English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২০-১০-০৪ ০১:১২:৩৮
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৫ ০১:০২:৪৯


বিগ ডেটা: আবেগ বাজারজাতকরণ ও মালিকানাবিহীন গোপনীয়তা

বিগ ডেটা: আবেগ বাজারজাতকরণ ও  মালিকানাবিহীন গোপনীয়তা


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান


তারা জানে আপনার নাম, ফোন নাম্বার, কোথায় আপনি থাকেন, আপনার কেনার ক্ষমতা আগ্রহের বিষয় এমনকি আগামীতে আপনি কোন জিনিসগুলো কিনতে চাইবেন- যা হয়তো এখনো আপনি নিজেই ভাবেন নি!

অ্যাকজিওমনামটি হয়তো আপনার কাছে অজানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনার নাম-পরিচয় কিন্তু তাদের জানা! অ্যাকজিওম সম্পর্কে বলা হয়, ‘সবচেয়ে বড় কোম্পানি যার নাম আপনি জানেন না অ্যাকজিওম হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ডেটা ব্রোকারিং ফার্ম যাদের কাজ মূলত সোশাল মিডিয়া এবং অন্যান্য মাধ্যম থেকে আপনার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ ফলাফল বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সংগঠনের কাছে বিক্রি বা সরবরাহ করা অ্যাকজিওমের মতো এমন একশোর ওপর প্রতিষ্ঠান আছে; যারা আপনার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করছে আপনার চলাচল এবং কর্মকাণ্ডকে নজরদারি করছে

অ্যাকজিওমের এক বছরের আয় এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই আয় করেছে তাদেরঅ্যানালিটিকাল সার্ভিস’ বাবদ যার মাধ্যমে ১৪৪ মিলিয়ন বাড়ির খবর তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেছে এটা একটি খণ্ডিত হিসাব সারা বছরে এই তথ্য কেনাবেচা হয় ৩০০ বিলিয়ন ডলার এবং এই ব্যবসায় এখন শুধু আমেরিকাতে ত্রিশ লাখ মানুষ কর্মরত আছেন ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইন্সটিটিউট সেই হিসাবই জানাচ্ছে

অ্যাকজিওমের চিফ একজিকিউটিভ অফিসার স্কট হাও কথা বলেন সিএনএনের সঙ্গে তিনি জানান, ‘আমাদের মতো কোম্পানিগুলো কাঙ্খিত মানুষটি কেমন, তার বিস্তারিত তথ্য, তিনি কোন বিষয়ে আগ্রহী হবেন বা কী কিনতে চাইবেন- সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করি এরপর আমরা তাকে বিশ্লেষণ করে ঠিক করি তাকে কোন ধরনের প্রডাক্টের অফার পাঠাবো এবং কোন জিনিস কিনতে তিনি ভবিষ্যতে আগ্রহী হবেন আমরা যে তথ্য সংগ্রহ করি তা যথাযথ, নিরাপদ এবং বৈধ

স্কট জানান ফরচুন ঘোষিত সেরা ৫০০ কোম্পানি থেকে শুরু করে ছোট কোম্পানি পর্যন্ত সবাইকেই তারা তথ্য সরবরাহ করেন এই সব বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো তাদের ক্লায়েন্টদের কাছে ব্যক্তির সকল তথ্য বিক্রি করেন যাতে তাদের বিজ্ঞাপন দিতে কোনো অনুবিধা না হয় তিনি মনে করেন না পৃথিবীতেএমন কোনো ব্যক্তি আছেনযিনি ডেটা ব্যবহার করেজনগণ ব্যবসার এই যৌথ উপকারনিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবেন

স্কট আরো বলেন, এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এক ধরনের শিক্ষার বিস্তার ঘটছে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করে তারা ব্যবসার প্রাণ রক্ষা করছেন বলে তিনি মনে করেন তিনি অবলীলায় জানান, ‘আমরা বিভিন্ন কনটেন্টের তথ্য, স্থান কাল এবং কাঙ্খিত ব্যক্তির সকল কর্মকাণ্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করি তারপর এই সব তথ্যের বিশ্লেষণ করে একটি সামগ্রিক চিত্র তৈরি করি যাতে ক্রেতা কী চায় তা পরিপূর্ণভাবে ফুটে ওঠে

