English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৮ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৬-৩০ ০৬:৫৪:২৯
আপডেটঃ ২০২৫-০৫-০৮ ১০:১৭:৪৯


ক্যারাম

ক্যারাম

অরুণ সেন

বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ দুম করে আমি হয়ে গেলাম স্কুলে ক্যারাম চ্যাম্পিয়ন।এমনিতে আমাদের স্কুলে এতো মেধাবী ছাত্রের  ভীড় যে খেলাধুলা নিয়ে কেউ বেশি মাথা ঘামত না।বছরে তিনটে হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড না করলে সে বছর খুব খারাপ রেজাল্ট।একবার অঘোর শিল্ডে ফুটবলে নাম দিয়ে তীর্থবতী ইনস্টটিটুশনের কাছে পাঁচ শূন্য গোলে গোহারান হেরে ক্ষান্ত দিয়েছিল।যদিও আমাদের আর্চ রাইভাল সেন্ট লরেন্স স্কুলকে কোনো রকমে হারিয়ে আমাদের সে কী উল্লাস।অথচ স্কুলে গোল পোস্ট দেওয়া বিরাট মাঠ কিন্তু খেলাতে কারোই মন নেই।হঠাৎ সেবার ক্যারাম কমপিটিশন হবে বলে অশোক মোহন আমাকে বললো, তুই আমার পার্টনার হবি।

আমি বললাম, চল ঠিক আছে।

আমি তখন নিচু ক্লাসেই পড়ি কিন্তু কেমন করে যে ক্রমে ক্রমে সেমি ফাইনাল, ফাইনাল জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম কে জানতো!

 

আমার অবশ্য কোনো ডিগ্রি ছিল না ক্যারাম খেলায়।আমার হাতে খড়ি কালীঘাট তরুণ সঙ্ঘ লাইব্রেরিতে।সাদার্ন মার্কেটের দোতলার একদম কোণে এই লাইব্রেরিটা আমার খুব ভালো লাগতো।আমরা থাকতাম সাদার্ন এভিনিউয়ের প্রথম বাড়িটায়।মায়ের ছিল ভীষণ বই পড়ার নেশা। রোজ একটা করে বই তার চাই। আমায় ছোট চিরকুটে বইয়ের নামটা লিখে দিত আর আমি সেটা গিয়ে সোজা দিতাম রবিদার হাতেরবিদা কোনোদিন চাকরি বাকরি করে নি।লাইব্রেরির জন্য নিবেদিতপ্রাণ।সমস্ত বই কোথায় আছে মুখস্ত। কোনোদিন ঢোঁড়াই চরিত মানস কিংবা পদ্মা নদীর মাঝি কোনদিন যাযাবর এর দৃষ্টিপাত, বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী তরঙ্গিনী কিংবা মুজতবা আলীর যে কোনো বই নিমেষে বার করে দিত।ক্যাটালগ সব নিজের হাতে বানাত।আর হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো।এই কাজের জন্য কোনো পয়সাও নিতো না। কোনদিন দেখি নি রবিদা আসে নি।ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, ঠিক পাঁচটায় এসে দরজা খুলে আপনমনে কাজ করে যেত।আমার খুব ইচ্ছা ছিল ওই লাইব্রেরিয়ান হয়ে বই পড়ে পড়ে নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।আমাকে আবার খুব ভালোবাসত কেন না আমি কোনোদিন সময় পেলে ফেরৎ আসা বইগুলো নাম্বার দেখে দেখে তাকে রেখে আসতাম। একবার সর্দান মার্কেটের ওপরে বিরাট থিয়েটার করা হয়েছিল।অপর্ণা সেন ডেসদামিনো আর উৎপল দত্ত ওথেলো।পুরো ইংরেজিতে নাটক আর আমার ওপর ভার ছিল অপর্ণা সেনকে একটা পুস্তকস্তবক লাইব্রেরির তরফ থেকে দেওয়ার।কী নার্ভাস যে আমি হয়েছিলাম

