English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২০-০৮-১১ ০৩:০৭:৩৫
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৮ ১৮:৫৩:৪২


করোনার খোঁজে শত কিলোমিটার

করোনার খোঁজে শত কিলোমিটার

লেখা ছবি: মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান 


করোনা নিয়ে দেশে বিদেশে আতংক, অস্থিরতা গবেষণার শেষ নেই। এখনো টক অফ দি ওয়ার্ল্ড হলো করোনাভাইরাস।  বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সারা দেশেই করোনা নিয়ে কাজ হচ্ছে। করোনা নিয়ে আলোচনা এখনো দেশের প্রধান খবর।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে করোনা বিস্তার নিয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, রংপুর বিভাগে করোনার প্রভাব তুলনামূলক কম। পুরো বিভাগে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় আট হাজার। দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে যতো সচেতনতামূলক প্রচারণা চলুক না কেন এর প্রভাব উপজেলাগুলোতে অনেক কম। যদিও দিনাজপুরে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই বিভাগে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে করোনা প্রবেশ করে নি। কোথাও মানুষ 'করোনা কী' সে সম্পর্কেও খুব কম জানেন।  আগস্ট ২০২০ দিনাজপুর জেলা শহর থেকে বোচাগঞ্জ হয়ে ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী এবং দিনাজপুর বিরল সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার শত কিলোমিটার পথ মোটরসাইকেলে সহযাত্রী হিসেবে ঘুরে সেখানকার মানুষের সহজ জীবনধারা দেখে মনে হয় নি টিভি চ্যানেলেগুলোতে তখনো দিনরাত করোনা পরিস্থিতির আপডেট চলছে।

 

 

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ থানার বাজনিয়ায় টেকনিকাল মোড়ে মিলন হোটেলে সকালের সোনালি আলোতে নাস্তা করছিলেন কয়েকজন। তাদের আড্ডার বিষয় আগের দিন মানে আগস্ট ২০২০ এলাকায় মাইকিং নিয়ে। সবাইকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। মাস্ক পরা কীভাবে মানবেন তা নিয়েই আলোচনা।
লাল চায়ের সাথে বুট মুড়ি খেতে খেতে আলাপ হচ্ছিল তাদের সাথে। একজন জানালেন তারা শুনেছেন উপজেলায় সাত জনের করোনা হয়েছে। তবে তাদের এলাকায় করোনা নেই। এখানে করোনা পরীক্ষার কোনো সুযোগও নেই।
'
আপনারা মাস্ক পরেন?' এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশ হাসিমুখে একজন জানালেন তার পকেটে একটা মাস্ক রাখা আছে।
আরেকজন বললেন তার মাস্ক বাসায় ফেলে এসেছেন। তবে ভিন্নধর্মী উত্তর দিলেন দাঁড়িয়ে থাকা একজন। তিনি হেসে বললেন, 'আমার কোনো 'মাচ' (মাস্ক) নেই। আমি গরিব জেলে এসব কোথায় পাবো। তাই ঠিক করেছি একটা কাতলা মাচ (মাছ) কেটে মুখে লাগিয়ে রাখবো!'



বিরল থানার পাকুড়া মোড়ে কথা হয় আবু বকর সিদ্দিকীর সাথে। দুই ভাইকে সাথে নিয়ে তিনি ছোট একটি খাবারের হোটেল চালান। জানালেন, তাদের এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগী নেই। সে জন্য কোনো আতংক নেই। তবে করোনা আতংকে প্রথম আড়াই মাসের মতো তার হোটেল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। সময় ভাড়া দিয়ে যেতে হয়েছে। কোনো আয় ছিল না। বেশ কঠিন সময় পার  করতে হয়েছে।
হোটেলটিতে নাস্তা করতে আসা কয়েকজন জানালেন, করোনা নিয়ে তারা তেমন চিন্তিত নন। একজন বললেন, 'করোনা হচ্ছে শহরের মানুষের জন্য। আমাদের জন্য নয়।'



খানাখন্দ ডোবায় মাছ ধরেন দুখুয়া রিশি। তার সাথে দেখা হলো বিরলের বাংলাদেশ - ভারত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা রাধিকাপুরে। সীমান্তে ভারতীয় কাঁটাতারের  বেড়া দেখা যায় এমন জায়গায় তিনি একটি বাইন মাছ তিনটি কুচিয়া মাছ ধরেছেন। বাইন মাছটি চল্লিশ টাকায় বিক্রি করবেন। বাকিগুলো নিজেরা খাবেন। করোনা নিয়ে প্রশ্ন করলে কিছুই না বলে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন।


ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ পীরডাঙ্গী কবরস্থানটি অনেক বড়। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই কবরস্থানে প্রতিটি গ্রামের জন্য আলাদা জায়গা রাখা আছে। পনের লাখ মানুষের  ঠাকুরগাঁও জেলায়  প্রায় পাঁচশ করোনা রোগী  শনাক্ত হয়েছেন।  পীরডাঙ্গী কবরস্থানে করোনা আক্রান্ত রোগী দাফনের তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না।



এখন ধান বোনার মওসুম। দিনাজপুর এলাকার সাদা গুটি বা গুটি সোনা ধান লাগানোর সময়। সব জায়গাতে ব্যস্ততা। কোথাও দল বেঁধে, কোথাও বা এক দু'জন মিলে। এক জায়গায় দেখা গেল স্বামী স্ত্রী মিলে ধানের চারা রোপণ করছেন। কথা বলার সময় কম। ধানের ফলন নিয়ে কথা বললেও করোনা নিয়ে কথা বলতে চাইলে অনেকেই এড়িয়ে যেতে চাইলেন।  দুএকজন বলেই দিলেন, এখন এতো কাজ। করোনা নিয়ে ভাবার মতো 'টাইম নাই'





ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গীর হরিণমারী সীমান্তে নয়াপাড়া এলাকার মন্ডুমালা গ্রামে প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর বিশালাকার সূর্যপুরী আমগাছটি এলাকার বড় আকর্ষণ ঊনিশটি ছোট বড় ডাল ছড়িয়ে আছে অক্টোপাসের মতো। বিশাল এবং প্রাচীন এই গাছটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করেন নানা বয়সীরা। কথা হলো রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা আনোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি এক বন্ধু পঞ্চগড় থেকে বেড়াতে আসা এক আত্মীয়কে নিয়ে আম গাছ দেখাতে এসেছেন। তিনি জানান, 'এই এলাকার অনেকেই  বিশ্বাস করেন না করোনা বলে কিছু আছে। প্রয়োজনে তারা বিষয়ে তর্ক করতেও পিছ পা হবেন না।'



ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জে পথে একটি রাবার ড্যাম। ব্রিজে দাঁড়িয়ে পানির স্রোত দেখার সময় প্রবীণ একজনের সাথে কথা হয়।
'
করোনার খবর কী, চাচা?'
জানতে চাইলে তিনি হাসতে থাকেন।

-ডাবলিউএইচও প্রধানের বিমর্ষ সতর্কবাণী
-কেএন নাইন্টিফাইভ মাস্ক
-করোনা হওয়ার ভয়ে পাঁচ মাস ঘরে স্বেচ্ছা নির্বাসিত ব্যক্তির উদ্বেগ
-পিপিই পরে ঘুরে বেড়ানো
-অনলাইন মিটিং
-লকডাউন
-কোয়ারেন্টিন
-ভ্যাকসিন....

সবকিছুই তার এই হাসির কাছে ম্লান মনে হয়!


ক্যাটেগরিঃ প্রধান কলাম, জীবনধারা,


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।