এই ধরনের ডেটা ব্রোকারিং কোম্পানিগুলোর সমালোচকরা বলেন, সাধারণ মানুষরা বুঝতেই পারেন না তাদের কতো গোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়ে এই কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে নিজস্ব গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকছে না

গোপনীয়তা বিশেষজ্ঞ সারাহ ডোনি বলেন, ‘মুদ্রার অপর দিকটি হলো, তারা আপনার ভার্চুয়াল জগতের সকল তথ্য নিয়ে বাস্তব জগতের আপনাকে পরিচালিত করছে

 

ডেটা ব্রোকাররা যে সব তথ্য সংগ্রহ করে তার মধ্যে আছে:

নাম, বয়স, লিঙ্গ

ছবি

জন্মদিন

বর্তমান আগের ঠিকানা

মোবাইল নাম্বার

ইমেইল

বৈবাহিক অবস্থা

সন্তানের নাম বয়স

মালিকানাধীন সম্পদের বিবরণ

বাড়ি ভাড়া না নিজের মালিকানধীন

ফ্ল্যাটের মাপ

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

আয়ের বিবরণ

শিক্ষা অন্যান্য তথ্য

আরো যেসব তারা সংগ্রহ করে তার মধ্যে বিয়ে, ডিভোর্স, সন্তান, সম্পর্কসহ নানা তথ্য

 


গোপনীয়তার নেই মালিকানা

ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, জিমেইল, ইয়াহুসহ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া পৃথিবী জুড়েই ফেসবুকের গ্রাহক ছড়িয়ে আছে কারণে গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য ফেসবুক সব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পছন্দ! ২০১৮ সালের এক হিসাব অনুসারে দুই বিলিয়নের বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছেন প্রতিদিন একশ পনের কোটি মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে ফেসবুক ব্রাউজ করছেন; যা মোবাইলে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপন আয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে ফেসবুকের বিজ্ঞাপন বাবদ আয় হয়েছে ১১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার ২৪ থেকে ৩৪ পর্যন্ত বয়সীরা সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের শতকরা ৫০ জনই ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো ফেসবুক ব্রাউজ করা ব্যবহারকারীরা প্রতিবার ফেসবুকে লগইন করলে গড়ে ২০ মিনিট করে সময় কাটান ফেসবুকে প্রতি ৬০ সেকেন্ড বা এক মিনিটে ,১০,০০০ কমেন্টস পোস্ট করা হয়, ,৯৩,০০০ স্ট্যাটাস আপডেট হয় এবং ,৩৬,০০০ ছবি পোস্ট করা হয় দশমিক ৭৫ বিলিয়ন কনটেন্ট প্রতিদিন শেয়ার করা হচ্ছে ফেসবুকে কমপক্ষে আট কোটি ত্রিশ লাখ অ্যাকাউন্ট জাল বা ভুয়া যে ব্যক্তিদের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই সংখ্যার হিসাবে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের জনসংখ্যার চেয়েও ফেসবুকের ভুয়া অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা বেশি

এতো তথ্য যাকে এখনবিগ ডেটাবলা হয়, এই সব তথ্য নিয়েই নানামুখী ব্যবসা করছে ফেসবুক ব্যক্তি আবেগের বাজারজাতকরণের এই প্রতিযোগিতা এখন পৃথিবীর সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে  এনটিভি প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, “মোবাইল ফোনসহ অন্য ডিভাইস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য দেয়ার অনুমতি দিয়েছে ফেসবুক জানা যায়, গত এক দশকে সারা বিশ্বের স্মার্টফোনগুলো দিয়ে যখন ফেসবুক ব্যবহার শুরু হয়, তখনই প্রতিষ্ঠানটি অ্যাপল, অ্যামাজন, ব্ল্যাকবেরি, মাইক্রোসফট, স্যামসাংসহ প্রায় ৬০টি ডিভাইস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের চুক্তি করে

এই চুক্তির মাধ্যমে ফেসবুক আরো বেশি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারবে কিন্তু এই চুক্তির বিষয়টি আগে প্রকাশ করা হয় নি তাই  ফেসবুকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন প্রাইভেসি বা  গোপনীয়তা সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই এমনকি ব্যবহারকারীদের ফেসবুক-বন্ধুদের তথ্যও তারা পেয়ে যাবেন কোনো ধরনের সম্মতি ছাড়াই যদিও ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ধরনের তথ্য আর কখনো শেয়ার করা হবে না

নিউ ইয়র্ক টাইমসের দেয়া তথ্য মতে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি মনে করে তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেয়া হচ্ছে না, তাহলে তারা ব্যবহারকারীদের ফেসবুক-বন্ধুদের কাছ থেকেও তথ্য নিতে পারবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই চুক্তি বর্তমানে চলমান রয়েছে ....

