-মাসুদ খান
বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরে একটি পরিচিত নাম মাসুদ খান এফসিএ। সিএ প্রফেশনালদের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত হন। মাসুদ খান ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৭৯ সালে চা কোম্পানি জেমস ফিনলে দিয়ে। সেখানে তিন মাস থাকার পর চলে আসেন বৃটিশ-আমেরিকান টোবাকো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। কস্ট ম্যানেজমেন্ট, ইন্টার্নাল অডিট, অ্যাকাউন্টস এবং ফাইন্যান্স বিভাগে বিভিন্ন পদে সেখানে দীর্ঘ দুই দশক চাকরি করেন। তারপর চলে আসেন একদম ভিন্ন আরেকটি সেক্টরে। সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কোম্পানি সবে বাংলাদেশে এসেছে। এই কোম্পানিতে যোগ দেন ১ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে। এখানে যদিও তিনি অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগে ছিলেন কিন্তু এর থেকে তার কাজের পরিধি ছিলো আরো ব্যাপক। তিনি এখানে থাকা অবস্থায়ই লাফার্জ-এর সাথে হোলসিম কোম্পানি মার্জ করে। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন মাসুদ খান। লাফার্জ-হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড-এ ছিলেন ৩১ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত। এখান থেকে তিনি আরেক সিমেন্ট কোম্পানি ক্রাউন সিমেন্ট-এ যোগ দেন। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডের চিফ অ্যাডভাইজার। এর পাশাপাশি তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে মারিকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশসহ কিছু প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন- জিএসকে বাংলাদেশের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন আগে জিএসকে বাংলাদেশ কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। এর পেছনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মাসুদ খান সদ্য গঠিত ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রথমে লাফার্জ-হোলসিম এবং পরে জিএসকে-ইউনিলিভার মার্জ অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন-এর সাথে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কারণে বাংলাদেশে তিনি মার্জ অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন এক্সপার্ট হিসেবে পরিচিত। তিনি পঁচিশ বছর বয়স থেকেই এসব বিষয় পড়াচ্ছেন সিএ ছাত্রদের। এখনো তিনি পড়াচ্ছেন। তরুণ বয়সে শিক্ষক থাকা অবস্থায়ই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সেই জনপ্রিয়তা এখনো ধরে রেখেছেন। বর্তমানে তার ছাত্ররা বিভিন্ন সেক্টরে লিড দিচ্ছেন। যাদের তিনি পড়িয়েছেন, এখন তাদের মধ্যে থেকেই আবার অনেকে আইসিএবি-তে পড়াচ্ছেন। সম্প্রতি বিপরীত স্রোতের পক্ষ থেকে সম্পাদক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান এবং চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট ও ট্যাক্স কনসালটেন্ট জসীম উদ্দিন রাসেল তার সাথে কথা বলেন। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে নানা দিক। পাশাপাশি এখনকার তরুণদের করণীয় বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।
বিপরীত স্রোত: আপনার কর্ম জীবনের
বড় একটি অংশ কেটেছে
সিমেন্ট শিল্পে এবং এখনো আপনি এই শিল্পের
সাথে কাজ করছেন। আপনি এর আগে টোবাকো
কোম্পানির সাথে দীর্ঘ দিন ছিলেন। সেখান থেকে কেন সিমেন্ট
শিল্পে এলেন?
