বিজয়
মজুমদার
ভাই, কাকে ভোট দেবেন? প্রশ্নটা ছিল আমার এক ছোট ভাইয়ের।
প্রশ্নটা আমাকে নিদারুণ ভাবিয়ে তুলেছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ভোট দেওয়া আমার কর্তব্য। সারা দেশের মতো দিনাজপুরে ঘনিয়ে আসছে পৌর নির্বাচন। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে একদফা নির্বাচন হয়ে গেছে। ভোট যে ক্রমশ এগিয়ে আসছে সেটা টের পাচ্ছি নানান আওয়াজে। দুপুরের ভাতঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে যাওয়া নানাবিধ স্লোগান জানিয়ে দিচ্ছে, আমরা ঘুমিয়ে থাকলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা নির্ঘুম। দৃষ্টিনন্দন পোস্টারে ছেয়ে গেছে আমাদের এই মফস্বল শহর।
ভোটে অংশ না নিলেও ভোটের উত্তাপ প্রথম টের পেয়েছিলাম এই পৌর নির্বাচনেই । তখন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়। স্কুলের ছাত্র। মফস্বলে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আমাদের পাড়ার সিনিয়ররা একত্রিত হয়ে রীতিমতো মিটিং করে প্রার্থী চূড়ান্ত করলেন। তিনি অবশ্য আমাদের পাড়ার নন। কারণ আমাদের পাড়াটা বেশ ছোট । বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান যেমন, দিনাজপুরের মানচিত্রে আমাদের পাড়ার অবস্থান ঠিক সে রকম। নামটাও বেশ কৌতূহল তৈরি করে। যখন কাউকে বলতাম দিনাজপুরের অমুক পাড়ায় আমার বাড়ি; তখন সেই ব্যক্তিটি হেসে বলতেন, ‘তোমাদের বুঝি খুব ফুটানী!’ কারণ আমাদের পাড়ার নাম ছিল ফুটানীপাড়া।
আকারে অতি ক্ষুদ্র বলে পাড়া থেকে নির্বাচনে কেউ দাঁড়াতেন না। আর চেয়ারম্যান পদপ্রার্থিতা দিল্লি এখনো অনেক দূরের মতো বিষয় ছিল। এর কারণ আমাদের পাড়ায় ১২টি বাড়ির ২৪টি ভোট ! এই পরিমাণ ভোটার নির্বাচনী বৈতরণী পার করা তো দূরে থাক জামানত বায়েজাপ্ত ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। আর সে ক্ষেত্রে বিকল্প প্রার্থীকে সমর্থন যোগাতো এই পাড়া। সেবার নিকটবর্তী পাড়ার প্রার্থীকেই নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিলেন পাড়ার মুরুব্বিরা।
নিয়ম অনুসারে আমাদের প্রার্থীও একদিন ভোট ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হলেন পাড়ায়। আমরা ছোটরা, মার্কা কী ভাই মার্কা কী? বলে বেশ কিছুক্ষণ স্লোগান দিলাম। নির্বাচনে দাঁড়ানো বেশির ভাগ প্রার্থী অবশ্য আমাদের পাড়ায় ভোট চাইতে এলেন । যারাই জনসংযোগ-এর জন্য পাড়ায় আসতেন আমরা তাদেরই মার্কা ধরে স্লোগান দিতাম। স্লোগান দেওয়ার এই খেলায় একদিন আমরা একটা দারুণ চমক পেলাম। কমিশনার পদপ্রার্থী একজন আমাদের দলনেতার হাতে একশো টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আর সে টাকা পাওয়া মাত্র আমার কাচারীতে গিয়ে ফারুকদের হোটেলের পরোটা মাংস সাটিয়েছিলাম। সেই প্রথম নির্বাচনকে দারুণ অর্থবহ মনে হয়েছিল।
আমাদের প্রার্থী মানে পাশের পাড়ার বড় ভাই অনেকটা নির্ভার ছিলেন যে এই ভোট যুদ্ধে তিনি জিতেই যাচ্ছেন। আমরাও নিশ্চিত ছিলাম যে আগামীতে তিনি হতে যাচ্ছেন আমাদের পড়ার তথা ওয়ার্ডের কমিশনার (এখনকার হিসেবে কাউন্সিলর)। নিশ্চিত থাকা সত্ত্বেও তিনি চুপচাপ বসে ছিলেন না। জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে পরামর্শ করেছেন। মুরুব্বীদের দোয়া চেয়েছেন। নির্বাচিত হলে কীভাবে পাড়ার তথা এলাকার উন্নয়ন করবেন সে বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারা তুলে ধরেছিলেন।