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গোপনীয়তা বিষয়ক গবেষক সের্গেই অ্যাজেলম্যান বলেন, ‘আপনারা হয়তো বা ভাবতে পারেনফেসবুক আর ডিভাইস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভরযোগ্য কিন্তু সমস্যা হলো, একটা মোবাইল ফোনে যতো বেশি তথ্য জমা হতে থাকে এবং সেখানে যতো বেশি অ্যাপস ঢোকানো হয়, এটা ততোই গোপনীয়তা নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ায়

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে ব্যবহারকারীর সম্পর্কের অবস্থা, ধর্মীয় রাজনৈতিক শিক্ষা, কোনো অনুষ্ঠানের তথ্যও নিয়ে নিতে পারবে নিউ ইয়র্ক টাইমস পরীক্ষা করে দেখে, ফেসবুক ব্যবহারকারীরফ্রেন্ডস’-এরও তথ্য পেয়ে যাবে মোবাইল প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি যারা ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, তাদের তথ্যও পাবে

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফেসবুকের বেশ কয়েকজন সাবেক সফটওয়্যার প্রকৌশলী এবং নিরাপত্তা গবেষক বলেন, ফেসবুকের তথ্য শেয়ার করতে না চাইলেও তা অন্যের হাতে চলে যাওয়ায় আশ্চর্য হয়েছেন তারা গবেষক গোপনীয়তা বিষয়ক পরামর্শক আশকান সোলতানি বলেন, ‘এটা এমন যে, ঘরের দরজায় তালা দিয়ে সব বন্ধুকে চাবি দিয়ে রেখেছেন এবং তারা এসে অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢুকে লুটপাট করে যেতে পারবে

 

ফেসবুক তার ব্যবহারকারীর তথ্যকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করছে যে, সম্প্রতি ঘোষণা দেয়া হয়েছে, একজন ব্যবহারকারী কবে মারা যাবেন সে বিষয়েও আগাম জানিয়ে দেবে ফেসবুক! নিউ ইয়র্ক টাইমস, বৃটিশ পত্রিকা ইনডিপেন্ডেন্ট প্রকাশিত এই খবরটি দেশের কিছু পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে প্রথম আলো জানায়, “মৃত্যুর পূর্বাভাস জানানোর অ্যালগরিদম তৈরিতে একটি পেটেন্ট আবেদনও করেছে ফেসবুকদি প্রেডিকটিং লাইফ চেঞ্জেসনামের ওই পেটেন্টের খবর প্রথম জানায় নিউ ইয়র্ক টাইমস তাতে বলা হয়, লাইফ চেঞ্জ প্রেডিকশন ইঞ্জিন নামের যে প্রযুক্তি তৈরি করা হবে, তাতে ফেসবুক ব্যবহারকারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পূর্বাভাস থাকবে এর মধ্যে বিয়ে, জন্মদিন, নতুন চাকরি, শিশুর জন্ম, পড়াশোনা এমনকি মৃত্যুর পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে

বিশ্লেষকরা বলছেন, ধরনের অ্যালগরিদম তৈরির কারণ হচ্ছে বিজ্ঞাপন একজন মানুষের জীবনের গভীর তথ্য জানার ফলে তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞাপন দেখাতে পারবে ফেসবুক যেমন  ফেসবুকের অ্যালগরিদম যদি বুঝতে পারে কেউ গর্ভধারণ করেছে, তখন তার সামনে শিশুর নানা পোশাক, খাবারের বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করবে

 


যেভাবে চুরি হচ্ছে আপনার তথ্য

বিচিত্র পদ্ধতিতে অনলাইনে দেয়া আপনার তথ্য চুরি করছে বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্ঠান কিছু বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়েছে হ্যাস্ট্যাকডিএনএ তেমনি এক প্রতিষ্ঠান তারা ব্যক্তির আবাসিক এলাকাকে বিশ্লেষণ করে অ্যারিয়াল ভিউর সহায়তায় তারা দেখে সে বাড়িতে সোলার প্যানেল লাগানো আছে কিনা এর অর্থ বাড়ির মালিক পরিবেশ সচেতন তখন পরিবেশ বান্ধব প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন তাকে দেখানো হয়