মাসুদ খান: প্রথম আমার চাকরি জীবন শুরু হয় ১৯৭৯ সালে জেমস ফিনলে চা কোম্পানি দিয়ে। সেখানে তিন মাস ছিলাম। তারপর চলে আসি বৃটিশ-আমেরিকান টোবাকোতে। সেখানে ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে যোগ দিই। তারপর বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছি। এক বছর দেশের বাইরেও কাজ করেছি বৃটিশ-আমেরিকান টোবাকোর হয়ে। এভাবে করতে করতে আমি অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় পদে চলে আসি। কিন্তু কোম্পানি আমাকে আর প্রথম পজিশনে দিচ্ছিল না। যখনই পদ খালি হয় তখন আবার বিদেশি কাউকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। আমি কোম্পানিকে বিষয়টি জানাই। কিন্তু তারা দেরি করছিল। পরে এক সময় আমি বুঝে যাই তারা আমাকে কোনোদিনই এই পদে দেবে না। বৃটিশ-আমেরিকান টোবাকো এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে সিএফও পদে নিয়োগ দেয় নি। আমি সিদ্ধান্ত নিই চলে আসার। সেখান থেকে ১৯৯৯ সালে লাফার্জ সিমেন্ট কোম্পানিতে চলে আসি। আমার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল বলে মনে করি।
বিপরীত স্রোত: প্রায় বিশ বছর একটা সেক্টরে
থেকে একদম ভিন্ন আরেকটা
সেক্টরে চলে এলেন। এটাতো খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল!
মাসুদ খান: হ্যাঁ, অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। একটা লাইফ-টাইম অভিজ্ঞতা। একটা
উদাহরণ দিতে পারি। আমাদের কাজ করতে হয়েছিল
বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশ মিলিয়ে। ইনডিয়াতে
প্রায় ১৮ কিলোমিটার কনভেয়র তৈরি করতে হয়। এটা তৈরি করতে গিয়ে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। যেখানে আমরা কনভেয়ার করতে গেলাম সেই জমি ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের। নিয়ম হলো আদিবাসী ছাড়া বাইরের কারো কাছে জমি বিক্রি করা যাবে না। সেখানে আমরা ভিন্ন আরেকটি দেশের কোম্পানি।
দ্বিতীয়
যে সমস্যাটি হলো, সেখানে কোনো ম্যাপ ছিল না। কেউ কারো জমির সীমানা সম্পর্কে জানেও না। কাউকে যদি বলতাম আপনার জমি কতোটুকু, তখন তিনি হাত দিয়ে দেখাতেন ‘ওই পাহাড় পর্যন্ত’!
তৃতীয় সমস্যা হলো, তাদের মধ্যে থেকে একজনও যদি বলেন জমি বিক্রি করবেন না তাহলে কেউ জমি বিক্রি করতে পারবেন না। এই ধরনের সমস্যা একে একে আসতে লাগলো। এজন্য তখন প্রায়ই আমাকে সেখানে যাতায়াত করতে হয়েছে।
এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠার পর দেখা দিলো নতুন আরেক সমস্যা। জমি বিক্রি করার কয়েকটা ধাপ রয়েছে, প্রথম আদিবাসীরা রাজি হলেন। পরে এটা গেল মেঘালয় জেলা অফিসে। সেখান থেকে মেঘালয় রাজ্য সরকার। তাদের রাজ্যসভায় আলোচনা উঠলো। তারা বেঁকে বসলেন। বাংলাদেশের কোনো কোম্পানির কাছে তারা জমি বিক্রি করবেন না। ততোদিনে আমাদের চার বছর এর পেছনে ব্যয় হয়ে গিয়েছে। পরে মেঘালয় সরকার শর্ত দিল সেখানে কোম্পানি করতে হলে বাংলাদেশ থেকে ক্যাপিটাল পাঠাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তখন ক্যাপিটাল পাঠানো যেতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বেঁকে বসলো। তাদেরকে বোঝালাম,
এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে আমাদের দেশে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবিসহ ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স অরগানাইজেশন এর পেছনে ফাইন্যান্স করবে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক রাজি হলো এক শর্তে যে, তাদের লোকজন অডিট করে যদি সন্তুষ্ট হন তাহলে তারা অনুমতি দেবে। শেষ পর্যন্ত দুই বছর পরে সবকিছু ঠিকঠাক হলো। সফল হলাম।
আমার ক্যারিয়ারের আরেকটা বড় ঘটনা হলো, লাফার্জ ক্যাপিটাল মার্কেটে আসে আইপিও-র মাধ্যমে। তখন সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত আইপিও-র রেকর্ড ছিল। আর লাফার্জ ৯৩ কোটি টাকা ক্যাপিটাল সংগ্রহ করলো আইপিও-র মাধ্যমে।
বিপরীত স্রোত: লাফার্জ পরে হোলসিম
কোম্পানির সাথে মার্জ হলো। তখন আপনার ভূমিকা কী ছিল?
