English
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশঃ ২০২০-০৬-১৫ ০৩:০৯:৫৭
আপডেটঃ ২০২৪-০৪-১৫ ১০:০৮:২৭


এয়ারপোর্ট একটি দেশের ড্রইংরুম

এয়ারপোর্ট একটি দেশের ড্রইংরুম

বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন সেক্টরে দুই দশকেরও বেশি সময় নিয়ে কাজ করছেন মো. কামরুল ইসলাম বর্তমানে তিনি বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত আছেন সম্প্রতি তিনি কথা বলেন বিপরীত স্রোতের সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামানের সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন অ্যাভিয়েশন সেক্টরে তার দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা, সম্ভাবনা এবং সংকটের বিষয়গুলো জানিয়েছেন বর্তমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যতোটা সম্ভব ফ্লাইট এবং কার্গো চালু রেখে কার্যক্রম সচল রাখার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার বিষয়টি একই সঙ্গে তিনি বলেছেন কাঠমান্ডুতে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের দুঃখজনক দুর্ঘটনার পরবর্তী কঠিন সময়ে তার কর্তব্যবোধের কথা শুধু অ্যাভিয়েশন জগতে নয়, যে কোনো ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে এই অভিজ্ঞতা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অ্যাভিয়েশন জগত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে তার এই সাক্ষাৎকারে

 

ক্যারিয়ার প্রস্তুতি

আমার বাবা প্রয়াত সাদত আলী সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশে কাজ করতেন ফলে পারিবারিক ভাবে ছেলেবেলা থেকেই বিমান বা এয়ারপোর্ট দেখার সুযোগ আমার হয়েছে আমরা সাত ভাই বোন এর মধ্যে বর্তমানে এক বোন সিভিল অ্যাভিয়েশনে এবং ছোট ভাই বিমান বাহিনীতে কর্মরত আছে আমার স্ত্রী কামরুন নাহার খান রুমি একজন শিক্ষক আমাদের দুই মেয়ে আনিকা তাহসিন রাইসা রামিসা তাহসিন হৃদিশা 



আজকের আমি হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন আমার মা প্রয়াত সামসুন নাহার বেগম। তিনি ছিলেন একজন গৃহিনী, সচেতন মা। আমি পড়াশোনা করেছি সিভিল এভিয়েশন হাই স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ঘটনাচক্রে আমি আমার স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র শুধু তাই নয়, চাকরি ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও প্রতিষ্ঠানের সূচনা থেকেই কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে এমন কি ঢাকার কুর্মিটোলায় নতুন বিমানবন্দর যেদিন উদ্ধোধন হয় তখনও বাবার সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম কাছ থেকে বিমান দেখার অভিজ্ঞতা অবচেতন ভাবে আমার মনে কাজ করেছে

ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক এবং চতুর্থ সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি ফলে সবার সঙ্গে মেশা এবং সবাইকে নিয়ে কাজ করার একটা প্রবণতা সব সময়ই কাজ করেছে কারণে পাবলিক রিলেশনে কাজ করার আগ্রহ আমার শুরু থেকেই ১৯৯৮ সালে জিএমজি এয়ারলাইনসে যোগ দেয়ার মাধ্যমে আমার ক্যারিয়ার শুরু হয় আমি ছিলাম জিএমজির প্রথম দিককার একজন কর্মী সার্বিক ভাবে একটি আন্তর্জাতিক মানের এয়ারলাইনস হিসেবে জিএমজি নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে সাত বছর সেখানে কাজ করি জিএমজির পর যোগ দেই ইউনাইটেড এয়ারে ইউনাইটেড এয়ার পরিকল্পিত ভাবে দেশে এবং বিদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করতে থাকে ঢাকা টু লন্ডন বা সিলেট টু লন্ডন ফ্লাইট ছিল ইউনাইটেডে এক সঙ্গে ঊনিশটি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করেছে ইউনাইটেড এয়ার দশ বছর চলার পর ইউনাইটেডও বন্ধ হয়ে যায় একদম শুরুর সময়ের কর্মী ছিলাম আমি মনে আছে, ইউনাইটেডের অপারেশনের প্রথম আটটি ফ্লাইটে যাত্রী হিসাবে আমি ভ্রমণ করেছি সুযোগ সুবিধা বিবেচনা করার জন্য নেপালে ইউনাইটেড এয়ারের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে তিন মাস কাজ করি পরবর্তীতে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের শুরুর বছর খানেক পর আমি এখানে যোগ দিই

