English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২১-০৫-১০ ১৬:০০:১৯
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৮ ০৫:১৫:৩১


সাপ

 সাপ


রাশেদ জামান


অনেক ছোটবেলায় আমাদের খিলগাঁওের বাড়িতে তখনও দালান ওঠেনি। একতলা বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার অদ্ভুত এক শব্দ হতো। রমজান মাসে মাঝে মাঝে ধুম বৃষ্টি। গভীর রাতে বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে আম্মার কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজ ভেসে আসতো অনেক দূর থেকে। আমার মা, খালা, মামি, বড় চাচি সবাইকে দেখেছি তাঁরা সব সময় কেন জানি একটা বিলাপের সুরে কোরআন তেলওয়াত করতেন। শুনলে মনে হতো তাঁরা কাঁদছেন। তাঁদের কষ্টের কথাগুলো স্রষ্টাকে কেঁদে কেঁদে বলছেন।


বহুকাল আগে আমার শৈশবে কোনো এক রমজান মাসে, টিনের চালে বৃষ্টি এবং বিলাপের সুরে আম্মার  কোরআন  তেলওয়াতের ঘোর লাগা কোনো রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পানির পিপাশা পেয়েছিল। তখনও বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে ওয়াটার ফিল্টার নামক কোনো বস্তুর আগমন ঘটেনি। আমরা নির্দ্বিধায় রান্না ঘরের পানির কল থেকে সরাসরি ওয়াসার পানি খাই।

সেহরি শেষ। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ভোরের আলো ফুটবে। আমি রান্নাঘরে পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। দেখি একটা মাঝারি সাইজের সাপ কুণ্ডলী পাঁকিয়ে রান্নাঘরে গ্যাসের চুলার নিচে শুয়ে আছে। বিটিভিতে সপ্তাহে একদিন টারজান দেখার সেই বয়সে আমার চোখে সব সাপই তখন ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ। 

আমরা তখনও এতো আধুনিক হই নি। আমাদের বাড়িতে  নতুন আসা গ্যাসের চুলার উচ্চতা লাকড়ির চুলার মতো মাটি থেকে সামান্য উপরে। আমি সেই গ্যাসের চুলার নিচে জলজ্যান্ত একটা সত্যিকারের সাপ দেখে প্রাণপণে চিৎকার দিলাম, আওয়াজ বেরুচ্ছিল কি না বুঝতে পারছিলাম না।

মুখ দিয়ে আওয়াজ না বেরোলেও ভয় পাওয়া মাত্র আম্মা কীভাবে  যেন সব সময় টের পেতেন। আম্মা দৌড়ে ছুটে আসলেন। ভয়ে নীল হয়ে যাওয়া আমাকে দেখে মনে হয় একটু মজা পেলেন, মৃদু হাসলেন। আশ্বস্ত করলেন আমি যেন ভয় না পাই। আমি হতভম্ব হয়ে ভাবছি আস্ত একটা সাপ আমাদের ঘরে, আমরা ভয় পাবো না? ও যদি এক্ষুনি কামড় দেয়।

আমাদের একতলা টিনশেডের পাঁকা বাড়ির রান্নাঘরের ইটের দেয়ালের এক কোনায় বড় একটা ছিদ্র ছিল, যে ছিদ্র দিয়ে পানির পাইপ এবং সদ্য আসা গ্যাসের পাইপ ঢুকতো। দুই পাইপ যাওয়া সত্বেও বেশ কিছুটা অংশ তারপরও ফাঁকা ছিল। 

আম্মা বললো বৃষ্টির রাতে যখন সাপের গর্তে পানি ঢুকে যায় তখন নাকি এই সাপটা এসে আমাদের গ্যাসের চুলার ঠিক নিচে অপেক্ষাকৃত গরম কালো সিমেন্টের ফ্লোরে কুন্ডলী পাঁকিয়ে শুয়ে থাকে। পরে দেখেছি মাঘের শীতেও সাপটা নিয়মিত একই জায়গায় একই কাজ করতো। তারপর ভোর হলে নিজে নিজেই সেই গর্ত দিয়ে বাইরে চলে যেত।

আমি অবাক বিস্ময়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই সাপটা কে আমরা মারবো না? 