বড়রা মেম্বার হলে ছোটদের একটা করে বই ফ্রি দিত। মেম্বারশিপ ফি পাঁচ টাকা।আমি ছিলাম বিদেশি বইয়ের পোকা।তখন হেমেন্দ্র কুমার রায় আর নীপেন্দ্র কৃষ্ণ অনুবাদ সাহিত্য কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। দারুণ দারুণ সব বই। অ্যারাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেইজ, জার্নি টু দি মুন,নিকলাস নিকলবি,ম্যাকবেথ,মার্চেন্ট অফ ভেনিস,লা মিসারেবল, থ্রি মাসকেটিয়ার্স আর ছিল কিরীটি রায়,মোহন সিরিজ।ঝমঝম বৃষ্টিতে, কালো ওভারকোট আর ফেল্ট টুপি পরে কিরীটি রায়ের কবরখানায় পেছন থেকে কেউ টোকা দিত তখন রোমাঞ্চে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত!



লাইব্রেরির বাইরে বসত দারুণ ক্যারামের আড্ডা বিশাল ম্যাচ বোর্ড।সাঁ চকচকে বোর্ডে  তারপিন তেলে সিসন করা পাতলা সাদা কালো গুটিগুলো ফর্মুলা ওয়ান গাড়ির মতো এদিক সেদিক ছিটকে বেড়াতো।এর ওস্তাদ ছিল সুভাষদা।আদ্দির সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে, ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে ঠিক পাঁচটায় এসে ক্যারাম বোর্ড সাজিয়ে শুরু করে দিতো। বাঁ হাত একটা রুমাল থাকতো।সেটাতে একবার করে মুছে প্রবল বেগে যখন স্ট্রাইক করতো তখন বিদ্যুৎবেগে চারিদিকে একবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তো। শেষে বোর্ডে পড়ে থাকত দু তিনটা মাত্র গুটি।সুভাষদার একটা নিজস্ব হলুদ রঙের ইবনি স্ট্রাইকার ছিল সেটা কাউকে দিত না।একবার করে খেলত আর পকেটে পুরে রাখত।এঙ্গেল ট্যাংকি, টাচ ছিল ওর জলভাত।ওর সাথে উল্টো দিকে কেউ খেলতে চাইতো না কেননা তার কিছু করার ছিল না। বেসে দুএকটা গুটি পড়ে থাকতো।আমি আবার বেসে খুব স্ট্রং ছিলাম তাই আমাকে পার্টনার করতো।দুটোর বেশি গেম কেউ খেলতে পারবে না এটাই নিয়ম কেননা অন্যরা হা পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে আছে।আমি একটা গেম খেলেই বই নিয়ে পালাতাম বাড়ি

 

তারপর আমার ক্যারামে বেশ নেশা হয়ে গেল।স্কুল চ্যাম্পিয়ন হবার পর মাকে অনেক আবদার করলাম একটা নতুন ক্যারাম বোর্ড কেনার জন্য।বাবা সরাসরি প্রস্তাব নাকচ করে দিল।পড়াশুনোর ব্যাঘাত হবে।মাও পারল না বাবাকে রাজি করাতে। শেষে ঠাকুমাকে ধরে অনেক পটিয়ে পাটিয়ে এক জন্মদিনে ঘর আলো করে ঝকঝকে ফর্সা সুন্দরী ক্যারাম বোর্ড বাড়িতে এলো।শর্ত একটাই সপ্তাহে একবার ঠাকুমাকে অবশ্যই শ্মশান ঘাট ঘুরিয়ে আনতে হবে।শ্মশান দেখার মতো এত বিচিত্র শখ যে কারো হতে পারে কে জানে! তবু কন্ট্রাক্ট ইজ কন্ট্রাক্ট তাই আমৃত্যু আমি নিষ্ঠা ভরে সেটা পালন করে যেতাম। আমি তখন বাস ভাড়া ফাঁকি দিয়ে পয়সা জমিয়ে ভাল ভাল স্ট্রাইকার জোগাড় করতাম।পূর্ন সিনেমার উল্টো দিকের রমেশ মিত্র রোডে সামুরের একটা দোকান ছিল আর একটা দোকান ছিল ইন্দিরার পাশে জি কে স্পোর্টস।ওখান থেকে বেছে বেছে কিনে আনতাম সব রঙিন স্ট্রাইকার