অ্যাভিয়েশন ক্যারিয়ারের পাশাপাশি আমি দৈনিক যায়যায়দিন এবং পিআর এজেন্সি উইন্ডমিলে কাজ করি এই দুটো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে মিডিয়া এজেন্সিগুলো কীভাবে কাজ করে সে ধারণা পেয়েছি যা আমার কাজে খুব সাহায্য করেছে


বর্তমান ব্যস্ততা

ডমেস্টিক থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট পরিচালনায় যাওয়া মানে পুকুর থেকে নদীতে নয়, সমুদ্রে যাওয়া কারণ সেখানে প্রতিযোগিতা করতে হয় কাতার, ওমান, ইনডিয়া, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড চীনসহ পৃথিবীর সবদেশের এয়ারলাইনের সঙ্গে প্রতিটি সেক্টরে ইনডিভিজুয়াল কমপিটিশন চলে ইউএস-বাংলায় যোগ দেয়ার পর ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট শুরু করার যতো রকম আনুষ্ঠানিকতা আছে তাতে আমি অংশ নিই যেমন লোকাল ক্যারিয়ারের সঙ্গে অ্যাগ্রিমেন্ট, এ্যাম্বাসির সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি নেপাল অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যেই সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছিলাম আবার অনেকেই জানেন যে চায়নার অ্যাভিয়েশন অনেক কঠিন অনেকেই চায়নায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে চান ইউএস-বাংলা সেটা বাস্তবে প্রমাণ করেছে আগে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট ছিল এখন প্রতিদিন চায়নার গুয়াংজুতে ইউএস-বাংলার এয়ারক্র্যাফট যাচ্ছে একই সঙ্গে আমরা সরাসরি চেন্নাই ফ্লাইট পরিচালনা করছি প্রথম বাংলাদেশি ক্যারিয়ার হিসাবে ইউএস-বাংলা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে চেন্নাই যাচ্ছে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য যান এতোদিন তারা ইনডিয়ান ক্যারিয়ার ব্যবহার করতেন বর্তমানে দেশীয় এয়ারক্র্যাফটেই যাচ্ছেন প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, চেন্নাই যেতে রিটার্ন টিকেটসহ খরচ পড়বে ঢাকা থেকে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকা


দেশের ভেতর ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, সৈয়দপুর, যশোর, বরিশাল, রাজশাহীসহ যতোগুলো ডমেস্টিক অপারেশনাল রুট আছে প্রতিটি ফ্লাইট পরিচালনা করি আমরা ইউএস বাংলার বর্তমান ইন্টারন্যাশনাল রুট হচ্ছে ঢাকা থেকে কলকাতা, চেন্নাই, সিঙ্গাপুর, কুয়ালা লামপুর, ব্যাংকক, চায়নার গুয়াংজু, মাসকাট, দোহা নতুন পরিকল্পনার মধ্যে আছে, জেদ্দা, দাম্মাম, রিয়াদ, দুবাই, বাহরাইন, হংকং, বালি, কলোম্বো, মালে, ভূটান, লন্ডন, রোম

ইউএস বাংলা সব সময়ই এগিয়ে থাকতে চায় আমাদের বহরে ৭২ সিটের ছয়টি ব্র্যান্ড নিউ এটিআর ৭২-৬০০ প্লেন যোগ হয়েছে দেশে বেসরকারি এয়ারলাইনসের জগতে একদম নতুন বিমান দিয়ে আমরাই প্রথম যাত্রী পরিবহন করছি ডমেস্টিক ফ্লাইটের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি আগে সিলেটে সকালে বা সন্ধ্যায় কোনো ফ্লাইট ছিল না এখন দিনে দুইটি ফ্লাইট চালাচ্ছি কেউ সকালে সিলেটে গিয়ে কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারছেন যশোর, সৈয়দপুরে, বরিশাল রাজশাহীতে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়িয়েছি


অ্যাভিয়েশনে সংকট সম্ভাবনা

আমাদের দেশের ভেতরে প্লেনের যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে খরচ কিছুটা বেশি লাগলেও কম সময়ে যাতায়াতের ওপর অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন ২০১৩ সালে ডমেস্টিক ফ্লাইটগুলোতে মোট যাত্রী ছিলেন লাখ ৪৮ হাজার ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখে অর্থাৎ শত ভাগ গ্রোথ রেট যাত্রীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়নো খুব বেশি প্রয়োজন একটি এয়ারপোর্টকে কেন্দ্র করে সেই শহর অনেক ডেভেলপ হতে পারে যেমনটা হয়েছে সৈয়দপুরে একটি সচল এয়ারপোর্ট ওই এলাকার আর্থ সামাজিক অবস্থা বদলে দেয়

দুঃখজনক হলো অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি শব্দগুলো বলা হলেও এটা এখনো ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড়াতে পারে নি কারণ এখন ইউএস বাংলা, রিজেন্ট, নভোএয়ারসহ যতোগুলো এয়ারলাইন অপারেশনে আছে তারচেয়ে অনেক বেশি এয়ারলাইন বন্ধ হয়ে গিয়েছে অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবাত, জিএমজি, বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারলাইন (রয়েল বেঙ্গল), ইউনাইটেড বন্ধ হয়েছে এটা কি শুধু অপারেশনাল কস্ট সামলাতে না পারার জন্যই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নাকি অন্য কোনো সমস্যা? অ্যাভিয়েশন বিজনেসের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে

ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে অ্যাভিয়েশন না দাঁড়ানোয় ব্যাংকসহ ফিনানশিয়াল ইনস্টিটিউটগুলো সেভাবে এগিয়ে আসছে না কিন্তু এই সেক্টরে তাদের সহযোগিতা খুব প্রয়োজন ইন্ডাস্ট্রি এতো ছোট যে কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়লে সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে না এখনো এই সেক্টর কর্মীদের কাছে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারে নি

 

এয়ারলাইনগুলো বন্ধ হওয়ার পর শোনা যায়, অ্যাভিয়েশন অথরিটির কারো কাছে একশো বা দেড়শো কোটি টাকা পাওনা আছে আমার কথা হচ্ছে, এতো টাকা জমে কীভাবে? কারণ প্রতিটি এয়ারলাইনকে চলাচলের জন্য কর্তৃপক্ষের এওসি বা এয়ার ওয়ার্দিনেন্স সার্টিফিকেট নিতে হয় কর্তৃপক্ষ যখন এওসি দেন তখন অন্যান্য সব কিছুর পাশাপাশি বকেয়া পরিশোধ আছে কি না এটা দেখতে পারেন বেসরকারি এয়ারলাইনগুলোর প্রতি আরো বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন কেননা একটি এয়ারক্র্যাফট যখন দেশের বাইরে যায় তখন কিন্তু সেটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, হোক সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি

ক্যারিয়ারের ল্যান্ডিং, পার্কিং, রুট নেভিগেশন, সিকিউরিটি এসব খরচের পাশাপাশি আমাদের খরচের আরো একটি দিক হলো জেট ফুয়েলের দাম বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট ডমেস্টিক ফ্লাইটের জন্য জেট ফুয়েলের দাম ভিন্ন ডমেস্টিক ফ্লাইটের জন্য প্রতি লিটারে ১০/১১ টাকা বেশি দিতে হয় ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের তুলনায় ধরুন দূরত্বের দিক দিয়ে কলকাতা এবং চট্টগ্রামে গেলে কাছাকাছি খরচ হওয়ার কথা থাকলেও চট্টগ্রামের জন্য জেট ফুয়েলের দাম পড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি অপারেশনাল খরচের শতকরা ৪০ ভাগই চলে যায় জেট ফুয়েলের পেছনে এই দামে সমন্বয় আনা খুব বেশি প্রয়োজন

ডমেস্টিক এয়ারপোর্টগুলোতে ১৫ বছর আগে যে অবস্থা ছিল এখন তারচেয়ে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয় নি যাত্রীরা এয়ারপোর্ট সার্ভিসের জন্য পেমেন্ট করেন কিন্তু সেই সার্ভিস তারা ঠিক মতো পান না এক সময় সৈয়দপুরে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করেও যাত্রী পাওয়া যেত না এখন প্রতিদিন ১৫টির মতো ফ্লাইট চলছে কিন্তু এই হাজারো যাত্রী ধারণ ক্ষমতা সৈয়দপুর এয়াপোর্টে নেই যার ফলে অনেক সময় যাত্রীরা বসারও সুযোগ পান না এরচেয়েও খারাপ অবস্থা কক্সবাজার এয়ারপোর্টে মাঝে মাঝে যাত্রীর দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে লাগেজ ব্যবস্থাপনায় নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে একই সঙ্গে ঠাকুরগাঁও, ঈশ্বরদী, বগুড়া, কুমিল্লা, শমসের নগরসহ শর্ট ল্যান্ডেড এয়ারফিল্ডগুলোকে যদি কিছুটা বড় করা যায় তবে সেখানেও ডমেস্টিক ফ্লাইটগুলো চলাচল করতে পারে যা আশেপাশের এয়ারপোর্টগুলোর ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে

লাগেজ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতেও বাংলাদেশে সমস্যা হচ্ছে লেট ডেলিভারি একটা কমন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক সঙ্গে যখন অনেকগুলো ফ্লাইট নামে তখন তা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে নিয়মিত যাত্রীর পাশাপাশি বাংলাদেশে অসংখ্য ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার আসেন তারাও কিন্তু এয়ারপোর্ট ব্যবস্থাপনা দেখছেন একটি দেশের ড্রইংরুম হচ্ছে এয়ারপোর্ট যাত্রীদের মুখে মুখেই এয়ারপোর্ট সম্পর্কে তাদের ধারণা প্রচার পায় দেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় দুই দশক ধরে অ্যাভিয়েশন সেক্টরে কাজ করে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের ঢাকা আন্তর্জাতিক হাব হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এখনো সেই সুযোগ চলে যায় নি যেমন বাংলাদেশের একজন প্যাসেঞ্জার যখন থাই, সিঙ্গাপুর বা মালয়শিয়ান এয়ারলাইনসে মিডল ইস্ট বা লন্ডন যান তখন তাকে চার ঘণ্টা উল্টো পথে গিয়ে আবার বাংলাদেশ বা কলকাতার ওপর দিয়ে যেতে হয় এখানেই কিন্তু আট ঘণ্টা সময় চলে যায় বাংলাদেশ যদি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে যাত্রীদের ঢাকায় এনে সার্ভিস দিতে পারে তবে সময় বাঁচার সাথে সাথে অনেক রেভিনিউ জেনারেট হবে 

 

দুর্ঘটনা চ্যালেঞ্জ

১২ মার্চ ২০১৮ কাঠমান্ডুতে ইউএস বাংলার দুঃখজনক ফ্লাইট দুর্ঘটনা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে মনে করি দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি দেশি বিদেশি মিডিয়া, দেশের মানুষের উৎকণ্ঠা, অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিসহ নানা দিক দেখতে হয়েছে প্রত্যেকেরই যার যার অবস্থান থেকে বিষয়টি মূল্যায়ন করার সুযোগ আছে

দুর্ঘটনাটির পর থেকেই আমরা সব কিছুই ওপেন করে দিই নিজেদের কাছে সৎ থাকার চেষ্টা করেছি কোনো কিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করি নি এই ধরনের বিপর্যয়ের পর সাধারণত ম্যানেজমেন্টের পক্ষ মিডিয়ার সামনে আসতে চায় না কিন্তু আমরা তা করিনি আমাকে অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে হতাহতের পরিবারের আবেগকে শ্রদ্ধা জানানো থেকে শুরু করে নানা শ্রেণী পেশার মানুষকে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হয়েছে যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন সে কারণে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য যেন কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সেটিও দেখতে হয়েছে দেশি মিডিয়ার পাশাপাশি ভারতীয়, নেপালিসহ ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াকে ফেস করতে হয়েছে


একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হয়েছে ইউএস বাংলার ভবিষ্যত নিয়েও সোশাল মিডিয়ায় বিষয়টি ছিল সবচেয়ে আলোচিত কোনো আশংকা বা আন্দাজের ওপর কথা বলিনি সেই সময়ে এক সপ্তাহ আমি ফেসবুকে ঢুকি নি আমি জানতাম, সামান্য ভুল আমার দুই দশকের ক্যারিয়ারকেও ধ্বংস করতে পারতো ঘটনা একটি কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে কোনো ভুল তথ্য না দিয়ে প্রত্যেককে আলাদাভাবে ফেস করতে হয়েছে আমি সব সময় সতর্ক ছিলাম আমাদের বক্তব্য মিডিয়া যেন আমার মুখ থেকেই শোনে, অন্যের রেফারেন্সে নয় 

প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেছি আমরা যা বলেছি তারচেয়ে বেশি করার চেষ্টা করেছি যাদের হারিয়েছি তাদের আর ফিরে পাবো না কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তাদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে- ইউএস বাংলা ম্যানেজমেন্টের এই অবস্থানকে আমরা শুরু থেকেই মেনে চলার চেষ্টা করি দুর্ঘটনার পরদিন সকালে একটি চার্টার বিমানে করে দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের ৪৭জন আত্মীয়কে নেপালে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের থাকা অন্যান্য ব্যবস্থা করা হয় নিহত যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন চায়নিজ তার আত্মীয়দের চায়না থেকে নেপালে নিয়ে আসা হয় আমরা আহতদের সিঙ্গাপুর, চেন্নাই, দিল্লিসহ বিভিন্ন হসপিটালে ভর্তির ব্যবস্থা করি এখনো আমাদের ব্যবস্থাপনায় তিন জন চিকিৎসারত আছেন বিভিন্ন স্থানে আহত বা নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি একই সঙ্গে দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট কেবিন ক্রুদের পরিবারের পাশেও আমরা দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি

পুরো বিষয়টিতে শুধু ইউএস বাংলা নয়, দেশের অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ে ভাবতে হয়েছে কারণ একই ধরনের এয়ার ক্র্যাফট বাংলাদেশ বিমান,রিজেন্ট এয়ারওয়েজও ব্যবহার করে ঘটনাটি অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিতে বড় অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচিত হবে সময়ের প্রয়োজনে তখন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যা আগে থেকে পরিকল্পনা করে সম্ভব ছিল না সবার আন্তরিক সহযোগিতায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা অপারেশনে ফিরে আসতে পেরেছি

 

কোভিড-১৯ এর বিপরীতে প্রমাণিত যোদ্ধা

কোভিড-১৯ মহামারীকালীন দীর্ঘ প্রায় তিন মাস সিডিউল ফ্লাইট বন্ধ থাকার পর পুনরায় জুন ২০২০ থেকে স্বল্প পরিসরে আবার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে  যাত্রা সমগ্র দেশ জুড়ে প্রয়োজনীয় আশার সঞ্চারন ঘটাবে এবং সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে অর্থনীতির চাকাগুলি সচল করবে বাংলাদেশের একমাত্র এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা কোভিড-১৯ মহামারী প্রাদুর্ভাবের সময় ঢাকা-গুয়াংজু রুটে ফ্লাইট চলাচল অব্যাহত রেখেছে তাই ইউএস-বাংলা গর্বের সাথে বলতে পারে আমরা কখনই থামি নি ইউএস-বাংলা শুরু থেকেই শেখার জন্য থামেনি এমনকি প্রচন্ড চাপের মধ্য থেকেও কীভাবে টিকে থাকতে হয়, তা বারবার প্রমাণ করে দেখিয়েছে বাংলাদেশে বিমান পরিবহনে এগিয়ে চলার নিদর্শন হয়ে উঠেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

আমরা জানি সাফল্য একটি যাত্রা তাই আমরা কেবল বাংলাদেশের আকাশে নয়, চায়নাসহ প্রতিবেশী দেশগুলিতেও ডানা ছড়িয়ে দেবো খুব শিগগিরই ইনশাআল্লাহ

আমরা কোভিড-১৯ এর বিপরীতে প্রমাণিত যোদ্ধা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সকল ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী কেবিন ক্রু, ককপিট ক্রুসহ সকল এয়ারলাইন্স এক্সিকিউটিভ মনোবলকে সূদৃঢ় রেখে যাত্রীদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের করোনাভাইরাস এর মহামারী চলাকালীন  বিনা খরচে ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড-১৯ এর শনাক্তকরন টেস্ট এর ব্যবস্থা করেছে যার ফলে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অত্যন্ত আস্থার সহিত কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে

কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারনে পৃথিবীর বহুদেশে বাংলাদেশী নাগরিকরা আটকে পড়ে আছে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগতিায় চেন্নাই থেকে প্রায় ৩০০০ যাত্রী ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এছাড়া দুবাই, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক থেকে মরদেহসহ আটকে পড়া বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে ইউএস-বাংলা দেশের আমদানি রফতানি বাণিজ্যকে সূদৃঢ় করার জন্য এই দুর্যোগকালীন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ইতিমধ্যে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কলকাতাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে অত্যন্ত সুনামের সাথে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনা করছে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুর মুহূর্তে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সম্মুখ যোদ্ধা বিশেষ করে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবার সাথে যারা যুক্ত তাদেরকে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকিউপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক, হ্যান্ড গ্লভস, ফেস শিল্ড, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন উপকরণ বিনামূল্যে বিতরন করেছে করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশ যখন লকডাউন অবস্থায় তখন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স হাজার হাজার কর্মহীন মানুষকে ঈদ উপহারসামগ্রী বিতরণ করেছে

জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের কারণে একের পর এক আন্তর্জাতিক রুট বন্ধ হতে থাকে তখনও ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ মনোবল সুদৃঢ় রেখেছে সারাবিশ্বের অনেক খ্যাতিমান এয়ারলাইন্সগুলি চরম অর্থনৈতিক সংকটে দিনানিপাত করছে, পাইলট, কেবিনক্রু, ইঞ্জিনিয়ারসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, সেখানে ইউএস-বাংলা কোনো কর্মীকে ছাটাই না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে মানবিক হওয়ার দৃষ্টান্ত হতে দেখেছি মহামারী চলাকালীন ইউএস-বাংলার অভিজ্ঞতা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং বিমান পরিবহনের উদাহরণ হিসেবে সামনের দিনগুলিতে সবার জন্য কাজে লাগবে


জনসংযোগকর্মীর দায়িত্ব

একজন জনসংযোগকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠানের ভালো গুণাগুণ সবার সামনে তুলে ধরা এবং সংকটকালীন অত্যন্ত পজিটিভলি ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি আপনার উপস্থাপিত কোনো বক্তব্যেই যেন সরকারকে বিব্রত না করে, প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ বিজনেসকে ক্ষতিগ্রস্ত না কওে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে আপনার বক্তব্যে গণমাধ্যমকে ভুল তথ্য না দেয়া এবং কীভাবে দেশের সাধারণ নাগরিকদের আস্থা অর্জন করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আপনি যেই ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করুন না কেন আপনাকে আপনার ট্রেড সম্পর্কে নলেজেবল হতে হবে, আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে হবে, ঘটনা সম্পর্কে পরোপুরি ধারণা থাকতে হবে, কখনই মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না সোশাল মিডিয়ার বক্তব্যকে ১০০% বিশ্বাস না করে খবরের সোর্স হিসেবে বিবেচনা করে সত্যতা যাচাই করে তবেই প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত বলেই আমি মনে করি

 


রুটিন কাজের বাইরে

সুযোগ পেলেই সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশনের অগ্রযাত্রা নিয়ে কথা বলা, ছাত্রছাত্রীদের অ্যাভিয়েশনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদের প্লাটফর্ম সাস্ট ক্লাবের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি সাস্ট ইকোনমিকস অ্যালামনাই-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য আমি

ব্যক্তিগত কাজ কিংবা অফিশিয়ালি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, ভুটান

জনসংযোগ বিভাগে কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা ফোরাম সেরা জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে পুরস্কৃত করেছে     


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা, অর্থনীতি,
সাবক্যাটেগরিঃ আলাপন, ভ্রমণ,


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।



আরো পড়ুন