ডেটামাইনর কোম্পানিটি প্রতিদিন টুইটারের ৫০০ মিলিয়ন টুইট বিশ্লেষণ করে তারা বোঝার চেষ্টা করে এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কোনগুলো হতে পারে এর ওপর ভিত্তি করে সামাজিক পরিস্থিতি, কোন খবরটি এখন গুরুত্বপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করতে পারে তাদের ক্লায়েন্টদের প্রয়োজনীয় তথ্যের অ্যালার্ট মেসেজ পাঠায় তারা

ইভলভ আরেকটি বিগ ডেটা কোম্পানি; যারা কাজ করে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়ে কর্মীদের ইন্টারনেট ব্যবহার বিশ্লেষণ করে কর্তা ব্যক্তিদের রিপোর্ট করে তারা তাদের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিফল্ট ওয়েব ব্রাউজারের বদলে যারা গুগুল ক্রম বা মজিলা ফায়ার ফক্স ব্যবহার করে তারা চাকরিতে বেশি ভালো করে

ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড বিশ্লেষণ করে একজন ক্রেতা ভবিষ্যতে কোন জিনিসটি কিনতে পারেন তা অনুমান করা সম্ভব এই তথ্য বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো কাজে লাগাচ্ছে তাদের টার্গেট করা ক্রেতার কাছে নানা মাধ্যমে সেই সব পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা হচ্ছে

পরিবারগুলোর লাইফস্টাইলও পর্যবেক্ষণ করা হয় পরিসংখ্যানবিদ অ্যান্ড্রু পল দেখিয়েছেন, কীভাবে বাজার থেকে প্রোডাক্ট কেনা দেখে বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো বুঝতে পারে সে পরিবারে কেউ প্রেগনেন্ট আছে এবং তাদের কাছে নবজাতক সংক্রান্ত সব পণ্যের বিজ্ঞাপন হাজির করা হয়

হানিলিজার টুলটি ব্যবহার করে সফটওয়্যার ডেভেলপাররা যারা গেম খেলেন তাদের কাছে বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিচ্ছেন

ইমেইল বিশ্লেষণ করেও বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে ধরা যাক, কেউ জিমেইলে তার বন্ধুকে মেইল করলেন তার পোষা কুকুর বা বিড়াল বিষয়ে দেখা যাবে যিনি মেইল করেছেন তার জিমেইল বা গুগল সংক্রান্ত বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি হঠাৎ করেই পোষা কুকুর-বিড়াল সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখা শুরু করবেন এটা বিগ ডেটা বিশ্লেষণে সম্ভব এবং গুগল অ্যাড এই কাজটি নিয়মিতই করে আসছে আপনার ইনবক্সে জমে থাকা ইমেইল এখন কোম্পানিগুলোর অন্যতম লক্ষ্যবস্তু

সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে বা রাজনীতির গতি প্রকৃতি বুঝতেও বিগ ডেটা ব্যবহার করা হচ্ছে সম্প্রতি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় চায়নায় সোশাল মিডিয়ার এমন সব পোস্ট নিয়ে কাজ করা হয়েছে যেগুলো চায়নিজ সরকার নিষিদ্ধ করে ডিলিট করে দিয়েছে এই সকল পোস্টের স্ন্যাপশট তারা সংগ্রহ করে গবেষণা করে দেখছেন কেন চায়নিজ সরকার এগুলোকে ডিলিট করেছে বা এর মধ্যে সামাজিক কোন বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে

 


আধুনিক টিপসই আই অ্যাকসেপ্ট

বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো দাবি করে তারা এসব কাজ বৈধভাবে করছে এর পেছনে কারণ হচ্ছে যখন কেউ কোনো ইমেইল আইডি খোলেন কিংবা সোশাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খোলেন তখন সেখানে যে টার্মস অফ সার্ভিস (টিওএস) বা টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন থাকে তা না পড়েইআই অ্যাগ্রিবাআই অ্যাকসেপ্টবাটনে ক্লিক করেন আগেকার দিনে জমিদাররা তাদের অজ্ঞ প্রজাদের কাছ থেকে যেমন টিপসই নিয়ে নিতেন অনেকটা একই পদ্ধতিতে এখনকারজমিদারএসব কোম্পানিশিক্ষিতগ্রাহকদের ডেটা ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে নিচ্ছে কৌশলে এসব টার্মসে নানাভাবে তথ্য ব্যবহার করার কথা থাকে কিন্তু পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা টার্মস অফ সার্ভিস বা টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন পড়ার অবস্থা অধিকাংশ ব্যবহারকারীর থাকে না একই বিষয় ঘটে যখন গুগল প্লে স্টোর থেকে কোনো অ্যাপস নামানো হয় তখনও গ্রাহকের সব তথ্যে প্রবেশের অনুমতি দিয়েই কিন্তু অ্যাপসটি ব্যবহার করা হয় একই কথা আই ফোনের বেলায়ও প্রযোজ্য

টার্মস অফ সার্ভিস অনুমোদন লাভের মাধ্যমে বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া কীভাবে সুযোগ নিচ্ছে তার কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে

গুগল তার ব্যবহারকারীর সকল হিস্ট্রি ডেটা সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের অধিকার রাখে একই সঙ্গে গুগল তার ব্যবহারকারী যদি অন্য ওয়েবসাইট ব্রাউজ করেন তবে সেটাও তারা তাদের অ্যানালিটিকস সফটওয়্যার ব্যবহার করে তা অনুসরণ করতে পারে ইউটিউব তার ব্যবহারকারীর সকল ডেটা সংরক্ষণ করে ব্যবহারকারীর ডিলিট করা ভিডিও ইউটিউবের মূল সাইট থেকে ডিলিট হয় না তারা সেটা অপ্রকাশিত অবস্থায় রেখে দেয় তারা টার্মস অফ সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর যে কোনো কনটেন্ট কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ডিলিট করে দিতে পারে এমনকি তারা তাদের নীতিমালাও যে কোনো মুহূর্তে পরিবর্তন করতে পারে কাউকে না জানিয়ে

ফেসবুক তাদের টার্মস অফ সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অন্য ওয়েবসাইটে কী দেখছেন তা দেখার অধিকার রাখে তারা সে সব তথ্য অটোম্যাটিক শেয়ার করতে পারে অ্যানড্রয়েড ফোনে ফেসবুকের টার্মসে আরো যা থাকে তাতে ব্যবহারকারীর অনুমতি ছাড়াই ফেসবুক যে কোনো সময় ফোনের মাধ্যমে সাউন্ড রেকর্ড ভিডিও করার ক্ষমতা রাখে

নেটফিক্স তাদের টার্মসের মাধ্যমে গ্রাহকের ডেটা ব্যবহার করতে পারে

যারা ট্রু কলার অ্যাপসটি ফোনে ব্যবহার করেন তাদের ফোন সেটের সকল ফোন নাম্বার এবং নাম প্রয়োজনীয় তথ্য ব্যবহারকারীর অনুমতির মাধ্যমেই তারা নিয়ে নিচ্ছে যদিও ব্যবহারকারী অনুমোদন করার সময় এসব মোটেও লক্ষ্য করেন না

বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো তাদের এই টার্মস অফ সার্ভিসের যুক্তি দিয়েই ব্যবহারকারীর সকল তথ্য দিয়ে ব্যবসা করছে তবে তারা গোপনেও যে তথ্য চুরি করছে সেটা স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু তা প্রমাণিত টার্মস অফ সার্ভিস বা যে কোনো মাধ্যমেই হোক গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করার বিষয়টি কতোটুকু নৈতিক হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে সেই প্রশ্নই উঠছে প্রতিটি মানুষের কিছু গোপনীয়তা থাকে সেটা রক্ষা করার অধিকারও তার আছে কিন্তু সোশাল মিডিয়াসহ এই সব বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো মানুষকে একবারেই নগ্ন করে দিচ্ছে

 

