English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২১-০২-০২ ০১:০৮:৫২
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৫ ০৬:০০:২৬


ফেয়ারনেস ক্রিমের সেকাল একাল

ফেয়ারনেস ক্রিমের সেকাল একাল


মুস্তাকিম আহমেদ

থোর বড়ি খাড়া

খাড়া বড়ি থোর

পণ্য বিক্রি করার একটা উপায় হচ্ছে ক্রেতার চাহিদা খুঁজে বের করা, আরেকটা উপায় `চাহিদাসৃষ্টি করা মুনাফা লোভী বহুজাতিক কোম্পানিরা এই আরোপিত চাহিদা আবিষ্কারে ভীষণ পটু মুহুর্মুহু বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে প্রয়োজন নেই এমন পণ্য কিনতে লালায়িত করে

একটা গল্প শোনা যাক

আত্মবিশ্বাসের অভাবে একজন নারী চাকরি পান না এই মানসিক ব্যমোর কারণ-গায়ের রঙ তার গায়ের রংময়লা তিনি একটা জাদুকরী(?)ক্রিম পেলেন, ব্যবহার করলেন, রঙপরিষ্কারহলো, তিনি চাকরিও পেলেন!

এই কিম্ভূত গল্পটা বিজ্ঞাপনেরবিজ্ঞাপনটা একটা রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের

এবার আমরা চলে যাবো বিংশ শতাব্দীর শুরুতে

রাজস্থানের একটা ছোট্ট এলাকা থেকে এক তরুণ বোম্বে শহরে (আজকের মুম্বাই) পা রাখেন তার নাম সুলতান আলি পাটানওয়ালা পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা দিয়ে তিনি ১৯০৯ সালে গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান   এস পাটানওয়ালা

পাটানওয়ালা বিক্রি করতেন চুলের তেল এবং সুগন্ধি তার সৃষ্টি তদানীন্তন ইংরেজ সমাজ এবং ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যের রাজকন্যাদের মন জয় করে নেয়

নড়বড়ে ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে তিনি চলে যান ইওরোপে প্রসাধন তৈরিতে ইওরোপ সেরাদের কাছ থেকে তিনি প্রশিক্ষণ নেন ভারতে ফিরে সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পাটানওয়ালা তৈরি করেন একটা নতুন ক্রিম সেই ক্রিমের বোতল আসতো জার্মানি থেকে আর লেবেল জাপান থেকে ক্রিমটার তখনো নামকরণ হয় নি আফগানিস্তানের রাজা জহির সেবার ভারতে এসেছেন পাটানওয়ালা তার কোম্পানির বিভিন্ন পণ্যের সাথে এই ক্রিমটাও রাজাকে উপহার দেন সাদা রঙের ক্রিম দেখে রাজা জহিরের নিজ দেশ আফগানিস্তানের তুষারের কথা মনে পড়ে যায়

রাজার অনুমতি নিয়ে পাটানওয়ালা তার ক্রিমের নাম দেনআফগান স্নো

ভারত তথা পৃথিবীর ইতিহাসে বাণিজ্যিক ভাবে প্রস্তুতকৃত প্রথম রং ফর্সাকারি ক্রিম হিসেবে আফগান স্নো বাজারে আসে ১৯১৯ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় বয়কট করার জন্যবিদেশি পণ্যহিসেবে আফগান স্নো- নাম লিপিবদ্ধ করা হয় অবস্থা বেগতিক দেখে পাটানওয়ালা মহাত্মা গান্ধীকে চিঠি লিখেন তিনি আফগান স্নো সম্পূর্ণ রূপে ভারতীয় পণ্য, তা বোঝাতে সমর্থ হন পরবর্তীতে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী পত্রিকায় লিখে আফগান স্নো-কে ভারতীয় পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেন ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথমমিস ইন্ডিয়া  প্রতিযোগিতার স্পন্সর ছিল আফগান স্নো


১৯৭৫ সাল

হিন্দুস্তান লিভারস (এখনকার হিন্দুস্তান ইউনিলিভার) ভারতের তামিলনাড়ুতে তাদের একটা প্রায় ফেলনা ক্রিম নিয়ে পরীক্ষা চালায় সেই পরীক্ষার আশ্চর্য ফলাফলে হিন্দুস্তান লিভার্সের কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেন ১৯৭৫ সালের মার্চে বাজারে আসে তাদের রং ফর্সাকারি ক্রিম, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি

নেলসনের গবেষণা মতে ভারতে বর্তমানে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বাজার মূল্য ,২০০ কোটি রুপি নেলসন আরো জানাচ্ছে ভারতে প্রতি ১০ জন নারীর জন ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্যাবহার করেন সেখানে ২০ কোটি বাড়িতে এই ক্রিম মজুদ থাকে

বাংলাদেশের বাজার নেহাত ছোট নয়

বাংলাদেশ কসমেটিক্স এন্ড টয়লেট্রিস ম্যানুফেকচারারসঅ্যাসোসিয়েশন (বিএসটিএমএ)-এর পরিসংখ্যান মতে ১৫ বছরে (২০০০-২০১৫ সাল) ১৫০০ কোটি টাকার ধরনের পণ্য, বাংলাদেশে বিক্রি হয়েছে ২০২০- ত্বকের যত্নে ব্যবহার করা হয় এমন পণ্যের বাংলাদেশের বাজার মূল্য দাঁড়ায় .২৩ বিলিয়ন ডলার

২০২০ এর মে মাসে আমেরিকাতে পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু হয় তিনি ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ তার মৃত্যুর পরপরই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী সরব হয়ে উঠে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার হুংকারের ধাক্কা লাগে প্রসাধন তৈরি করা কোম্পানিদের গায়ে ল’অরিয়েল, ইউনিলিভার, জনসন অ্যান্ড জনসনের মতো নামজাদা কোম্পানিরা তাদের বিপণন কৌশলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয় অরিয়েল, ইউনিলিভার তাদের যেসব পণের গায়ে  সাদা, ফর্সা এমন শব্দ ছিল তা দ্রুত পাল্টে ফেলে। জনসন অ্যান্ড জনসন আরেকটু সচেতনতা দেখিয়ে তাদের রং হালকা, ফর্সা করে এমন সমস্ত পণ্য বিক্রি চিরতরে বন্ধ করার ঘোষণা দেয় 

২০২০-এর জুলাই ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি তাদের ৪৫ বছরের পুরনো নাম

পাল্টায়, কিন্তু...

থোর বড়ি খাড়া

খাড়া বড়ি থোর

ফেয়ার এন্ড লাভলিএখন নাকিগ্লো এন্ড লাভল’! শুধু নাম পালটে গেছে, ক্রিমের উপাদান নয় রঙ ফর্সাকারী ক্রিমে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোকুইনোন, মার্কারির মতো বিপদজনক উপাদান ত্বক বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন বেশিরভাগ ব্যবহারকারী জানেন না তারা কী মাখছেন

হাইড্রোকুইনোন আমাদের ত্বকের উপরিভাগ একদম ক্ষয় করে ফেলে যা ক্যান্সার সৃষ্টি করেহাইড্রোকুইনোন লিভার এবং কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে মারকারি জীবন সংশয় হওয়ার মত শারীরিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে সক্ষম ধরনের ক্রিম ব্যবহারে আরো যেসব সমস্যা হতে পারে তা হলো- মুখের ত্বকের স্বাভাবিক রঙ নষ্ট হওয়া, মারাত্মক ব্রণ, মুখমণ্ডলে অবাঞ্ছিত লোম, সূর্যের আলোতে যেতে না পারা, ক্যান্সার ইত্যাদি

তাই আর এমন ক্রিম নয়

সুরা রুমের একটা আয়াতে মনোযোগ দেই-

তাঁর মহিমার নিদর্শন হচ্ছে মহাকাশ পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা

বর্ণের বৈচিত্র্য এতে অবশ্যই জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে

সুরা: রুম  আয়াত:২২

 

অন্য কারো মতো হওয়ার প্রয়োজন নেই আমাদের বৈচিত্র্যই আমাদের

সৌন্দর্য,পরিচয়

 

আসুন এই বৈচিত্র্য নিয়ে গর্বিত হই


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


মুস্তাকিম আহমেদ

শিক্ষক ও সমাজকর্মী