দেখতে দেখতে ভোটের দিন এসে গেল। সারা দিনাজপুর জুড়ে সাজ সাজ রব। যদিও চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নির্বাচন একসাথে হয়েছিল কিন্তু আমাদের আগ্রহটা আগাগোড়া ছিল কমিশনার নির্বাচনকে ঘিরে। ভোটকেন্দ্র বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না। ছোট হলেও নির্বাচন কেন্দ্র যাবার স্বাধীনতা ছিল। ভোট গ্রহণও শান্তিপূর্ণ ভাবে হলো। আমরাও আশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ভোট তো হলো এবার ফলাফলের পালা।
ভোট গণনার পরের দিন আমাদের প্রার্থী আমাদের গরু জবাই করে ভুরি-ভোজ করালেন। তবে বিজয়ী প্রার্থী হিসেবে নয় পরাজিত প্রার্থী হিসেবে। নির্বাচনে তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। পরাজিত হয়েও তিনি তাঁর সমর্থকদের জন্য এই বিশেষ খাবারের আয়োজন করেন। শোকমঞ্চে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটি এখনো আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচনে ফুটানীপাড়া ছিল আমাদের যমজ ভাই, আর শত্রু বাস করেছিল আমাদের নিজেদের মাঝে। তাই আমি আজ পরাজিত। নির্বাচনে আমি যেন জবাই হয়ে গেছি।“
তাঁর সেই বক্তব্য বেদনার মাঝেও সামান্য হাসির সৃষ্টি করেছিল। কারণ নির্বাচনে তাঁর মার্কা ছিল গাভী। সে সময়ে আমার মনে হয়েছিল, “শত্রু যখন নিজ দলে আপনজন হয়ে অবস্থান করে, তখন কোনো যুদ্ধই জেতা সম্ভব নয়।“
আমার ভোট আমি দেব,
কিন্তু আমি কাকে দেব?
আমার স্কুলের বন্ধু দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলো। সেই যে নির্বাচনের উত্তাপ গায়ে মেখেছিলাম এরপর আর কোনো পৌর নির্বাচন এ ভাবে যুক্ত হওয়া হয় নি। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে কোনো পৌর নির্বাচনে আমি ভোট দিই নি। এবার ভোটের ডামাডোলে বন্ধুর প্রশ্ন আমাকে অতীত থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো।
কাউন্সিলর এবং পৌর পিতার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী প্রার্থীদের পোস্টার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এবারের নির্বাচন আমার জন্য অন্য এক কারণে গুরুত্বপূর্ণ আর সেটি হচ্ছে প্রায় চিরস্থায়ী ভাবে বাস করার জন্য দিনাজপুরে ফিরে আসা। কাজে এই পৌর নির্বাচন আমার জন্য যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি করেছে।
প্রথমে জানার চেষ্টা করলাম পৌর কাউন্সিলার পদে কে কে দাঁড়িয়েছে। পৌর কাউন্সিলার পদটি রাজনৈতিক দলের প্রতীকের সাথে যুক্ত নয়। মানে দলীয় রাজনীতি না করেও যে কেউ কাউন্সিলার পদে দাঁড়াতে এবং রাজনৈতিক দলের মার্কা সাধারণত কাউন্সিলরদের দেওয়া হয় না। অতীতে চেয়ারম্যান পদে একই নিয়ম থাকলেও বর্তমানে পৌর নির্বাচনের মেয়র প্রার্থীকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হয়। যার ফলে মার্কা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।এখন প্রশ্ন হচ্ছে কাউন্সিলর পদে আমি কাকে বেছে নেব আর নগর পিতা হিসেবে কাকে ভোট দেব?
