রাশেদ জামান
আমার প্রতিবেশী ফ্ল্যাটে চট্টগ্রামের এক পরিবার করোনার অলস সময় কাটাবার জন্য খুব শখ করে একটা ময়না পাখি পুষতে শুরু করলো।
পোষাপুষির ব্যাপারটা দুই লাইনে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
আরাম করে হাই তুলে পুরোপুরি ডানা ছড়াতে না পারা সাইজের একটা খাঁচায় ময়না পাখিটিকে থাকতে দেয়া হয়েছে বাড়ীর একমাত্র বারান্দায়। মাঝে মাঝে ভুলে গেলেও একই খাবার অল্প পরিমানে তিন বেলা দেয়া হচ্ছে বহুদিন ধরে, যা সে প্রায়ই রাগ করে ছূঁয়েও দেখে না।
আগেই বলে রাখা ভালো, প্রত্যেকটা বাঙালির মতো এই পরিবারের প্রত্যেকেরই একমাত্র প্রত্যাশা - এই ময়না পাখির মুখে তাদের শেখানো বুলি যখন তখন শোনা যাবে, যা নিয়ে করা যাবে হাসাহাসি। এ যেন জ্যান্ত একটা খেলনা কিনে আনা। পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৪৮ সালে আমাদের কাছে একই জিনিস চেয়েছিলেন মনে হয়।
কেন জানি ভাষার জন্য সংগ্রাম করা গর্বিত বাঙলিরা ময়না পাখি কিনেই একটা মাত্র কারণে- খাঁচায় বন্দী করে তাদের মুখ থেকে ওদের “ময়না ভাষা” কেড়ে নিয়ে নিজের ভাষা চাপিয়ে দেবার অদ্ভূত আনন্দে।
এমনিতে বাঙলিরা কালো মেয়েদের মতো কালো রঙ-এর পাখিদেরকেও সম্মান জানাতে পারেনি কখনো। ভাষা নকলে দ্রুত দক্ষতার কারণে ময়না পাখি সেক্ষেত্রে কোনো মতে বেঁচে গেছে।
সেও জানে রঙিলা লাভ বার্ডদের মতো “রঙ ও সৌন্দর্য” না থাকার দোষে “ভাষা সার্কাস”
দিয়ে তাকে খাদ্য ও বাসস্থান নিশ্চিত করার নিয়ম বাঙালিরা তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে বহু আগে। রঙ-রুপ না থাকার অভাবে কোনো একটা সার্কাসীয় গুণ দেখিয়ে তার অস্তিত্বকে justify করার মনুষ্য বেড়াজালে পড়ে গেছে বোকা প্রাণীটা, সেটা সে নিজেও ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সন্দেহ নাই।
করোনার শুরু থেকে লক্ষ করছি প্রতিবেশী ময়না পাখির foreign
language class প্রতিদিন প্রবল বেগে বেড়েই চলছে। বাচ্চা থেকে বুড়া - পরিবারের সকল সদস্য ভাষা টিউটররা প্রবল উৎসাহে তাদের আঞ্চলিক ভাষা ময়না পাখিকে দিনরাত শেখানোর চেষ্টা করছেন।
বেচারা আধা ঘন্টাও রেস্ট পায় না। রাতের বেলাও নিস্তার নাই। একজন না একজন শিক্ষক প্রতিনিয়ত কঠিন একটি আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষায় তরুণ ময়না পাখিকে বেশ চাপে রেখেছে।
ময়না এখনো কিছু শিখতে না পারলেও পাশের বারান্দার আমি অনেকটা শিখতে বাধ্য হলাম। শুনতে শুনতে মোটামুটি বলতে পারি বলা যায়। পাশের ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দাটা আমার এতো কাছে যে, করোনা কালে সরাসরি আমি দেখতে না চাইলেও শুনতে আমাকে হয়ই। সেটাও কোনো অংশে কম চাপ না।
একদিকে করোনার সার্বক্ষনিক মৃত্যু ভয়, অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষা - একই সাথে এই অত্যাচার চলছে দিনরাত।
এরমধ্যে দেড় বছর পার হয়ে গেল। বেচারা “কম মেধাবী” অথবা “চাপা প্রতিবাদী”
ময়না পাখি একটা শব্দও শিখে উঠতে পারলো না।
তাকে দরাজ গলায় বড় করে “আসসালামাইকুম” থেকে শুরু করে “হাইল্লে ঠিল্লে বাজে বেশি” অথবা “জামাইর কামাই ফুতি ফুতি, পুয়ার কামাই মুতি মুতি” ‘র মতো কঠিন চাঁটগাইয়া প্রবাদ প্রবচনও শেখানোর চেষ্টা হয়েছে।
এমনকি সঙ্গীত প্রশিক্ষণও বাদ যায় নাই। একজন বয়স্ক খালাম্মা বারান্দায় ফ্লোরে বসে ময়না পাখি কে প্রায়ই গুণ গুণ করে বেসুরে “কইলজার ভিতর গাঁথি রাইক্কুম তোয়ারে” অথবা শেফালী ঘোষের অন্যান্য কঠিন গান গেয়ে শোনান। বাংলা গানবাজনাতেও ময়নার কোনো রকম আগ্রহ দেখা গেল না।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে - এ বাড়িতে কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর চেহারার একজন মামা জাতীয় রাতজাগা লোক থাকতে এসেছেন, যিনি সারারাত একটু পর পর বারান্দায় বিড়ি ফুঁকতে এসে অতি উচ্চস্বরে ফোনে তার স্ত্রীর সাথে কুৎসিত চিৎকার চেঁচামেচি করেন।