তথ্য খনির সন্ধানে

বড় কোম্পানিগুলো কেন এতো তথ্যের জন্য উদগ্রীব থাকে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর, অর্থের জন্য কমপিউটার যখন প্রথম আসে তখন সে মানুষ সম্পর্কে খুব কমই জানতো কিন্তু এখন কমপিউটার জানে না এমন বিষয় কমই আছে অর্থাৎ প্রযুক্তির উন্নতি এখন এমন অবস্থায় গিয়েছে যে, ইন্টারনেট অফ থিংকসের মাধ্যমে কমপিউটার এখন ব্যবহারকারীর কণ্ঠস্বরও চিনতে পারে ব্যবহারকারীর বায়োমেট্রিক তথ্য এখন হাতের মুঠোয় তারা জানে আপনি কী চিন্তা করছেন, আপনি কী ভাবছেন, কোথায় আপনি খরচ করতে যাচ্ছেন- সব

কোম্পানিগুলো ডেটা সংগ্রহ সংরক্ষণ করে কারণ ডেটা হলো তথ্য, তথ্য হলো শক্তি, আর এই শক্তিকে ব্যবহার করে অর্থ আয় করা সম্ভব যতো ডেটা আপনার হাতে থাকবে, ততো আপনি শক্তিশালী হবেন ততো টাকা আপনার হবে উদাহরণ দিয়ে বলা যায় অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের নাম তিনি ছোট একটি ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষের তথ্যকেই সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছেন এই ডেটা পরিণত হয়েছে তার শক্তিতে এখন তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এখন তার নতুন উদ্ভাবন হচ্ছে অ্যালেক্সা ডিভাইস যার মাধ্যমে এখন পরিবার ঘরের সকল তথ্য তিনি পেয়ে যাচ্ছেন!

 

প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ডেটা তৈরি হচ্ছে এই ডেটা বিশ্লেষণে কোম্পানিগুলো অ্যাডভান্স অ্যালগারিদম ব্যবহার করছে যাকে অনেকে বলছেন ডেটা মাইনিং বিপুল তথ্যের সমাহার ঘটায় একে বলা হয় বিগ ডেটা গত চার দশকের হিসাব অনুসারে প্রতি সোয়া তিন বছরে ডেটার পরিমাণ দ্বিগুণ হচ্ছে এখন এই হার বেড়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের পরবর্তী ধাপ ইন্টারনেট অফ থিংসের বিকাশের কারণে অনুমান করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডিভাইস থাকবে ইন্টারনেট অফ থিংস সংযুক্ত এই সব তথ্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কাজে পরবর্তীতে ব্যবহার করা হবে

বিগ ডেটা ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্টভাবে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছে অর্থাৎ যার যেমন ক্রেতা দরকার বিগ ডেটা সেই ক্রেতাকেই খুঁজে দিচ্ছে কিন্তু এই তথ্য শোষকরা যা করছে তা হলো ব্যক্তির নাম, আইপি অ্যাডড্রেস, বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার, আইডি নাম্বার, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারসহ সব তথ্যই হস্তগত করে ফেলছে ফলে একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক অবস্থান, যৌনজীবন, কী ঔষধ খাচ্ছেন, কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন সব তথ্যই হাজির করা সম্ভব যদি তার চাকরিদাতা বা যিনি তার সম্পর্কে তথ্য চাইছেন তিনি তা বিগ ডেটা কোম্পানিগুলো থেকে কিনে নেন বিগ ডেটা ব্যবসায়ীরা তাদের ক্লায়েন্টদের যেসব তথ্য দিচ্ছেন তাতে তারা শতভাগ গ্যারান্টি দিয়েই দিচ্ছেন কারণ একজন ব্যক্তিই নিজেও অনেক সময় নিজের তথ্য ভুলে যান কিন্তু বিগ ডেটা তা ভোলে না তথ্য সংগ্রহে তারা নৈতিকতার ধার ধারে না

অ্যাংরি বার্ডস, ক্যান্ডি ক্র্যাশ, ওয়ার্ডস উইথ ফ্রেন্ডস এমন ফ্রি অ্যাপসগুলো ডেটা কালেকশন ব্যবসায় প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তারা ব্যবহারকারীর ফোনের জিপিএস কানেকশনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তিনি কোথায় আছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কার কাছে যাচ্ছেন, কোন দোকানে কেনাকাটা করছেন এমন সব তথ্যসহ অনেক খুঁটিনাটি তথ্য জেনে যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি ফ্রি অ্যাপস মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করার সময় তারা অ্যাডড্রেস বুক অন্যান্য ফোল্ডারে ঢোকার অনুমতি নিয়ে নেয় ব্যবহারকারীরা অ্যাপসটি ব্যবহার করার আনন্দে দ্রুত সব অনুমোদন দিতে থাকেন এভাবে অ্যাপসের মাধ্যমে ফোনের যাবতীয় তথ্য বেহাত হয়ে পড়ছে যেমন সারাহাহ অ্যাপটি খুব জনপ্রিয় এই অ্যাপস মোবাইল ফোনের পুরো অ্যাডড্রেস বুক কপি করে নিচ্ছে

