English
ঢাকা, রবিবার, ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

প্রকাশঃ ২০২০-০৬-১৫ ০২:৫১:০৩
আপডেটঃ ২০২৫-০৫-১০ ২৩:৫৮:০৭


স্বাস্থ্য-ব্যবসার ফাঁদে

স্বাস্থ্য-ব্যবসার ফাঁদে

অসুস্থ হলে আপনাকে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতেই হবে। যুগে যুগে মহান চিকিৎসকরা মানুষকে সেবা দিয়ে আসছেন। তাদের কল্যাণকামী অনেক অনেক আবিস্কার মানুষকে অসুস্থতার কষ্ট থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করছে। তাই তারা মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র, হৃদয়ের আপনজন। 
কিন্তু অর্থলুলোপ কিছু প্রাণী এই মহান ব্যবস্থায় ঢুকে মানুষের জন্যে মরণফাঁদ পেতে রেখেছে। এ বিশ্বের কিছু মহান গবেষকের নিজের ভাষাতেই তা আপনাদের সামনে তুলে ধরি।

“লোকেরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, যখন শোনে বহুবছর আগে থেকেই বৈজ্ঞানিক তথ্যমালা প্রমাণ করে চলেছে যে খাদ্যাভ্যাসকে প্রাণিজাত (যেমন: গরু, খাসি, মুরগি, মাছ, ডিম, দুধ, ঘি, মাখন ইত্যাদি) থেকে উদ্ভিদজাতে (যেমন: নানা প্রকার ফল, বীজ বা বিঁচি, নানা রঙের শাক, লতাপাতা ও নানা প্রকার সবজি ইত্যাদি) পরির্বতন করতে পারলেই আপনি সুস্থ থাকবেন, এমন কি রোগ থেকে নিরাময় লাভ করবেন। লোকেরা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে,‘তাহলে কেন এতদিন উল্টোটা শোনে আসলাম যে, প্রোটিনের জন্যে মাংস খেতে হবে আর ক্যান্সার বা হৃদরোগ হচ্ছে বংশগত।’ 

“এর উত্তর রয়েছে করুণ কাহিনীগুলোর মধ্যে! আপনি হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবেন না যে, সংবাদগুলো কীভাবে ‘তৈরি’ করা হয় আর জনসমক্ষে তা কীভাবে প্রচার করা হয়।
“বিশ্বে প্রচুর শক্তিমান প্রভাবশালী বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, যারা টাকার কুমির! তারা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে যদি লোকেরা উদ্ভিদজাত খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়। লোকেদের খাদ্য-জ্ঞানের উপর তাদের আয়ের পরিমাণটা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের বিলাসী জীবন যাপন দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো ভালো উদ্যোগের মতোই তারা তাদের লাভের স্বার্থ রক্ষার্থে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত! 
“আপনি হয়তো ভাবছেন, কোম্পানিগুলো কিছু বিজ্ঞানীকে তথ্য গায়েব করার জন্যে যা দরকার তা টেবিলের নিচ দিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, বা সংস্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে প্রলুব্ধ করে অনৈতিক ভাবে কাজ সারতে উদ্বুদ্ধ করছে। আমাদের মোটেই তা মনে হয় না, পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ!”

উপরের মতামতগুলো বিশ্ববিখ্যাত বিশাল গবেষণা-গ্রন্থ The China Study এর প্রধান বিজ্ঞানী, আমেরিকান গবেষক অধ্যাপক ডা: টি কলিন ক্যাম্পবেল পিএইডির! তিনি আরো বলেন,“বিজ্ঞান, ঔষধ কোম্পানি, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি তৈরির কোম্পানি, মিডিয়া এমন কি কোথাও কোথাও সরকারও স্বাস্থ্যের উপর লাভ করার কাজে নিয়োজিত। সঠিক খাবারের উপরে টেকনোলজির প্রাধান্য এবং গবেষণালব্ধ স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্যমালাকে সংশয়যুক্ত করার কাজে এরা নিয়োজিত। বেশির ভাগ সংশয়গুলো আইনসম্মত ভাবে তৈরি করা হয়। সন্দেহমুক্ত লোকদের দ্বারা সংশয়গুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, জনগণ সহজেই পুষ্টিবিজ্ঞানের বানোয়াট মেকি তথ্যগুলোকেই সহজে সত্য বলে গ্রহণ করে থাকে। আর এই লোকগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছেন কিছু গবেষক, রাজনীতিবিদ বা সংবাদকর্মীও। তথ্যগুলো যে বানানো বা বানোয়াট, তা খতিয়ে দেখার কষ্টটুকু অনেকেই করতে চান না, তাই এই নীরব শত্রুকে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যতিত কেউ ধরতেই পারে না। সিস্টেমটি এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে, বিজ্ঞান থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, সরকার থেকে বিজ্ঞান বা সরকার থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আলাদা ভাবা যায় না।”
বাংলাদেশের ঘটনা।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, দৈনিক কালের কণ্ঠ। প্রথম পৃষ্ঠার ৬ কলাম হেডলাইন: ‘ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ২০ মৃত্যু!’