 

আমার দিদির বন্ধুরা সব দল বেঁধে আসত আমাদের বাড়ি।লোকেশনটা দারুণ ছিল বলে কোনো জন্মদিন কিংবা থিয়েটার দেখার হলে সব জড়ো হয়ে দু চার দান ক্যারাম পিটিয়ে চলে যেত।এরা সব হায়ার সেকেন্ডারি দুর্দান্ত মার্কস পেয়ে ফিজিক্সয়ে অনার্স নিয়ে সব একই কলেজে পড়ে।দারুণ ভাব নিজেদের মধ্যে।পরবর্তী কালে সবাই ফিসিক্সে ডক্টরেট করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।তবে এদের মধ্যে ভারী লেন্সের চশমা পরে মীনাক্ষীদির সম্ভবনা খুব উজ্বল ছিল।অনেক ক্ষণ ধরে খুব গভীর মনোযোগ নিয়ে টিপ করে খুব আস্তে করে সমান্তরাল রেখার মধ্যে থেকে জ্যামিতির জাগতিক অঙ্ক কষে সরলরেখার গতিপ্রকতি হিসাব নিকাশ সেরে শূন্যে ভাসিয়ে দিতো স্ট্রাইকার। আর সেটার সাথে গুটির সংঘাতের আনবিক বিস্ফোরণে আচমকা যেতে যেতে একটু মুচকি হেসে যেন সেই প্রিজমের ভেতর দিয়ে আপাত বেগুনি রশ্মি সাতটা রঙে বিমোচিত হয়ে ঢলে পড়তো পকেটে। আর আসতো সোফিয়াদি,শাশ্বতীদি, বন্দনাদি,সোনেলিদি।



ওদের কলেজে একবার মেয়েদের ক্যারাম কম্পিটিশন হয়েছিল আর আমাকে ওদের অলিখিত ক্যারাম কোচ হিসেবে মেনে নিয়েছিল কেননা আমার মাথায় তখন চ্যাম্পিয়ন্-এর মুকুট শোভা পাচ্ছে।বলা বাহুল্য ওদের কেউই প্রথম রাউন্ড অতিক্রম করতে পারে নি এবং সঙ্গে সঙ্গে কোচও খারিজ হয়ে গেল কিন্তু আমাদের বাড়িতে আমি না থাকলেও তারা বেশ মুড়ি তেলেভাজা সহকারে খুব হৈ চৈ করে ক্যারাম খেতো

 

সবথেকে মজা হত সুরমাদির দুই পুঁচকে-কে নিয়ে। আমি ওদের সামলাতে ক্যারামটা পেতে দিতাম।ওরা দুজনে তাদের কচি কচি হাতে, কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে যেখান থেকে ইচ্ছা মেরে সব উলট পালট করে দুজনেই বোর্ডে শুয়ে পাউডার মাখত।তাদের এই সরল বাল্যখিল্য উচ্ছলতার হাস্য মদিরতা আমায় খুব আনন্দ দিতো। পাশের দোকান থেকে এক পয়সায় বত্রিশটা গোল গোল রঙিন লেবেনচুস কিনে এনে দিতাম আর নিজেও দু তিনটা খেয়ে নিতাম

 