ঝগড়া শেষ করে সিনেমার ভিলেনদের মতো ময়না পাখির ছোট্ট শরীরটার উপর সিগেরেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে “ঐ চু... ফুয়া”, “ঐ চু... ফুয়া” বলে সম্বোধন করেন। মাঝে মাঝে শাসানও - ঘাড় ত্যাড়া ময়নার মুখ দিয়ে বাংলা কথা (চাঁটগাইয়া) না বেরুলে নাকি “ফুন মারি” দিবেন একদিন।
ঘটনাটা নিজ চোখে কয়েকবার দেখার এবং কানে শোনার পর আমি এই বেচারা ময়নার জন্য রীতিমতো শংকিত হয়ে গেলাম। এবং এতোদিনে বুঝতে পারলাম মুখে কুলুপ আটা এই ময়নার মেধা মোটেও কম না - সে আসলে “কড়া বিপ্লবী”।
পশু পাখিদের সিক্সথ সেন্স নাকি খুবই ভালো হয়। চাঁটগাইয়া মামুর অন্য কোনো হুমকি সে ধরতে না পারলেও, “ফুন মারা”র ভয়াবহতা ঠিকই ধরতে পেরেছে। ময়নাটা তাই ইদানিং চান্স পেলেই স্বর্ব শক্তি প্রয়োগে সুযোগ পেলেই ঠোঁট দিয়ে কামড়িয়ে খাঁচা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে আপ্রাণভাবে। বেচারা বুঝতেও পারছে না - সে যে খাঁচার ভিতর বন্দী তা আসলে বারান্দা নামক বড় গ্রিলের খাঁচা, যা বসুন্ধরা নামক “রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র” ছিটমহল
খাঁচার ভিতর “বাক্সে বাক্সে বন্দী বাক্সে”অবস্থান করছে।
পাখিটার জীবনের সবচেয়ে বড় ভ্রমণ খুব সম্ভবত কাঁটাবন থেকে দোকানের খাঁচায় করে বসুন্ধরার এ বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত আসতে পারা। ময়না পাখিটা ময়না না হয়ে কাক হয়ে জন্মালে নিম্ন শ্রেণীর পাখি কোটায় এই জীবনে বেঁচে যেতো। অন্য কাকদের সাথে স্বাধীনভাবে এই নোংরা শহরের সীমাহীন আবর্জনা খেয়ে পড়ে স্বাধীন ভাবে কোনো মতে জীবনটা কাঁটাতে পারতো অন্তত। মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারার জন্মগত গুণ তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সৌন্দর্য এবং গুণাগুণ যে জীবনে অভিশাপ হতে পারে - পাখিরা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমার তীব্র সন্দেহ আছে এই ময়না পাখি জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর অন্য কোনো স্বজাতীয় পাখির সংস্পর্ষে আসতে পেরেছে কিনা। নিজের ভাষায় ভাব প্রকাশের সুযোগ কখনো পায়ই নাই মনে হয়। এখন এই হতাশাগ্রস্থ ক্লান্ত বেচারা পাখি একা একা না পারছে নিজের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে, না পারছে নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের দাবি জানাতে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে ভাবছি, আমি কি ময়নার মুক্তি এবং ভাষা আন্দোলনের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়বো?
তাহলে তো আমাকে ঐ খতরনাক মামাকে ফাঁকি দিয়ে পাশের বাসার বারান্দার গ্রিল কাঁটতে হবে। তা না হয় ঝুঁকি নিয়ে করেই ফেললাম। কিন্তু এই ময়না পাখি এই গাছহীন বিশাল বড় খাঁচা শহরে আরেকটা সঙ্গী ময়না পাখি কোথায় খুঁজে পাবে “ময়না ভাষা” শেখার জন্য?
হঠাৎ আমার বোধদয় হলো আজকে সকাল বেলা। আরেকটা ময়না পাখি খুঁজে না পেলেও সমস্যা কী?
অন্তত কালো কাঁকদের সাথে মিশে গেলেও তো অপেক্ষাকৃত কিছুটা বড় স্বাধীনতাটা মিলবে। মন খুলে চিৎকার করে “কা কা” করে মুক্তির আনন্দটাতো অন্তত জানান দিতে পারবে বায়ূদূষিত ঘোলাটে আঁধখোলা ঢাকার আকাশে।
সেটাও কি কম পাওয়া?
সিনেমাটোগ্রাফার। আর্কিটেক্ট। আয়নাবাজি মুভির সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী। টানা ছয় বছর কাজ করেছেন হলিউডের ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। স্টিল ফটোগ্রাফার হিসেবে তার তোলাছবি ব্যবহৃত হয়েছে ২০০৬ সালে বিশ্বখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘এ লিটল পিস’ পিকচার বুকের প্রচ্ছদে। আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করেছেন ইস্তানবুল, কায়রো এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে। আরো জানতে ভিজিট করুন : www.rashedzaman.com
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
ডা. আতাউর রহমান বিস্তারিত
বাংলাদেশ মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ইম.. বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
বোর্ডের চেয়ারপারসন নির্বাাচিত.. বিস্তারিত
রাশেদ জামান বিস্তারিত