ডেটা ব্রোকাররা তথ্য নেয়ার জন্য বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে কুকিজ, ওয়েব বিকনস, -ট্যাগসহ বিভিন্ন টুলের সাহায্য নিয়ে তারা তথ্য সংগ্রহ করে ডেস্কটপ কমপিউটারে কুকিজ ব্যবহার করা হয় বেশি ইউজারের ব্রাউজারের মাধ্যমে এই ছোট কোডটি ঢুকিয়ে দেয়া হয় ওয়েব বিকন এক ধরনের স্বচ্ছ গ্রাফিক ইমেজ; যা ওয়েবসাইট, ইমেইল ইত্যাদিতে ছড়িয়ে থাকে

এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই তাদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস হিসেবে গ্রাহকের তথ্যকে ব্যবহার করছে; যা তারা আগে করতো না তারা তথ্য সংগ্রহ, সমন্বয় এবং ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করছে- যেমন ডেটা ব্রোকাররা করে থাকে এখন অনেক থার্ড পার্টি নিজেদের এই কাজে নিয়োজিত করেছে এক সময় পিসি বা ল্যাপটপ ছিল এসব কোম্পানির টার্গেট কিন্তু এখন মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে ব্যবহারকারীর হাতের মোবাইল ফোনটি

কুকিজ এবং অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে খুব সহজেই তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ডেটা ব্রোকারদের পক্ষে যেমন ডেটা ব্রোকাররা যদি ইমেইল বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে ব্যাংকের তথ্য নিয়ে নিতে পারে তবে অ্যাকাউন্ট নাম্বার, পাসওয়ার্ড, অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স অতীত লেনদেন, বিনিয়োগের তথ্যসহ নানা কিছু চলে যাচ্ছে ব্রোকারের হাতে

সোশাল মিডিয়া তথ্য সংগ্রহের সবচেয়ে বড় সম্পদ ফ্রি ইমেইল, ফ্রি অ্যাপস যেমন বিপজ্জনক তেমনি ফেসবুকের লাইক বা টুইটারের টুইট বাটনের মাধ্যমে একজনের তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায় ফেসবুকের সঙ্গে এক চুক্তি করেছে ডেটা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ডেটালজিক্স তারা ফেসবুকে ব্যবহারকারী কোন বিজ্ঞাপন দেখলেন তা নিয়ে কাজ করে যার ফলাফল হিসাবে তারা ওই প্রোডাক্টটি ব্যবহারকারীকে শেষ পর্যন্ত কিনতে প্রভাবিত করে

মাইক্রোসফটের কাছেও রয়েছে বিশাল তথ্য ভাণ্ডার তারা নাম, যোগাযোগের ঠিকানা, ডেমোগ্রাফিক ডেটা, কেনার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ে যে কোনো তথ্য তাদের কাছে সংগ্রহ করে

কথা এখন পরিষ্কার বলা যায়, একজন ব্যবহারকারী এসব কোম্পানির কাছে পরিণত হয়েছেন প্রোডাক্ট বা পণ্য হিসেবে কারণ তিনি অনলাইনে যা করছেন সবই নজরদারি করা হচ্ছে প্রতিটি কাজ প্রতিটি মুহূর্ত কারণ যতো বেশি তথ্য সংগ্রহ হবে ততো বেশি অর্থ আয় হবে পণ্য দাসত্বের যুগে মানুষকে তৈরি করা হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পণ্যরূপে

 

 

 

 

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,


মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

সম্পাদক, বিপরীত স্রোত। সাংবাদিক ও গবেষক। অ্যাসোসিয়েট ফেলো, রয়াল হিস্টোরিকাল সোসাইটি।



আরো পড়ুন