ক্যারাম খেলার সংক্রামক ব্যাধি ক্রমশঃ আমাদের দোতলায় কমল চৌধুরীর বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়ল।ওর ছেলে ছোটন আমার দারুণ বন্ধু।ওদের তখন রমরমা ব্যবসা।মধুক্ষরা তখন রাসবিহারী মোড়ে কলকাতার সব থেকে ভালো মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান যার একটা মিষ্টির নাম স্বয়ং সত্যজিৎ রায় নিজে দিয়েছিলেন- নিখুঁতী আর তার পাঞ্চ লাইনও তিনি লিখে দিয়েছিলেন,চাঁদেও খুঁত নিখুঁতী নিখুঁত সত্যজিৎ রায় তাদের আত্মীয় ছিলেন।মধুক্ষরা নামটাও তার দেওয়া। দোতালাটা ছিল এক আজব চিড়িয়াখানা।সাপ,ব্যাঙ কচ্ছপ, খরগোশ,কাঠবিড়ালি, কুকুর,বিড়াল,হরেক রকম মাছ আর ছিল রঙ বেরঙের পাখি।ছোটনের ছয় দিদি।ছয় জনই ব্রিলিয়ান্ট।সবাই গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের আর্টিস্ট।বিরাট ড্রয়িং রুমে বসে কেউ বাটিক করছে, কেউ ছবি আঁকছে, কেউ মনিপুরী নাচছে, কেউ এক থালা কাদা মাটি নিয়ে কী একটা বানাচ্ছে আর কেউ হারমনিয়ম নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে।বড় দিদির একমাত্র বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মেটাল বক্সের এমডির সাথে।ভীষণ সফিস্টিকেটেড সুট টাই পরে একটা হুড খোলা লাল রঙের হেরাল্ড গাড়ি নিয়ে আসতো।ঢেউ খেলান চুল মুখে একটা পাইপ কালো পাম্প শু।

সুমনদাকে খুব চেপে ধরাতে একদিনেই একটা ম্যাচবোর্ড চলে এল।সুমনদা হচ্ছে ছোটনের দাদা। ভীষণ ইন্টেলিজেন্ট আর উত্তম কুমারের মতো দেখতে।সন্ধ্যে বেলায় মিষ্টির দোকানে বসত সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে।জানত আমি খুব ভয় পাই সাপ ,তাই পাঞ্জাবির পকেটে একটা ছোট্ট সবুজ লাউডগা সাপ খাঁচা থেকে এনে টুক করে পকেট থেকে বার করে ক্যারাম বোর্ডে ছেড়ে দিত আর আমি বাবারে মারে করে লাফ দিয়ে ওপর থেকে নিচে পালাতাম

আমার ক্যারামের নেশা বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অন্যের বাড়িতেও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লো।আমরা তখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছি।আমার বন্ধুরা সব ডাক্তারি পড়ছে আর আমি একমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং।সারাটা সন্ধ্যা একদম বসন্তের বাতাসের মতো অনন্ত হয়ে বয়ে চলেছে। মোহনবাগানের খেলা দেখে নিজামে বিফ রোল খেয়ে চলে আসতাম বন্ডেল রোডে বন্ধুর বাড়ি।সারারাত্রি ধরে পড়তে বসার আগে  সন্ধ্যে বেলায় সলতে পাকানো হতো ক্যরামের আসর পেতে।সঙ্গে আসতো সব দারুণ দারুণ খাবার।তবে সব থেকে ইন্টারেস্টিং ছিল দাদামনি।দাদামনি তখন আইআইএম-এ পড়ছে।মাঝে মাঝেই চলে আসতো।আমাদের ক্যারাম খেলতে দেখলেই লাফিয়ে এসে বলতো, এই তো আমি এসে গেছি।

দাদামনি আদ্যপান্ত পড়াশোনায় দুর্দান্ত এক নিপাট ভালোমানুষ চিরকালের টপার আর ভুলেও কোনোদিন খেলাধুলা করে নি।ছোটবেলা থেকেই আমাদের স্কুলের নামকরা ছাত্র।হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করে চলে যায় প্রেসিডেন্সিতে। অংকে অনার্স। রেকর্ড মার্কস নিয়ে আইআইটি।তারপর এখন জোঁকা।এমন নয় যে শুধুই পড়াশুনো।ক্লাসিক্যাল গানে মেডেলে মেডেল বাড়ি ভর্তি।এ হেন দাদামনি ক্যারাম খেলতে বসলে তাকে পার্টনার নেওয়াটা বিরাট রিস্কি।দাদামনির হাতে সবসময় একটা বই।কখনো জেমস জয়েসের ইউলিসিস, কখনও কাফকার মেটামোরফসিস ,আলবার্তো কামুর আউটসাইডার কিংবা কালকূটের কোথায় পাব তারে,  না হলে নিদেন পক্ষে টিনটিন কিংবা জাদুকর ম্যান্ড্রেক।দাদামনি খেলতে বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়েই যেত খেলার যে কী গতি প্রকৃতি কোনো হুশ নেই।আমি নাম দিয়েছিলাম আইআইটির প্রফেসর মুখার্জী।যখন ওর দান আসত সবাই মিলে বলতো, দাদামনি এবার তোমার চাল।

তো দাদামনি বই থেকে মুখ তুলে সারা বোর্ড গম্ভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞাসা করতো, আমাদের যেন কী? সাদা না কালো?