আম্মা বললেন, “ও সাপ হইয়া জন্মাইছে - ঐটা কি আর ওর দোষ? সবচেয়ে বড় কথা ও তো কারো ক্ষতি করতেছে না। এই বৃষ্টি অথবা শীতের রাতে ওর আর কোনো আশ্রয় নাই বইলাইতো আমার কাছে আসে।”

আমি পরে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, আম্মা প্রতি রাতেই, এমনকি বৃষ্টি না হলেও গ্যাসের চুলার কাছে এক বাটি গরুর দুধ রেখে দিতেন। এরপর সাপটা নিয়মিত আসতো, দুধ খেতো, গ্যাসের চুলার নিচে ঘুমাতো এবং সকালে চলে যেতো। আমিও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ঘুম ঘুম চোখে প্রায়ই পানি খেতে রান্নাঘরে যেতাম। কিছুদিন পরে লক্ষ করতে ভুলে গেলাম আমার “সাপ ভাই” চুলার নিচে আছে কি নাই। 


আমি অনেক পরে একদিন আমাদের ছোট্ট বাগানে আমার নানার লাগানো হাসনাহেনা গাছের নীচে সাপটার বদলানো খোলস পেয়েছিলাম। সেটার সূত্র ধরে অনেক কষ্টে ওর গর্তটাও খুঁজে বের করেছিলাম, এখন যেখানে খিলগাঁও বিশ্বরোড সেখানে। 

আম্মা আমার এই ঝুঁকিপূর্ণ গোয়েন্দাগিরির খবর জানার পরও নিশ্চিত ছিলেন যে, এই সাপ কখনোই তাঁর সন্তানদের কোনো ক্ষতি করবে না।


গতকাল শবে কদরের রাতে প্রায় তিন দশক পরে হঠাৎ আম্মার বিলাপের মতো কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আবার। এখন আমরা আধুনিক কংক্রিটের অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। ঝড়, বৃষ্টির আওয়াজ এখন আর আম্মার কোরআনের তেলওয়াতের আওয়াজের সাথে মিশে না। একদমই না। পাল্লা দিতে গিয়ে হেরে যায়।

আমি তবুও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আম্মাকে দেখি, আম্মার কোরআন তেলওয়াত শুনতে থাকি। এই বিলাপ আমার কানে অনেক মধুর লাগে। 

হঠাৎ করে এতো বছর পর গতকালই সাপটার কথা মনে পড়লো। ও আম্মার কাছে এতো নির্ভয়ে কীভাবে আসতো? কেন আসতো? ওর কি মা ছিল না? আম্মা এতো পরম মমতায় কেন ওর জন্য প্রতিরাতে এক বাটি দুধ রেখে দিতো?

আমার ঘুমের ঘোর কোনো মতেই কাটছিল না।

সাপেরও কি মায়ের মমতা লাগে? অথবা মানুষ মায়েরা কি একটা সাপকেও প্রয়োজনে সন্তানতুল্য মমতা দিতে কার্পণ্য করেন না?

আমরা এখন রান্নাঘরকে কিচেন বলি। আচমকা মনে হলো দেখিতো আমাদের কিচেনে পাশ্চাত্য উচ্চতায় থাকা আধুনিক গ্যাসের চুলার নিচে কোন সাপ আছে কি না! থাকতেও তো পারে। 

ততক্ষণে ঘুমের রেশ বেশ কিছুটা কেটে গেছে। মনে পড়লো আমরা এখন এয়ার কন্ডিশনের সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র পাঁচতলা কংক্রিট অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করি। 


এখানে আশ্রয়হীন নি:সঙ্গ কোনো সাপ মায়ের মমতা পেতে, চাইলেও আসতে পারবে না।


(হঠাৎ করে এ গল্প কেন বললাম, নিজেও জানি না। আমার আম্মা এখন সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। গতকাল শবে কদরের রাতে হঠাৎ মনে হলো পাশের ঘরে আম্মা তাঁর সেই বিলাপের সুরে কোরআন তেলওয়াত করছেন।)



 

ছবি: লেখক

 

 



ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


রাশেদ জামান

সিনেমাটোগ্রাফার। আর্কিটেক্ট। আয়নাবাজি মুভির সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী। টানা ছয় বছর কাজ করেছেন হলিউডের ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। স্টিল ফটোগ্রাফার হিসেবে তার তোলাছবি ব্যবহৃত হয়েছে ২০০৬ সালে বিশ্বখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘এ লিটল পিস’ পিকচার বুকের প্রচ্ছদে। আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করেছেন ইস্তানবুল, কায়রো এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে। আরো জানতে ভিজিট করুন : www.rashedzaman.com