আমার এলাকায় কাউন্সিলার হিসেবে যারা দাঁড়িয়েছে প্রথম দর্শনে এদের বেশির ভাগকে কেমন যেন অপরিচিত ঠেকলো। কিন্তু যখন ভোটপ্রার্থী হিসেবে তারা দুয়ারে এসে কড়া নাড়লো তখন জানলাম এরা প্রায় সবাই আমার পরিচিত। কাউন্সিলর প্রার্থীদের সবাই প্রায় বয়সে তরুণ বলে প্রথম দর্শনে এদের চিনতে পারি নি। কারণ এদের অনেককেই ছোট বেলায় ছোট ভাই হিসেবে পেয়েছি। ছোট ভাই হিসেবে দেখছি সবার দাবি অগ্রগণ্য।ভাবলাম পৌর মেয়র হিসেবে কোনো একজনকে বেছে নেওয়া হয়ত সহজ হবে। সেখানে দেখি আরও মুশকিল! এখানে মার্কা ধরে উল্লেখ করি যেহেতু মার্কার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রথমে আসা যাক কাস্তে মার্কায়। এই প্রতীক নিয়ে যিনি দাঁড়িয়েছেন তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক মামা ভাগিনার। তিনি আমার মামার বন্ধু। ছোটবেলা থেকে তাঁর বিশেষ স্নেহ পেয়েছি। সেটি বড়বেলায় বিন্দুমাত্র কমেছে বলে মনে হয় নি। কাজে তিনি আমার কাছে একটি ভোট দাবি করতেই পারেন।
এবার আসি লাঙ্গল মার্কায়। এই প্রতীক নিয়ে যিনি দাঁড়িয়েছে, আক্ষরিক অর্থেই আমি তাঁর ঘাড়ে চড়েছি। ১৯৮৫ সালে জাতীয় শিশু পুরষ্কার প্রতিযোগিতায় দিনাজপুর জেলার যে দলটি রাজশাহী গিয়েছিল, সেই দলে আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য। ছোট বলে দলের একজন সিনিয়র সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন যেন আমার কোনো অসুবিধা না হয়। পৌর নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে এবার তিনি আমার ঘাড়ে চড়তেই পারেন।
বর্তমান মেয়র এবং ধানের শীষের প্রার্থী আমার পাড়াতুতো মামা, আর স্কুলতুতো বড় ভাই। মানুষ হিসেবে অসাধারণ। স্কুলে পড়ার সময় থেকে তাঁকে চিনি এবং সেই থেকে মামা ভাগিনার এই সম্পর্কটা চিনির মতো মধুর হয়ে আছে। সেই সম্পর্কটা এখন এতটাই আঠালো যে আইকা বা ফেভিকলের চেয়ে সেটি মজবুত হয়ে আছে। ভাগিনার কাছে তিনি তো ভোট দাবি করতেই পারেন।
শাসক দলের পক্ষ থেকে নৌকা প্রতীকে যিনি দাঁড়িয়েছেন তিনি আমার স্কুলের ছোট ভাই। ছোট ভাই যখন ছোট ছিল তখন যেভাবে সম্ভাষণ বিনিময় করত এখন যুবদলের নেতা হিসেবে একই ভাষায় একই আন্তরিকতায় সম্ভাষণ বিনিময় করে। অনেক সময় পদের ভারে অনেকে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে, আর আমরা সেটা পদে পদে টের পাই। কিন্তু আমার এই ছোট ভাইটি আগের মতোই বিনয়ী রয়ে গেছে। এখন পৌর নির্বাচনে ছোট ভাইয়ের দাবি বা অস্বীকার করি কীভাবে।
উপরের যে কয়জন প্রার্থীর নাম উল্লেখ করলাম তাঁরা সবাই নিজ নিজ দলের প্রতি সবসময় বিশ্বস্ত থেকে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। ফলে নিজ দলের পরীক্ষিত এই সব প্রার্থী নির্বাচনের পরে নিজদের প্রদান করা প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাস থাকার চেষ্টা করবেন সেটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আন্তরিক ভাবে আমি সবার জয় কামনা করি, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। নির্বাচনে এদের কোনো একজন বিজয়ী হবেন, বাকিরা পরাজিত হবেন। তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি নির্বাচনে পরাজিত হলেও তাঁরা সবাই বিজয়ী প্রার্থীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পৌরসভার উন্নয়নে কাজ করে যাবেন, কারণ শহরটা যে আমাদের সবার।
পরিশিষ্ট
আমার ভোট আমি দেব সেটা ঠিক। কিন্তু বুঝতেই পারছেন কাকে দেব সেটা নিয়ে এক দারুণ এক সমস্যা পড়ে গেছি। কারণ সবাই আমার পরিচিত, রক্তের সম্পর্কের না হলেও, এরা সবাই আমার আত্মার আত্মীয়, একই নগরবাসী হিসেবেতো বটেই। কিন্তু এই জটিল সমস্যা থেকে আমাকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য অনুসারে আমি ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা। দিনাজপুরের নির্বাচনে আমি ভোট প্রদানে অক্ষম। ঢাকা শহর থেকে আমি কার্যত বিদায় নিলেও আইনত আমি এখনো এই মহানগরের বাসিন্দা, অন্তত ভোটাধিকার প্রদানের বেলায়। ভোট দিতে না পারলেও বিজয়ী প্রার্থীর জন্য শুভেচ্ছা এবং পরাজিত প্রার্থীদের জন্য অগ্রিম সমবেদনা তো জানাতেই পারি।
লেখক, বিজ্ঞাপনকর্মী ও সমাজকর্মী
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত