ঘরটি দৈর্ঘ ২৬ ফিট, প্রস্থে ১৪ ফিট আলমারি, স্নানঘর, বিছানা, প্যান্ট্রি, পড়ার টেবিল-চেয়ার, আর ডিভানের জায়গা বাদ দিলে, হাঁটা চলা করার মতো যেটুকু জায়গা খালি আছে, তাতে একটা মহিশ ভুলে একবার ঘরে ঢুকেলে উল্টা ঘুরে বের হতে পারবে কি না সন্দেহ

 

সেই ঘরে আমাকে থাকতে হচ্ছে চৌদ্দদিন চড়ার কুঁড়েঘরে কেরেন্টিন করার কষ্ট যে কি, সেটা আমি আন্দাজ করতে পারি তবে, সেখানে অন্তত: কেরেন্টিনে থাকা আরও অনেক মানুষ ছিল আশে-পাশে কিন্তু, ২৬’ x ১৪ঘরে কোনো মানুষের চেহারা না দেখে চৌদ্দদিন কেরেন্টিনে থাকার কষ্ট শরৎবাবু বঝবেন কী করে?

 

গতকাল কেরেন্টিন নিয়ে কিছু লিখি নি কেরেন্টিনে থাকার যাদের সম্ভাবনা নেই, নিয়ে জানার তাদের আগ্রহও নেই যাদের জানার আগ্রহ আছে, তারা নিয়ে আগে থেকে জানলেও থাকবে, না জানলেও থাকবে তাদের যে থাকতে হবেকেরেন্টিনে তো আর কেউ শখ করে চিড়িয়াখানার   চিড়িয়া দেখতে আসে না! গতকাল সারাটা দিন কলম ছেড়ে পেন্সিল  হাতে কাগজ সামনে নিয়ে বসেছিলাম ঘুমাতে যাবার আগে কাগজে যা পেলাম, পাঠকের জন্য তা পোস্ট করলাম ইংরেজদের মাঝে না কি একটা বুলি প্রচলিত আছে—when life gives you lemon, better make lemonade.

 

জীবন যদি তোমাকে লেবুই উপহার দেয়, তো শরবত বানিয়ে খাও

 

 আমিও সেই চেষ্টাই করছি . . . .

 

১৩ নভেম্বর ২০২০

 



লেখক পরিচিতি:


মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ

অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড।

ব্যাংকার ও কলামিস্ট। তিন দশক ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এনএ-তে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ গোল্ড মেডালিস্ট মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ আমেরিকার ম্যাসেচুসেটস ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি থেকে ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে এমএ ডিগ্রি নিয়েছেন।


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


আরো পড়ুন