আমরা বলতাম, সাদা। তোমার বেসে ওই গুটিটা ঝুলছে ওটা ফেলে দাও।

দাদামনি বলতো, ওসব ফেলে কোনো লাভ নেই বুঝলে রেড টা কোথায়। রেড যদি ফেলে দিই তাহলে একেবারে পাঁচটা গুটি ফেলার সমান।এটা হচ্ছে ম্যানেজমেন্ট থিওরি।পাঁচটা গুটি ফেলার থেকে একটা ফেললেই সব কাজ শেষ।

বলেই পাশে রাখা বাটি থেকে এক চামচ মুড়ি খেয়ে বাঁ হাত দিয়ে অদৃশ্য না ওঠা গোঁফের কোণায় একটু হাত বুলিয়ে মান্না দের " কেন এতো সুন্দরী হলো" গাইতে গাইতে  অনেকক্ষণ ধরে তাক করে রেড টাকে মারতো এবং অবধারিত ভাবে সেটা তো যেতই না পকেটে বরং অপনেন্টের হাতের কাছে জুলজুল করে পৌঁছে যেতো।তাতে অবশ্য দাদামনির কিছু এসে যেত না কারণ সে ততোক্ষণে আবার গভীর মনোযোগে ইউলিসিসে ফিরে গেছে।

মাসিমা এসে বলতো, আরে তুই তো মাংসের চপটা খাসই নি কখন দিয়ে গেছি।দে আবার গরম করে নিয়ে আসি।

আমার এই উদাসীন বাউলের খেলা খুব মজা লাগতো আর যেহেতু অন্যরা কেউ তাকে পার্টনার নিতে চাইতো না। বেছে বেছে আমাকেই ধরতো। বলতো, আমি অরুণের পার্টনার হবো।

আমি সানন্দে রাজি হয়ে যেতাম।গান শোনার সাথে সাথে উপরি পাওনা হিসাবে আমরা শুনতে পেতাম সব কাহিনী।

আচ্ছা দাদামনি আলবার্তো কামুর সাথে প্যারিসে জ্য পল সর্ত্রের একবার দারুন ঝগড়া হয়েছিল না সেটা একটু বল না।

দাদামনি তখন বইটা বন্ধ করে সদ্য না ওঠা গোঁফে একটু তা দিয়ে মুচকি হেসে বলতো, বুঝলে একবার হলো কী....

 

এরপর আমাদের আরো উত্তরণ হলো। বাড়ি চেঞ্জ হয়ে আমরা আসর বসাতাম রিপন স্ট্রিট।ওখানে খোকনদের চারতলা নার্সিং হোম বেশ বিখ্যাত।একতলা দোতলা নার্সিং হোম আর চারতলায় খোকনের বিশাল শোবার ঘর।তার সাথে একটা লাগোয়া পড়বার জায়গা।আমি আর খোকন গিয়ে কিড স্ট্রিটের মোড়ে জে.কে স্টোরস থেকে বিরাট ম্যাচ বোর্ড কিনে আনলাম।ওর পড়ার ঘরে রোজ আমাদের সান্ধ্য আসর বসত।খোকনের চার সেন্ট জেভিয়ার্স-এর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু।নামগুলোও ছিল সাংঘাতিক।ভজা, ভূতো, মদনা আর পেলু।চারজনেই ওই পাড়াতেই থাকবাই ব্রিলিয়েন্ট।দুজনে আইআইটি খড়গপুর পড়ে।আর একজন আইআইএম।আর পেলু এনআরএস।ভজার সব সময় ধান্দা কী করে আমেরিকা পৌঁছনো যায় সব সময় ইয়াংকি ইংরেজিতে ঠাঁই ঠুই করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইউ নো বলে একটা শট মারতো।এখন নাসায় বিশাল চাকরি করে।মদনার লক্ষ্যই ছিল আইআইএমে ফিনান্স নিয়ে পড়বে আর ওখানেই প্রফেসর হবে।সাংঘাতিক আই কিউ 160-এর ওপর প্রচন্ড ইন্টেলেকচুয়াল।বসে বসে এক মনে স্টেটসম্যনের শক্ত শক্ত ক্রসওয়ার্ড পাজলগুলো সলভ করতো, মুখে একটা পাইপ নিয়ে ভূতোর সাথে দাবা কিংবা কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলতো।সারা ঘর সিগারেট চারমিনারের ধোঁয়ায় ভরে থাকতো।খোকন একাই খেত প্রায় একশর ওপর সিগারেট।মাঝে মাঝে মাসিমা আসতেন পান খেতে খেতে, এক ট্রে চা নিয়ে পেছনে শশধর। কোনোদিন শিক কাবাব কোনোদিন শাম্মী কোনোদিন গরম গরম সিঙ্গাড়া আর পায়েস। মাসিমার ডিব্বে থেকে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পরে পান খেত।খোকনের ছিল অসম্ভব ভালো টিপ।ও আবার তর্জনী দিয়ে খেলত।একদম সরলরেখা বরাবর আস্তে করে মারত স্লো মোশনে সোজা পকেট।ওকে হারানো ভীষণ মুশকিল।দাবাতে ওকে কেউ হারাতেই পারে নি।আর ব্রিজ আর মদনা মাত করে রাখতো।মাঝে মাঝে আসতো ভজার সুন্দরী বোন।এসেই বলত, আমাকে নিতেই হবে ক্যারাম খেলতে।

না নিলে বোর্ডটা পুরো ঘেঁটে দিয়ে চলে যেত।এই বাড়িতেই অনেক চারি চক্ষুর মিলন হয়েছে এই ক্যারাম বোর্ডের কল্যাণে।ঘাপুদার সঙ্গে ভজার বোনের,মদনার সাথে ইন্দ্রানীর, সুবীরের সাথে ইশার। শেষে খোকনও বললো, আমি আর বাদ যাই কেন।

তবে নটা বাজলেই যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা।সারারাত ধরে চলবে পড়াশুনো চার তলা বলে মেসমশাই ওপরে খুব একটা উঠতেন না।উঠলেই সব দুরদার করে পেছনের দরজা দিয়ে পালাতাম।খোকন আর বাচ্চু বেইলির সার্জারি নিয়ে নিপাট ভালো মানুষের মতো  আলোচনায় মেতে উঠত। মেশোমশাইয়ের তখন দারুণ নামডাক সার্জন হিসাবে।সবাই ভীষণ ভয়ে থাকতো।যে সেন্টারে হেড এক্সামিনার হয়ে যেত তারা সব কাঁদতো।এরা দুজনেই সার্জারির ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র।মেশোমশাই ঢুকেই জিজ্ঞাসা করতেন, কী বাচ্চু কেমন আছ।কী পড়ছ।ওহ সার্জারি ভালো করে পড়।আচ্ছা বলো তো, একজন পেশেন্ট পেটে অসহ্য যন্ত্রণা আর হাই তাপমান নিয়ে তোমার কাছে এলে তুমি কী কী  চেক করবে?.....