মাসুদ খান: এই দুই কোম্পানির মার্জারের ইনচার্জ হিসেবে আমি কাজ করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছি। তখন শেয়ার ভ্যালুয়েশন গাইডলাইন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। এখন যে শেয়ার ভ্যালুয়েশন গাইডলাইন দেখতে পাচ্ছেন সেটা কিন্তু আমার তৈরি করা।
বিপরীত স্রোত: বাংলাদেশে সিমেন্ট বিজনেস
বর্তমান অবস্থা কেমন বলে আপনি মনে করেন?
মাসুদ খানঃ বাংলাদেশের পটেনশিয়াল হাই। বাংলাদেশে পার কেপিটা কনজাম্পশন হলো ১৮৫ কিলোগ্রাম। এটা জিডিপি গ্রোথের তুলনায় অনেক কম। চায়নাতে ১.৭ টন পার পার্সন। অতএব, বুঝতেই পারছেন, আমরা কতো নিচে আছি। আমরা দশ গুণ কম আছি। জিডিপি গ্রোথের প্রায় দেড় গুণ কনজাম্পশন হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে ১১-১২% গ্রোথ হওয়ার কথা। সে হিসেবে অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, যখন কোনো বিজনেস ভালো করে তখন সবাই সেদিকে আসতে থাকে। সে কারণে প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। প্রাইস কমে যায়। ২০১৪ সালের পর প্রাইস একবার বেড়েছিল কিন্তু পরে আবার কমতে শুরু করে। অথচ বিপরীতে কাঁচামালের দাম বাড়ছে। এই
কাঁচামাল কিন্তু আমদানি করতে হয়। এখানে সরকারের কিছু পলিসির কারণে সমস্যা হচ্ছে। সিমেন্ট এবং স্টিল কোম্পানি যে কাঁচামাল আমদানি করে তার উপর ৩% উৎসে কর দিতে হয়। এটাকে মিনিমাম ট্যাক্সের আওতায় আনা হয়েছে। আবার যখন ফিনিশড গুডস বিক্রি হচ্ছে তখন আবার ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এটাও মিনিমাম ট্যাক্সের আওতায়। এসব মিলিয়ে প্রায় ৬-৭% ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। একটা কোম্পানিকে প্রফিট বিফোর ট্যাক্স হতে হবে ২৮% -এর মতো। কতোগুলো কোম্পানি এই প্রফিট করতে পারে? এর মধ্যে আবার এ বছর যোগ হয়েছে করোনার প্রভাব। এসব মিলিয়ে একটা বেহাল অবস্থার মধ্যে আছে সিমেন্ট সেক্টর।
বিপরীত স্রোত: অতি সম্প্রতি জিএসকে বাংলাদেশকে ইউনিলিভার অধিগ্রহণ করে। জিএসকে বাংলাদেশে
জনপ্রিয় ছিল। তারা চলে গেলো কেন? আসলে কী হয়েছিল?
মাসুদ খান: জিএসকে-র দুইটি পার্ট ছিল। হেলথ ফুড এবং ফার্মাসিউটিক্যাল। আমি যে বছর জিএসকে-তে ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিই তার কিছু পরে সিদ্ধান্ত নিই সেগমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করার। যে বছর ফার্মাসিউটিক্যাল পার্ট বিক্রি করে দেওয়া হয় তার আগের বছরের কথা বলছি। সেগমেন্ট রিপোর্ট থেকে দেখলাম, ফার্মাসিউটিক্যাল লস করছে। অন্যদিকে হরলিকস এবং গ্ল্যাক্সো’সডি বাম্পার ব্যবসা করছে। যদিও কম্বাইন্ডলি নেট প্রফিট ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, ফার্মাসিউটিক্যাল পার্ট কেন লস করছে?