“...বাংলাদেশে ওষুধের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা অনেকে গোপন করছেন।... নির্দিষ্ট ফরমে মৃত্যুর ঘরটি অনেক ক্ষেত্রেই থাকছে ফাঁকা।... একজন বিশেষজ্ঞ নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, মৃত্যুর ঘরটি খালি থাকার নেপথ্যে একশ্রেণির ওষুধ কোম্পানির ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে কোথাও ওষুধের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পেলেই ওষুধ কোম্পানির লোকজন ছুটে যান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে। সেখানে তাদের নানামুখী চেষ্টা চলে প্রথমত: যাতে তাদের কোম্পানির ওষুধের কারণে রোগীর ক্ষতি হয়েছে তা যেন ঐ চিকিৎসক চেপে যান এবং বিষয়টি যেন ওষুধের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া (Adverse Drug Reaction- ADR) রিপোর্টিং সিস্টেমে উল্লেখ না করা হয়।” 

ড. কলিন ক্যাম্পবেল লেখেন:
“১৯৭৬ সালে মার্কিন সিনেটর জর্জ ম্যাকগর্ভান হৃদরোগের উপর একটি গবেষক কমিটি তৈরি করলেন। কয়েক বছরের গবেষণায় তারা দেখতে পেলেন, খাদ্যাভ্যাসে চর্বি-সংশ্লিষ্ট পশুজাত খাবার হ্রাস করে ফল ও উদ্ভিদজাত খাবারের পরিমাণ বাড়ালে হৃদপিন্ডের উপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, মানে হার্ট ভালো থাকে। এটা তখন আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। মূলত এই তথ্যগুলো প্রকাশ পাওয়ার আগে বহুবার পূর্ণগবেষণার পাল্লায় পড়তে হয়েছে। 

“আর গবেষকদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? সিনেটর ম্যাকগর্ভান পরে দু:খ করে বলেছিলেন যে, তিনিসহ পাঁচজন শক্তিশালী সিনেটরের ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়। কেন না, তাদের নির্বাচনী এলাকাটিই ছিল পশু-খামারের এলাকা। আর তিনি পশুজাত খাদ্যাভ্যাসের বিপক্ষে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদ্ভিদজাত খাদ্যাভ্যাসের মুখ্য প্রচারক।”

গবেষণা-গ্রন্থ The China Study-তে (ত্রিশ বছর গবেষণার পর) তিনি লেখেন, “আমেরিকান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সাইন্স (NAS)-এর উপকমিটিগুলোর প্রায় সবগুলোর সভাপতি ও সদস্যদের বেশির ভাগ বিজ্ঞানী পশুজাত-খাদ্য-উৎপাদনকারী-শিল্প কোম্পানির সাথে জড়িত। এদের মধ্যে বব ওলসন, আলফ্রেড হারপার ও টম জুকস এর মতো স্বনামধন্য বিজ্ঞানী, যারা অনেকগুলো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির বড় বড় পদে কর্মরত। তারা আবার বিভিন্ন পশুজাত-খাদ্য-উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চ-বেতন প্রাপ্ত উপদেষ্টা। এরকম ১৮ জন বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত কমিটি একটি ‘জাতীয় খাদ্যাভ্যাস, পুষ্টি ও ক্যান্সার নীতি’ প্রণয়ন করবে, যার মধ্যে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে যে, ক্যান্সারের সাথে মানুষের খ্যাদাভ্যাসের কোন প্রভাব আছে কি না। দেখা গেল, আমিই একমাত্র সবেধন নীলমনি, যার কোনো কোম্পানির সাথে কোনো প্রকার আর্থিক যোগাযোগ নেই। অতএব ঐ কমিটির রির্পোট কোন দিকে যাবে তা সহজেই অনুমেয়!

“কিছু কিছু পশুজাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দুগ্ধ উৎপাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ডিম উৎপাদনকারী কোম্পানি, মুরগির ফার্ম, ফাস্ট ফুড বিপন কোম্পানি ও ঔষধ কোম্পানি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এই ধরনের  বিজ্ঞানীদেরকে উচ্চ বেতনে উপদেষ্টা নিয়োগ করে, কোথাও বা কোম্পানির অংশীদার করে, কোম্পানির খরচে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দিয়ে, তাদের দিয়েই বৈধ প্রচারণা ও ব্যবসা চালিয়ে পকেট ভারি করে চলে। 