আমি তো ভয়ে মরছি আমাকেও না আবার ডাক্তারি স্টুডেন্ট ভেবে কিছু জিজ্ঞাসা করে বসেন।

বাচ্চুকে বলতেন, কাল একটা হার্নিয়া অপারেশন আছে নীচে ছ’টায় চলে এসো

খোকন তো রোজই তিন চারটে অপারেশন সকালেই করে কলেজে যেত।যখন ওদের ফাইনাল ইয়ার এসে গেল তখন আমাদের ক্যারাম খেলাটাও আস্তে আস্তে উঠে গেল


 

এর পর অনেকদিন হয়ে গেল জীবনে আর ক্যারামে হাত পড়ে নি।পরের জেনারেশন ক্যারাম টেরাম খেলার মতো ওদের সময় নেই জানলোই না এর মাঝে কী মধু আছে! ততোদিনে সব বন্ধুরা যে যার স্বপ্ন পূরণ করে কেউ কলকাতায় কেউ বিদেশে দারুণ নাম করেছে

একদিন অনেক রাত্রি বেলায় বাচ্চু আর আমি বেরিয়েছি পান খেতে বন্ডেল রোডের বাড়িতে।বাচ্চু হচ্ছে বিলেতের নামকরা সার্জন।আমার সেই ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু।ওর আবার পানের খুব নেশা।ও যখন আসে আমিও বিদেশ থেকে একসাথে আসি।বেশ রাত্রে আমরা যাই পান খেতে।পানের দোকানের পাশে দেখি বসেছে ক্যরামের আসর।ইলেক্ট্রিকের পোস্ট থেকে চুরি করা স্বল্প আলোয় একটা লড়ঝড়ে টেবিলে দারুন উত্তেজক ক্যারাম খেলা চলছে।আমি আর বাচ্চু পান চিবুতে চিবুতে দাঁড়িয়ে গেলাম।কালো শ্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরা,স্বল্প আলোয় ছেলেগুলোর চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা।গেমটা শেষ হতেই দুজন দুজনকে বললো, আমরা আর নেই তোরা খেল।

আমাদের খুব উৎসাহ দেখে বললো, খেলবেন নাকি? খেলুন না।আপনারা দুজনেই তো বাইরে থাকেন।তাই না।

আমরা ছোট্ট একটা হ্যাঁ বলে গুটি গুটি পায়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।অনেকদিন অনাভ্যাসের ফলে হাত বেশ কাঁপছে।সোজা গুটিও পকেটে পৌঁছছে না।একজন বললো, আপনার হাতটা কিন্তু বেশ পরিষ্কার অনেকদিন খেলেন নি মনে হচ্ছে।

খেলতে খেলতে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা সব্বাই কী কর।

একজন বলল সে কিসুই করে না একদম বেকার।আর একজন বলল সে পার্টি করে।একজন বলল সে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি তে ট্রাফিক পুলিশের হয়ে পয়সা কলেক্ট করে আরেকজন বলল সে সক্কাল বেলায় কর্পোরশনের পাড়ার ময়লা জড়ো করে গাড়িতে তুলে দেয়।সকাল নটার পরে তার আর কোনো কাজ নেই।দুপুর বেলায় ওড়িয়াদের সাথে বসে টোয়েন্টি নাইন খেলে আর রাত্রে ক্যারাম

 

পুরো ক্যারাম বোর্ড জুড়ে আমি সেই অন্ধকার আলোয় পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের ছায়া দেখতে পেলাম।চারটা পকেট যেন কলকাতা ,বর্ধমান, শিলিগুড়ি আর আসানসোল।আর সাদা কালো গুটিগুলো সব এরা।স্ট্রাইকার হচ্ছে এদের নেতারা যারা এদের এলোমেলো চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন কোনো লক্ষ্য নেই, ভবিষ্যৎ নেই।তবু এরা এতো খুশি।রেডটা যেন হচ্ছে সময়ের সাথে স্তব্দ হয়ে যাওয়া একটা ভয়ঙ্কর অশুভ মহাকাল।অবক্ষয়ের এক মূর্তিমান প্রতিমূর্তি। রেডটা মারতে গিয়ে টের পেলাম হাতটা দারুণ কাঁপছে। চশমাটাও ক্রমে ক্রমে কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে। ওদের বললাম, তোমারা ভাই খেল।আমরা আর পারবো না তোমাদের সাথে এই  ভয়ঙ্কর খেলা খেলতে।

 

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,
সাবক্যাটেগরিঃ প্রবাস জীবন,


অরুণ সেন

কুয়েতে কর্মরত সিনিয়র ইজ্ঞিনিয়ার



আরো পড়ুন