এর কয়েকটা কারণ ছিল, ফার্মাসিউটিক্যালে দুই ধরনের প্রডাক্ট হয়। প্যাটেন্ট এবং জেনেরিক। প্যাটেন্ট প্রডাক্টের ক্ষেত্রে, আরঅ্যান্ডডি মিলিয়ে ৫-৭ বছর থাকে। প্যাটেন্ট প্রডাক্টের ক্ষেত্রে জিএসকে আমদানি করতো। দেখা গেল দুই লাখ ইউনিট আমাদানি করার জন্য সরকারের ড্রাগ অ্যাডমিনিট্রেশন থেকে অনুমতির জন্য আবেদন করা হলো। সেই অনুমতি পেতে পেতে সাত মাস লেগে গেল। এবং সাত মাস পরে দেখা গেল অনুমতি দিয়েছে বিশ হাজার ইউনিট আমদানির জন্য। এরপর প্রাইস ডিক্লারেশনে লেগে গেল আরো চার-পাঁচ মাস। এই মিলিয়ে প্রায় এক বছর লেগে গেল মার্কেটে প্রডাক্ট নিয়ে আসতে। কিন্তু এদিকে আমাদের স্থানীয় যে কোম্পানিগুলো আছে তারা কিন্তু জেনে গেল আমরা একটা প্রডাক্ট নিয়ে আসছি। ততোদিনে তারা সেই ধরনের প্রডাক্ট আমাদের আগেই মার্কেটে নিয়ে হাজির।
আর জেনেরিক প্রডাক্টের ক্ষেত্রে এপিআই আমদানি করতে হয়। জিএসকে বেস্ট সোর্স থেকে নিয়ে আসে। তাই খরচ বেশি পড়ে। আর বিপরীতে, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অনেকেই নিয়ে আসে চায়না থেকে। ফলে তাদের খরচ অনেক কমে যাচ্ছে। আরেকটা বিষয় হলো, ঔষধের জন্য এপিআই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন স্থানীয় কোম্পানিগুলো কতোটুকু ব্যবহার করছে তার উপর আবার খরচ নির্ভর করছে।
আবার, আপনি যখন ডাক্তার দেখাতে যাবেন তখন দেখবেন বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা লাইন ধরে আছেন। তাদের পক্ষ থেকে ডাক্তারদের জন্য লোভনীয় অফার থাকে। এ
বিষয়ে আমরা তাদের অনুসরণ করি নি। এছাড়া জিএসকে-র ফ্যাক্টরি ছিল চট্টগ্রামে। সেখানে যারা কাজ করতেন, তারা বহু বছর ধরে আছেন। তাদের বেতন অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। একজন ম্যানেজারের চেয়েও তাদের বেতন বেশি ছিল। আবার যে ফ্যাক্টরিতে প্রডাকশন হতো তাও পুরোনো ছিল। এসব কারণেও খরচ বেশি পড়ছিল।
এসব মিলিয়েই জিএসকে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল পার্ট তারা ছেড়ে দেবে। তখন আমাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কোম্পানি দায়িত্ব দিল এসব বিষয় আমাকে সামাল দেওয়ার জন্য।
বিপরীত স্রোত: জিএসকে হেলথ ফুড বিজনেস ইউনিলিভার অধিগ্রহণ করায় ব্যবসায় কী পরিবর্তন
আসবে?
মাসুদ খান: ২০১৯ সালের এপ্রিলের দিকে জিএসকে সিদ্ধান্ত নেয় তারা গ্লোবালি হেলথ ফুড হরলিকস সেল করে দেবে। পাশের দেশ ইনডিয়াতে হরলিকসের বিশাল মার্কেট। সেখানে তা কেনার জন্য ভারতের
ইউনিলিভার ও
নেসলে আগ্রহী হয়। পরে ইউনিলিভার তা কিনে নেয়। আর বাংলাদেশে হরলিকস এবং গ্ল্যাক্সোসডি দুইটা প্রডাক্ট না কিনে পুরো কোম্পানি ইউনিলিভার কিনে নেয়। এই বিক্রির পিছনে জিএসকের গ্লোবাল ডিসিশন কাজ করেছে। এখন ইউনিলিভার কিনে নেওয়াতে দুইটি বড় লাভ হবে। ইউনিলিভারের মার্কেট স্ট্র্যানথ যোগ হবে এবং তাদের সাপ্লাই চেইন ব্যবহার করার ফলে খরচ কমে যাবে। ইউনিলিভারের একদম রিটেইল পর্যায়েও সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের ডিলার, ওয়্যারহাউজ এসব ব্যবহারের ফলে খরচ অনেক কমে যাবে। ইউনিলিভারেরও যে ফুড আইটেম আছে সেগুলোর সাথে হরলিকস এবং গ্ল্যাক্সোসডি সেল করতে পারবে। মার্কেটে দখল আরো জোরদার হবে।
বিপরীত স্রোত: জিএসকে অধিগ্রহণের ট্রানজেকশন ছিল প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এই ট্রানজেকশনটা ক্যাপিটাল মার্কেটে
হয়। এতো বড় একটা সেল কীভাবে
সম্ভব হলো? আমরা জানি কোনো বিজনেস সেল হলে এর ভ্যাল্যুয়েশন করতে হয় এবং কিছু পদ্ধতি ফলো করে এর ভ্যলু বের করতে হয়। এখানে কীভাবে ভ্যালুয়েশন হয়েছে?
মাসুদ খান: সেল হয়েছে দুটি অফসোর এনটিটির মধ্যে। নেগোশিয়েশনটা গ্লোবালি হয়েছে। নিশ্চয় কিছু ভ্যলুয়েশন হয়েছে। প্রাইস/আরনিং রেশিও অথবা ডিসকাউন্টেড ক্যাশ ফ্লো হতে পারে। এটা আমার মনে হচ্ছে। কারণ আপনি যদি ট্রানজেকশন প্রাইস দেখেন তাহলে দেখবেন মার্কেট প্রাইস থেকে কিন্তু বেশি। ২৬ জুন আমরা ঘোষণা দিলাম ট্রানজেকশন হবে ২৮ জুন। ব্লক মার্কেটে আলাদাভাবে এই ট্রানজেকশনটা হয়েছে। যেহেতু ব্লক মার্কেটে সেলার এবং বায়ারের মধ্যে আগেই প্রাইস ঠিক করা হয়ে গেছে তাই সেই প্রাইসেই সেলটা হয়েছে।
একটা কোম্পানি সেল করা, সেল করতে গেলে প্রাইস কতো হবে, কীভাবে নির্ধারণ করতে হবে- এগুলো আমার আগে থেকেই জানা ছিল। কারণ এসব বিষয় আমি অনেক আগে থেকেই সিএ ছাত্রদেরকে পড়াই।
বিপরীত স্রোত: আপনি নিজে কীভাবে সিএ পড়তে আসলেন?
মাসুদ খান: আমি তখন ক্লাস এইট-এ পড়ি। শুনলাম সিএ পরীক্ষায় ১০০ জন অংশ নিলে মাত্র দুইজন পাশ করে। আমি অন্তর্মুখী ছিলাম। আমার মধ্যে একটা জেদ ছিল যেন আমাকে সবাই চেনে। যেহেতু ১০০ জনের মধ্যে দুইজন পাশ করতে পারে, তাই আমি যদি পাশ করতে পারি তাহলে আমাকে লোকে চিনবে। এই চিন্তা থেকে সিএ পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেই সময়ে সিএ পড়া নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমার বোনের এক বান্ধবী একদিন আমাদের বাসায় এলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি লাইফ নিয়ে কি ভাবছি , আমি কী করতে চাই? তখন আমি বললাম, আমি চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট হতে চাই। কথা শুনে তিনি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আমার লাইফে অনেক শাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দেখেছি। কিন্তু কখনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দেখিনি। বেস্ট অফ লাক।’
বিপরীত স্রোত: আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে
যদি আমাদের কিছু বলেন।
মাসুদ খান: আমার বাবা ১৯৩৮ সালে কলকাতা চলে যান। আর দাদা তারও আগে সেখানে ব্যবসা করতেন। দাদা তখন বাবাকে বললেন, তোমার আর পড়ালেখা করার দরকার নেই। তুমি আমার সাথে ব্যবসা করো। দাদা চা-এর ব্যবসা করতেন। পরে ১৯৪৭ সালে যখন দেশ আলাদা হয়ে যায় তখন আমার বাবাকে ইনডিয়া বা পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন পূর্ব-পাকিস্তান চলে আসবেন। তখন ইনডিয়া পাঁচ বছরের ভিসা দিতো। আমার বাবা যেখানে যে ব্যবসা করতেন সেখানে একটা নিয়ম করা হলো, ব্যবসা করতে পারবেন। কিন্তু কোনো অর্থ সেখান থেকে এখানে নিয়ে আসা যাবে না। অর্থাৎ সেখানেই খরচ করতে পারবেন। আমাদের পড়ালেখা সেখানেই। আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ করে প্রথমে আইসিএমএ ভর্তি হই। তারপর প্রাইসওয়াটার ফার্ম-এ সিএ আর্টিকলশিপ নিই। তখন সিএ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ছিল। নয়টা বিষয় ছিল। একসাথে পাশ করতে হবে। এখনকার মতো বিষয়ভিত্তিক পাশ ছিল না। একটা বিষয় ফেল করলে আবার সবগুলো পরীক্ষা দিতে হতো। পরীক্ষা দিলাম। তখন পত্রিকায় রেজাল্ট বের হতো। দেখলাম আমার নাম আলাদা জায়গায়। যারা পাশ করেছে তাদের সাথে ছিল না। বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে। পরেরদিন ইন্সটিটিউটে গেলাম। সেক্রেটারির সাথে দেখা করলাম, তেমন পাত্তা দিলেন না। হাতের পত্রিকা বের করে বললাম, ‘এটা আলাদা কেন বুঝতে পারলাম না।’
তখন তিনি বললেন, ‘এটাতো অল-ইনডিয়ার রেজাল্ট। এই ছেলে সেকেন্ড হয়েছে।’
আমি শুনে আর নড়ছি না। তখন তিনি বললেন, ‘কেন কী হয়েছে?‘
তখন আমি বললাম, ‘এটাতো আমার রেজাল্ট।’
তিনি কথাটি শুনে বিস্মিত হয়ে আমাকে খাতির করতে লাগলেন। আমার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন। তারপর সিএ পাশ করে বাংলাদেশে চলে আসি। তবে ইনডিয়াতেও আমার ভালো চাকরির অফার ছিল। যেহেতু বাংলাদেশেই চলে আসবো, তাই আর সেখানে থাকলাম না। ১৯৭৯-এ বাংলাদেশে চলে আসলাম।
বিপরীত স্রোত: বাংলাদেশে এসে কী করলেন?
মাসুদ খান: জেমস ফিনলে চা কোম্পানিতে জয়েন করলাম। আমার বস ছিলেন জহির উদ্দিন আহমেদ। তিনি আমাদের ইনস্টিটিউটে দুইবার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। একদিন আমাকে বললেন, ‘চলো আমার সাথে।’
তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন নটরডেম কলেজে। তখন সিএ ছাত্রদের ক্লাস হতো সেখানে। আমাকে ছাত্রদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আজ থেকে তোমাদের ক্লাস নেবেন মাসুদ।’
তখন আমার বয়স ২৫ বছর। আর আমার ক্লাসের শিক্ষার্থীরা
অধিকাংশই ছিলেন আমার চেয়ে বয়সী।তারা আমাকে দেখে হাসাহাসি করতে লাগলেন। কয়েকদিন পর বিকেল বেলা কিছু ছাত্র আমার সাথে দেখা করতে আসলেন। তাদেরকে বিকেলে অফিস টাইমের পর আলাদাভাবে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। তারা বললেন, ‘স্যার ওইদিন আপনাকে দেখে হাসাহাসি করেছি। কিন্তু আপনার ক্লাস ভালো লেগেছে। আপনি আমাদের থেকে বয়সে ছোট, আমাদের আপনার ক্লাসে যেতে অস্বস্তি লাগে। তাই ক্লাসের বাইরে আলাদা পড়তে চাই।’
আমি যেহেতু তখন ব্যাচলর ছিলাম তাই তাদেরকে বিকেল বেলা পড়াতে আমার অসুবিধা হলো না।
তাদের মধ্যে অনেকেই সিএ পাশ করে এখন অনেক বড় পজিশনে আছেন। আমার ছাত্রীদের মধ্যে সাবেক আইসিএবি প্রেসিডেন্ট পারভীন মাহমুদ অন্যতম। আমার স্ত্রী সুরাইয়া জান্নাতও আমার ছাত্রী ছিলেন। আমি এখনো সিএ শিক্ষার্থীদের পড়াই।
বিপরীত স্রোত: আপনি ২৫ বছর বয়স থেকে পড়াচ্ছেন। এখনো পড়িয়ে যাচ্ছেন। তখনও জনপ্রিয় ছিলেন,
এখনও আছেন। কিন্তু
সেই সময়ের সাথে এখনকার
কোনো পার্থক্য কি দেখতে পান? যারা ক্লাস নেন তারা প্রায়ই লক্ষ করেন শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিমর্ষ থাকে, হতাশ থাকে। কিন্তু তাড়াতাড়ি পাশ করতে চায়।
মাসুদ খান: আমাদের সময় আর এখনকার সময়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আমাদের লাইফটা ছিল খুবই সহজ এবং সাধারণ। আমরা স্কুলে যেমন পড়েছে আবার তেমনি বিকেল বেলা খেলেছি। বিভিন্ন ধরনের খেলা যেমন, ফুটবল, ক্রিকেট, ক্যারাম, হকি, টেবিল টেনিস ইত্যাদি। খেলা ছিল আমাদের জীবনের অংশ। আবার অনেক
মুভি দেখেছি। তখন অনেক ভালো ভালো মুভি হতো। গল্পের বই, উপন্যাস পড়েছি আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডাও দিয়েছে। আমাদের ভালো লাগার মধ্যে ছিলো ফুসকা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো। আসলে আমাদের লাইফটা ছিল অনেক পরিপূর্ণ।
অন্যদিকে
এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেকটা ফার্ম চিলড্রেন। বাসায় টিভি, কম্পিউটার সবই আছে। ফেসবুক আছে। আজকে ফ্রেন্ড করছে। কালকে আনফ্রেন্ড করছে। বই থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এভাবে তারা ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছে। যখন কারো খারাপ লাগে তখন সে একজন বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছে যাবে বা মা-বার কাছে যাবে। তাদের সাথে কথা বলবে। একটা মানুষের বিগেস্ট ইনভেস্টমেন্ট ইজ ইউর ফ্যামিলি। পরিবারই হলো সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। ছেলেমেয়ে যদি খারাপ হয়ে যায় এর থেকে বড় রিগ্রেট আর কিছু থাকবে না। আপনি তাদের প্রতিনিয়ত দেখবেন আর কষ্ট পাবেন।