বিভিন্ন কোম্পানির সুবিধাভোগী কিছু কিছু বিজ্ঞানী মিলে নতুন কমিটি তৈরি করে প্রচার করতে থাকে, ‘কোলেস্টেরলের সাথে হার্ট ডিজিজের কোনো সম্পর্ক নেই, প্যাকেটজাত খাদ্য সংরক্ষণের সাথে অথবা স্যাক্কারিনের সাথে ক্যান্সার উৎপাদনসহায়ক কার্সিনোজেনের কোনো সম্পর্ক নেই।’
এদের বক্তব্যগুলো মিথ্যা প্রমাণিত করার যেন কেউ নেই। বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণালব্ধ তথ্য কী বলছে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না, ব্যবসায়িক লাভালাভটা ঠিক রাখাই হচ্ছে মূল কাজ। তাদের পদমর্যাদা জাতীয় নীতিনির্ধাণী সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে যথেষ্ট সক্ষম, কেননা, তাদের অনেকেই নীতিনির্ধারকেরও দায়িত্ব পালন করেন। আর এ জন্যেই এ রকম বলতে পারেন।” 

জুলাই মাস, ২০১৯। বাংলাদেশের সকল জাতীয় দৈনিকগুলো পাস্তুরিত দুধ নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ, উপসম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় কলামে লিখতে থাকে। বিষয় কী? বিষয়: খামারের ও পাস্তুরিত দুধে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন,  এনারোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও লেভোফ্লক্সাসিন নামক অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি। সেই সাথে পাওয়া গেছে ধাতব পদার্থ ক্যাডমিয়াম, সীসা, ক্ষতিকর ক্রোমোমিয়াম, ডিটারজেন্ট (সাবান) ও কীটনাশক। এগুলো মানবদেহে অতিরিক্ত জমা হলে এর বিষক্রিয়ায় ক্যান্সার, হার্টের রোগ, কিডনি রোগ ও চর্মরোগ হতে পারে। বাংলাদেশের সেরা সেরা নামিদামি ব্রান্ডের ১৫ দুগ্ধ বিপণন প্রতিষ্ঠানের দুধ ও ৫০টিরও বেশি খামার থেকে সংগ্রহ করা দুধ পরীক্ষা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক গবেষক আ ব ম ফারুক। এর ফলে তাকে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবের হুমকি, নিজের কোনো কোনো সহকর্মীর দায় অস্বীকার ও দুগ্ধ শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়। গবেষণাগুলো তাদেরকে বহুবার করতে হয়েছে। হুমকির পর আবার গবেষণা করে তিনি জাতীয় দৈনিকগুলোকে সরবরাহ করেন। (দৈনিক কালের কণ্ঠ ১৪/১৭/২২ জুলাই ২০১৯, দৈনিক উত্তরপূর্ব ২৫/৩০ জুলাই ২০১৯)। এখানেও ড. কলিন ক্যাম্পবেলের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটে। গরু মোটাতাজা করণের জন্যে ও গাভী থেকে বেশি দুধ পাওয়ার জন্যে গাভীকে বিভিন্ন ঔষধ খাওয়ানোর ফলে এমনটি ঘটে। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। 
তার চেয়েও ভয়ঙ্কর সংবাদ দেয় দৈনিক উত্তরপূর্ব (৪/৮/৩০১৯)। হেডলাইন: ‘৭৫ লাখ টাকা জরিমানা: শুকরের চর্বি ও মাংস দিয়ে তৈরি হচ্ছে ডেইরি ও পোল্ট্রি ফিড’... “ধামরাইয়ে কেবিসি অ্যাগ্রো (প্রা.) লিমিটেডে র‌্যাব-এর ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এগারো কোটি টাকা মূল্যের তিন হাজার মেট্রিক টন নিষিদ্ধ শুকরের মাংস, হাড় ও চর্বি জব্দ করেছে। এ ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষকে ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ভোজ্য তেল উৎপাদন কারখানা সিলগালা করা হয়েছে।” 

পরের খবর আর জানা যায় নি। একটু ভাবুন, মুরগিকে এরা কী খাওয়াচ্ছে আর দেশের মানুষ মুরগি নামে কী খাচ্ছে। ডেইরি থেকে কী খাচ্ছে! গবেষকরা দেখতে পান, একটি মুরগি লালন-পালনের জন্যে যে পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন, ফার্মগুলো সে পরিমাণ জায়গা দিচ্ছে না। তারা গায়ে গায়ে লাগানো অবস্থার মধ্যে মুরগি লালন-পালন করছে। ফলে মুরগি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। তখন এই ক্ষতি পোষানোর জন্যে ফার্ম মালিকরা মুরগির প্রতিবেলার খাবারে অ্যান্টিবায়োটিক ও হরমোন মেশাতে থাকে। এই মুরগিগুলো যখন মানুষের খাবার হয়, তখন সেই মুরগীর মাধ্যমে মানবদেহে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও হরমোন প্রবেশ করছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এটা নিয়ে কোনো ভোক্তা অভিযোগ করে না বরং অভিযোগ করে দাম বেড়ে গেলে। চিৎকার দেয়, দাম বেড়ে গেছে, দাম বেড়ে গেছে!

ড. কলিন ক্যাম্পবেল বলেন,“এখন যদি বলা হয় যে ‘আপনি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাবেন’, তাহলে কোন ফলের কথা আপনার মাথায় আসবে? কমলা। কমলা ছাড়াও আরো বেশি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি যে আপনার আশেপাশেই আছে এবং এগুলো আপনার জন্যে আরো সহজলভ্য, তা হয়তো আপনি জানেই না। পেয়ারা, জাম্বুরা, আনারস, ব্রোকলি, কাঁচামরিচ, কালো জাম, স্ট্রবেরি, লেবু, ডেফল, ডেউয়া, পিচফল, মটরশুটি, ফুলকপি (১০০ গ্রামে থাকে ৯১ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি), বাঁধাকপি, নানা প্রকার শাক ইত্যাদি অনেক ফল ও সবজি। একা পেঁপেই কমলার চেয়ে চারগুণ সি সমৃদ্ধ ফল।”

তবে কমলার কথা প্রথমেই মাথায় আসলো কেন? এর মূল কারণ কমলা-ব্যবসার সাথে জড়িত মার্চেন্টদের বিশ্বব্যাপী জুৎসই দক্ষ মার্কেটিং সক্ষমতা। তারা কোনো গবেষণার ধারে কাছে না গিয়ে বিজ্ঞাপন-আগ্রাসনকে কাজে লাগিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সফট ড্রিংক (এটা আরো ক্ষতিকর), সিরাপ বা সাপ্লিমেন্টের বিজ্ঞাপনে কমলাকে রগরগে উপস্থাপনায় ভোক্তার চোখে মেলে ধরছে, আর তৈরি করছে রসায়নিক পদার্থ দিয়ে ড্রিংক ও সিরাপ, যার পার্শপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোনো গবেষণামূলক তথ্য নেই। 

ব্যবসায়ীরা খুব বুদ্ধি করে সকল প্রোটিনের (All Protein Suplement) সাপ্লিমেন্ট বের করে নাম দিয়েছেন নিউট্রিলিট। আর বলছেন, ইহা নিয়মিত খেলেই হলো, আপনার প্রোটিনের প্রয়োজন মিটে যাবে। আপনি একবার এর প্যাকিং দেখলে এর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন।
কিন্তু ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর বিশেষ বিজ্ঞপ্তি সতর্ক করে দেয়,‘নিউট্রিলিট সম্পর্কে কোনো অযৌক্তিক দাবি করা ঠিক হবে না।’

১৯৮২ সালের জুন মাসে বের হল দীর্ঘ গবেষণালব্ধ আলোড়ন সৃষ্টিকারী রিপোর্ট। যাতে প্রমাণ করা হয়, খাদ্যাভাসের সাথে ক্যান্সারের গভীর সম্পর্কের সত্য কাহিনী। এটা ১৯৭৬ সালে ম্যাকগর্ভান কমিটির সমতুল্য একটি রির্পোট ছিল। তাতে স্পষ্টতই প্রমাণ করা হয়ে ছিল যে, পশুজাত ও চর্বিজাত খাদ্যাভ্যাস বাদ দিয়ে ফল ও উদ্ভিদজাত খাদ্যাভ্যাস ক্যান্সার প্রতিরোধে ও নিরাময়ে সক্ষম।  
“যেমন অনুমান করা হয়ে ছিল যে, এর বিপক্ষে অনেক স্বার্থান্মেষীরা সক্রিয় হবে। বাস্তবে তাই হলো। দু’সপ্তাহের ভেতরেই আমেরিকার “Council on Agriculture, Science and Technology (CAST)” ৫৬ জন বিশেষজ্ঞের একটি কমিটি করলেন, সরকারে যাদের প্রভাব ছিল, তারা দেখালেন, এই রির্পোট আমেরিকার কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্য-শিল্পে কত বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তারা এর বিপক্ষে নতুন একটি রির্পোট তৈরি করে আমেরিকার ৫৩৫ জন কংগ্রেসম্যানের হাতে হাতে বিতরণ করলেন। আর তাদের সাথে যুক্ত হলো American Meat Institute, National Broiler Council, National Cattlemen’s Association, National Livestock and Meat Board, National Meat Association, National Milk Producers Federation, National Pork Producers Council, National Turkey Federation and United Egg Producers.

সরকারের নীতি নির্ধারণী কার্যক্রমে এদের প্রভাব কতো তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আমরা জানতাম, তাদের রির্পোট বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণার ধারে কাছেও নেই।” 

“এত কিছুর পরেও নীতিবান কিছু বিজ্ঞানী তাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন, যার জন্যে আট হাজার মানুষের উপর আমাদের দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় ব্যাপী গবেষণার ফলাফল জনসমক্ষে আসার সুযোগ পেল।”

আপনার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে আপনি হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারসহ অনেক রোগের আক্রমণকে নাটকীয়ভাবে আটকে দিতে পারবেন বা কমিয়ে আনতে পারবেন। গবেষণাগুলো পরিচালনা করা হয়েছে যৌথভাবে এবং এর কোটি কোটি টাকার যোগান দিয়েছে বৃটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ‘চায়নিজ একাডেমি অফ প্রিভেন্টিভ মেডিসিন’। চায়নায় ডাক্তার চেন-এর নেতৃত্বে দু’শ’রও বেশি প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সহযোগিতায় দেশব্যাপী কয়েক বছর যাবৎ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণার ব্যাপ্তি আমেরিকা থেকে ফিলিপিন্স ও সেখান থেকে বৃটেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর এ সব কিছুর নেতৃত্বে ছিলেন প্রফেসর ইমিরিটাস ডাক্তার টি কলিন ক্যাম্পবেল, যার গবেষণার তিন শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশ হয়ে ছিল (The Lancet, The Medical Journal of England, Cardiology etc) বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান ও মেডিক্যাল জার্নাল সমূহে।

“ক্যান্সার নিরাময়ের ক্যামো ঔষধ প্রস্তুতকারী বিশ্বের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বৃস্টল মেয়ারস স্কুইব (Bristol Myers Squibb), আর বিশ্বের তামাকজাত দ্রব্যের বৃহৎ বিপনন কোম্পানি ফিলিপ মরিস (Philip Morris) দুই কোম্পানীর কি চমৎকার যোগাযোগ! এক কোম্পানি ক্যান্সারের ঔষধ তৈরি করে আর অন্য কোম্পানির দ্রব্য ক্যান্সার তৈরি করতে সাহায্য করে। রিচার্ড এল গেলব প্রথম কোম্পানির চেয়ারম্যান আর দ্বিতীয় কোম্পানির অংশীদার।” - How You Can Return From Hospital Alive by Dr. Biswaroop Roy

বিষয় খুবই পরিস্কার। এমন কিছু তৈরি করো, যা খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়, আর সেই রোগের ঔষধ তৈরি করো, যা নিরাময়ের জন্যে সে ব্যবহার করে! আর নিরাময়ের জন্যে হাসপাতাল তৈরি করো, যাতে এখানেই তাকে আসতে হয় এবং বার বার আসতে হয়। এভাবে মানুষকে ব্যবসার জালে আটকে ফেলো! আর পকেট ভারী করো! 

১৯৬৫ সালের ঘটনা। “ক্যালিফোর্নিয়া মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন”-এর দু’জন ডাক্তার ম্যাকডোনাল্ড এবং ডাক্তার গারল্যান্ড (Dr. Mc Donald and Dr. Garland) প্রচার করতে থাকলেন, “দিনে যদি কেউ চব্বিশটি সিগারেট পান করে, তবে সে ফুসফুস ক্যান্সারকে প্রতিহত করতে পারে। তাই প্রত্যেকেরই দিনে অন্তত ২৪টি সিগারেট পান করা উচিত। তারা বলতে থাকলেন, আমরা নিয়মিত পান করছি এবং সুস্বাস্থ্যে আছি।” 

প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ! একদিন সিগারেটের বাট এর আগুন থেকে ঘরে আগুন লাগে এবং তিনি পুড়ে মারা যান। এই দুর্ঘটনার কয়েক বছর পর ডাক্তার গারল্যান্ড ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাদের মৃত্যুর পর এই স্লোগানটিও মারা যায়, “24 Cigarettes a day keeps lung cancer away”. . 

সর্বপ্রকার বেবি ফুড ও মিল্ক পাউডার ‘সাপ্লিমেন্ট ক্যাটাগরি’তে পড়ে। যাদের জীবন শুরু হয় এগুলো খেয়ে, পরিণত বয়সে বা তার আগেই তাদের ডায়াবেটিস টাইপ ওয়ান এবং অটোইমিউন ডিজিজ বা অন্যান্য রোগ হতে পারে। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আহমদ মরতুজা চৌধুরী বলেন,“টিনজাত ও প্যাকেটজাত দুধ, ফলোঅন ইত্যাদি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর টাকা বানাবার ফাঁদ। এগুলো শিশু-দেহে ডায়াবেটিস ও হার্ট ডিজিজের বীজ বপন করে। ...টিনের দুধ খাওয়ানোর পর এই দুধের অতিরিক্ত চর্বি শিশু হজম করতে পারে না। দুধের অতিরিক্ত চর্বি ফেনা হয়ে পায়খানা দিয়ে আমাশয়ের মতো বের হয়ে যায়।.... পুঁজিপতিরা তরুণ কিশোরদের কাছে পানীয় বিক্রি করে ও পরিণত বয়সে স্বাস্থ্যসেবা বিক্রি করে বা হার্টের অসুখের জন্যে স্টান্ট বা বাইপাস করে বা ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করে এবং বুড়ো বয়সে কিডনির চিকিৎসা করে ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করে মানুষের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা পুঁজিপতিদের চিকিৎসা বাণিজ্যের এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়।... শিশুর সঠিক পুষ্টিকর খাদ্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অখাদ্য-কুখাদ্য দিয়ে ¯্রষ্টা প্রদত্ত শিশুর সুন্দর শরীর নষ্ট করে টাকা কামিয়ে নেয় প্রতারক গোষ্ঠী।” - শিশুর খাবার ও খেলাধুলা।
“গ্রিন টি হচ্ছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের এক সরবরাহকারী। ইহা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার আটকে দিতে কাজ করে, রক্তে চর্বি জমতে বাঁধা দান করে, কোলেস্টেরলের মাত্রা নামিয়ে আনতে সাহায্য করে, রক্তচাপ নামিয়ে আনতে কাজ করে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ও দাঁতের সুরক্ষায়ও কাজ করে। আর আবহাওয়ার পরিবর্তনে যারা এলার্জিতে ভোগেন, তারাও ইহা ব্যবহারে সুফল পাবেন। রান্না করা মাংস থেকে উৎসারিত কার্সিনোজেনের বিপক্ষে কাজ করে গ্রিন টি ডিএনএ কে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এই সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা ‘গ্রিন টি এক্সট্রেক্ট পিল’ মানে গ্রিন টি-এর বড়ি বানিয়ে ফেলেছে! এর বিষাক্ততার ডজন ডজন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তাই বিশ্বের নামকরা কোম্পানিগুলোর এই ধরনের ‘বিস্ময়কর বড়ি’ থেকে দূরে থাকবেন।” - How Not to Die by Dr Michael Gregar, MD

ইওরোপ ও আমেরিকায় বয়স চল্লিশের পরে নিয়মিত কোনো না কোনো রোগের ঔষধ ব্যবহার করেন না, এমন লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া ভার। ঔষধ কোম্পানিগুলো তাদেরকে পাকাপাকি খদ্দের (Permanent Customer, রোগী নয়) বানিয়ে ফেলেছে। আপনি কোনো প্রকার ঔষধ ব্যবহার না করলে বরং তারা বিস্মিত হয়।এর মূলে রয়েছে কোম্পানিগুলোর সুচতুর বিজ্ঞাপন ও সুদক্ষ প্রমোশনাল কার্যক্রম।

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধের দাম যাই হোক, এর পাশর্^প্রতিক্রিয়া বড় চড়া! এটি লিভারের ক্ষতি(damage) করতে পারে, চোখে ছানি বাধাঁতে পারে, পরিপাক তন্ত্রের ক্ষুদ্রান্তে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, ডায়াবেটিস হতে পারে (FDA Warning 2012), পেশির ক্ষতি করতে পারে, স্মরণ শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে (FDA Warning 2012), ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্ভাবনা ১১ গুণ বৃদ্ধি করতে পারে  (New England Journal of Medicine 1996), নাকের বিভিন্ন সমস্যা ও পেট ব্যথাও হতে পারে।” 

ডাক্তাররা কোনো পাশর্^ প্রতিক্রিয়ার কথা রোগীদেরকে সাধারণত: বলেন না, কথা বলে সময় নষ্ট না করে তারা ঔষধের পর ঔষধ লিখে যান। যখনই আপনি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবন করছেন, তা ব্রেনের কোলেস্টেরলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে স্মরণশক্তি, বাড়ছে হতাশা ও অস্থিরতা। ২০০৪ সালে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ঔষধ স্ট্যাটিন ড্রাগ-এর আবিস্কারক মি: ইন্ডোকে চিকিৎসক যখন পরামর্শ দিলেন যে, আপনার কোলেস্টেরল বেড়ে গেছে, আপনাকে স্ট্যাটিন নিতে হবে। আবিস্কারক মি: ইন্ডো তা গ্রহণ করতে রাজি হন নি। তিনি জানেন, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতো ভয়াবহ! যেভাবে ফেসবুকে ‘লাইক’ ফিচারের উদ্ভাবক জাস্টিন রোজেনস্টেইন তার মোবাইল থেকে ‘লাইক’ ফিচারটি বন্ধ করে রেখেছেন, তিনি জানেন এর ক্ষতিকর দিকগুলো কতো ভয়াবহ!

আবার দেখুন, হার্ট ডিজিজের ব্যবসা শুরু হয় বুক ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে রোগী যখন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যায়, তখন থেকে। ডাক্তাররা অর্থ উপার্জনের সবচেয়ে সহজ কাজটি আগে করেন দারুন দক্ষতায়, অনেকগুলো পরীক্ষা (Diagnostic Tests) দেন; যেমন এক্স-রে, সিএটি স্ক্যান, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি। আর এগুলোর জন্যে রয়েছে অনেক দামে কেনা, কোথাও বা ধারে কেনা অত্যাধুনিক মেশিন, যার রয়েছে মাসিক কিস্তি। আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন “The Hospital War” শীর্ষক নিবন্ধে খুব চমৎকার ভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। ঐ মেশিনগুলোর মাসিক কিস্তি কোথা থেকে আসবে? ডাক্তারদেরকেই সুনিপূণভাবে দায়িত্বটি পালন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে আগেই মনে মনে ঠিক করে নিতে হয়, এ মাসে কতোগুলো সিএটি স্ক্যান বা সিটি স্ক্যান করতে হবে। ড. বিশ্বরূপ রায় বলেন, “এগুলো রোগীর জন্যে শুধু যে অপ্রয়োজনীয় তা-ই নয়, রোগীর দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। যেমন, সিএটি স্ক্যান করতে পুরো দেহকে ৬৪ ভাগে ভাগ করে করে ১৫.২ এমএসভি রেডিয়েশন দিতে হয়। এমন মেশিন এখন আবিস্কার হয়ে গেছে, দেহকে ১২৮ ভাগে ভাগ করে রেডিয়েশন দেয়। মহিলাদের বক্ষ মাংশল থাকার কারণে তাদেরকে দিতে হয় ২১.৪ এমএসভি রেডিয়েশন, তাতে হার্টের একট পরিস্কার ছবি পাওয়া যায়। আর এটা যে কত বড় মাত্রার ক্ষতি, তা বুঝার জন্যে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাটম বোমার আক্রমণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ওখানকার মাত্রা ছিল ৫-২০ এমএসভি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ এমএসভি। এর ফলে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল, এখনো ওখানে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করে। তো এই রেডিয়েশন সারা জীবন রোগীর দেহে থেকে যায়। 

“এর পরেরটা হল করনারি এনজিওগ্রাফি। রোগীর হাত বা পায়ের রক্তনালীর ভেতর দিয়ে একটা সুক্ষ্ম ক্যাথেটার চালিয়ে দেওয়া হয়। কিডনি, কলজে ইত্যাদির ভেতর দিয়ে সুতোর মতো ক্যাথেটারটি হার্টের যেখানে কোলস্টেরল জমে রক্তনালী ব্লক হয়েছে, সেখানে পৌঁছে। একটি ইনজেকশনের মাধ্যমে কিছু তরল পদার্থ (ডাই) ঢুকিয়ে ডাক্তার অনুমান করেন, এটির সাইজ কত বড়। এই অনুমান ডাক্তার ভেদে ভিন্ন হয়। এনজিওগ্রাম সম্পন্ন হওয়ার সময় শতকরা এক জন, কোথায় কোথায়ও দুই জন রোগী মারা যান। কিছু রোগী সারা জীবনের জন্যে পঙ্গুও হয়ে যান। সৌভাগ্যক্রমে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবে সম্পন্ন হলে, ডাক্তারের সিদ্ধান্তে হয় এনজিওপ্লাস্টি হবে অথবা বাইপাস সার্জারি হবে। কিছু কিছু ডাক্তার একে এমন ভাবে উপস্থাপন করেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগী ভয় পেয়ে বাধ্য হয় এগুলো করতে। এনজিওগ্রাম সম্পন্ন হওয়ার পর কিছু কিছু লোভী ডাক্তার রোগীকে আর সময় দিতে চান না, বলেন এটা আজই করা জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান, না হলে আমাকে দোষ দেবেন না, যে কোনো সময় জীবন-সংকটে পড়তে পারেন। রোগী এটা শুনে ভয় পেয়ে যান এবং ডাক্তার যা বলেন, তা করতে তৈরি হয়ে যান মূলত: নিঃস্ব হওয়ার জন্যে। 

এনজিওপ্লাস্টি বা রিং পরিয়ে দেওয়ার ফলে রক্তনালীর চর্বি রক্তনালীর দেওয়ালের দিকে চেপে রাখা হয়, রক্তনালীর ভেতরে রক্ত চলাচলের পথ প্রশস্থ হয়ে যায়, বুকে ব্যথা দূর হয়ে যায়। কিন্তু এর পাশর্^ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। আর এর খরচ মূলত রোগীর জন্যে একটা বোঝা। একটা রিং-এর দাম মাত্র দশ হাজার টাকার মধ্যে রাখার জন্যে ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালাম চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এখনো এর দাম ও লাগানোর প্যাকেজ খরচ শুরুই হয় সত্তর বা আশি হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ, দুই লক্ষ, এমন কি তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত, যার পুরোটাই ব্যবসা। আর সার্জারি হলে তো কথাই নেই, এর মূল্যটা ভালো করেই গুণতে হয় রোগীদেরকে। এরপর পড়তে হয় আসল ভোগান্তিতে। ব্যথা দূর হয়, কিন্তু ডাক্তার, ঔষধ ও হাসপাতালে চক্র থেকে রোগী মুক্ত হতে পারেন না। রোগীর জীবনযপন হয়ে যায় ডাক্তার নিয়ন্ত্রিত, স্বাধীন জীবনের ইতি ঘটে।

Archives of Internal Medicine (Medical Journal) 2012-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৭২২৯ রোগীকে এক চল্লিশ বছর নিরীক্ষা করা হয়, তাতে দেখা যায়, যারা বাইপাস করিয়ে ছিলেন বা রিং নিয়ে ছিলেন এবং আক্রান্ত হয়েও যারা এর কোনো কিছুই করান নি, তাদের জীবন যাত্রার মধ্যে কোনো পার্থক্য ধরা পড়ে নি। বাইপাস সার্জারি বা রিং তাদেরকে সাময়িক ব্যথা-নিবারণ ছাড়া আলাদা কোনো সুবিধা দিতে পারে নি, বরং বার বার তাদেরকে ডাক্তারের কাছে আসতে হয়েছিল। ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি The  New York Times একই বিষয় নিয়ে একই রকম নিবন্ধ প্রকাশ করে ছিল। চিকিৎসা নেওয়ার ফলে লাভের চেয়ে রোগীদের ক্ষতি হয় বেশি। এর পাশর্^ প্রতিক্রিয়া হিসাবে রোগীরা ব্যক্তিত্বে ভারসাম্যহীনতা, অনিশ্চয়তা বোধ ও ভীতিতে ভোগে। আর এগুলো ঘটে পাঁচ বছরের মধ্যে। এবং ১% জন তো অপারেশন টেবিলেই মারা যায়। এ জন্যে ২০০৬ সালের ২৮ মে প্রকাশিত Business Week-এ দু’টো প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি তোলে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবসার সাথে জড়িত শক্তিমান প্রতিষ্ঠান ও পাওয়ারফুল ব্যক্তিদের জন্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি।”

“নিজের সুস্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে”, বলেন ধ্যানগুরু শহীদ আল বোখারী মহাজাতক। তিনি আরো বলেন, “আপনার মন হচ্ছে সেরা ডাক্তার আর দেহ হচ্ছে সেরা ফার্মেসি।” আমেরিকান স্বনামধন্য কার্ডিওলজিষ্ট ড. ডিন অরনিশ একই কথা বলেন। তিনি বলেন,“আমাদের গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, বুঝে উঠার আগেই মানবদেহ প্রয়োজনে নিরাময় শুরু করে দেয়, মানবদেহের রয়েছে নিজস্ব নিরাময় ক্ষমতা।” - ‘The SpectrumÕ by Dr Dean Ornish (ক্লিনিক্যাল প্রফেসর অফ মেডিসিন, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকার ‘প্রিভেন্টিভ মেডিসিন রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, হার্ট ডিজিজ নিরাময়ে বিশ্বে পথপ্রদর্শনকারী বই Program for Riversing Heart Disease এর লেখক।) 

আমার নিজের ও অনেক বন্ধুদের দেখেছি, কোমর ব্যথা হয়েছে, ইয়োগা আর মেডিটেশন করছেন, সেরে গেছে। বেশি হয়েছে, তিন দিন সকাল বিকাল ইয়োগা আর সকাল বিকাল মেডিটেশন, আধা ঘন্টা হেঁটেছেন, ধৈর্য ধরেছেন, দোয়া করেছেন, হিলিং-এ নাম দিয়েছেন, অপেক্ষা করেছেন, সুস্থ হয়েছেন। এ সময় ফোনে কেউ যখন,‘কেমন আছেন জিজ্ঞেস করেছেন’, তখন জবাব দিয়েছেন হাসতে হাসতে, “শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি।” এবং সত্যিই সুস্থ হয়ে গেছেন। আমরা বলি, মন ভালো তো সব ভালো। এবং অবশ্যই বলি, মন ভালো তো ইনশাআল্লাহ্ ভালোই থাকবেন।
মূল কথা: আপনি সুস্থ থাকলেই হলো। মানে আপনি অসুস্থ হয়ে ঔষধ ও  হাসপাতালে না গেলেই হলো, ব্যবসায়ীরা আপনাকে তখন কিছু করতে পারবে না। আর এ জন্যে প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেনতা, সৎসংঘে একাত্ম থাকা। নিয়মিত মেডিটেশন আপনাকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করবে। আপনি অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন আর স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে ম্ক্তু থাকতে পারবেন। মনে রাখবেন, একবার এই ব্যবসার ফাঁদে পড়ে গেলে এ থেকে বেরুনো আপনার জন্যে অনেক অনেক কঠিন হতে পারে। আপনি সর্বস্বান্ত হয়ে সুস্থ নাও হতে পারেন। তাই ভালো থাকার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুন। 


লেখক পরিচিতি: স্বাস্থ্য বিষয়ক নিবন্ধ লেখক ও গ্রন্থ প্রণেতা। 


ক্যাটেগরিঃ স্বাস্থ্য,


Tanvir



আরো পড়ুন