আমি বরাবরই দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছি। আমার স্ত্রীও কাজ করছেন। যখন তিনি ব্যস্ত তখন আমি সন্তানদের নিজে খাইয়ে দিয়েছি। তাদের জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছি। তাদেরকে বিকেল বেলা আবার পড়িয়েছি। আমার স্ত্রী অফিসের কাজে দেশের বাইরে গেলে আমি ছুটি নিয়ে তাদেরকে দেখেছি। আমার বড় ছেলে কানাডাতে পড়ছে। তাকে তিন বছর আমি স্কাইপেতে ফাইন্যান্স পড়িয়েছি। এই সংস্পর্শটি খুবই
গুরুত্বপূর্ণ।
সপরিবারে মাসুদ খান
বিপরীত স্রোত: এ কারণেই কি আপনার ছোট ছেলে আপনার সম্পর্কে লিখেছিলেন,‘যখন মাসুদ স্যার কাজে থাকতেন
না তখন তিনি একজন ভালো বাবা হওয়ার জন্য যা করা দরকার তার সবই তিনি নিশ্চিত
করতেন।’
মাসুদ খান: আমরা দুইজনই তাদেরকে সময় দিতাম। অফিস করেই বাসায় চলে আসতাম। তাদের সাথে গল্প করতাম। আমার দুই ছেলেরই আইটি, গাড়ি এইগুলোর প্রতি প্রচুর আগ্রহ। এগুলো নিয়ে তারা আমার সাথে আলাপ করে। আর তার মায়ের সাথে আলাপ করে, কীভাবে কোনো রান্নাটা করতে হবে। আসলে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো।
বিপরীত স্রোত: আপনার পছন্দের একটি উক্তি হলো, ‘তোমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
জন্য কিছু অবদান রেখে যাও।’ কীভাবে একজন মানুষ পৃথিবীতে
তার কাজের অবদান রেখে যেতে পারে? এক্ষেত্রে
তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার কী উপদেশ থাকছে?
মাসুদ খান: আমরা সবাই কোনো না কোনো পেশায় আছি। আমাদের সেই পেশাতেই যার যার জায়গা থেকে এথিকস মেনে চলতে হবে। প্রফেশনাল বিহেভিয়ার বজায় রাখতে হবে। কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট-এ জড়াবেন না।
প্রচুর বই
পড়তে হবে। একটা মানুষকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পড়তে হবে। জানার কোনো শেষ নেই। আমি শুরুতে হাতে ধরে ধরে হিসেব করেছি। তারপর ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে কাজ করেছি। এখন ইআরপি সফটওয়ার ব্যবহার করে কাজ করছি। এগুলো আমাকে শিখতে হয়েছে। এখন পড়ছি ব্লকচেইন, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস, বিগ ডেটা ইত্যাদি নতুন নতুন বিষয় নিয়ে। আইটি আমাদের সব দখল করে নিয়েছে। এগুলো জানতে হবে।
এতোক্ষণ
যা বলেছি, সবই নিজের কথা বলেছি। কী করছি তা বলেছি। কিন্তু আমি সমাজের জন্য কী করে গেলাম? আমি কতো বড় ছিলাম সেটা তারা মনে রাখবে না। তারা মনে রাখবে আমি তাদের জন্য কী করছি, কী করে গেলাম। এ থেকেই একটা মানুষের অবদান তৈরি হয়। ফুট প্রিন্ট থেকে যায়।
ছবি: জসীম উদ্দিন রাসেল
ও সংগ্রহ
ড. বিজন কুমার শীল বিস্তারিত
বিপরীত স্রোত প্রতিবেদন বিস্তারিত
ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী বিস্তারিত
যারিন মালিয়াত অদ্রিতা বিস্তারিত
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বিস্তারিত
মাইক্রোসফট অফিস স্পেশালিস্ট (M.. বিস্তারিত
মুস্তাকিম আহমেদ বিস্তারিত
সাংবাদিক শফিক রেহমানের পুরো বক.. বিস্তারিত
উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আ.. বিস্তারিত