English
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশঃ ২০২১-০৫-১০ ১৬:১৬:৩৮
আপডেটঃ ২০২৪-০৩-২৫ ০৮:৪৮:৫৬


ঈদ মুবা ‘রক’ ভাই

 ঈদ মুবা ‘রক’ ভাই


রাশেদ জামান

 

সব মহল্লায় একজন সংস্কৃতমনা বড় ভাই থাকতেন আমাদেরও ছিল তিনি ছিলেন মহল্লার বিবেক

যে কোনো বিষয়ে ছোটদের কাউন্সেলিং এবং তরুণদের অবক্ষয় রক্ষার অমোঘ দায়িত্ব তিনি নিজ দায়িত্বে কাঁধে, ঠিক কবে তুলে নিয়েছিলেন তা কেউ জানে না

শৈশব থেকে দেখে মনে হয়েছে অনন্তকাল ধরে এই ভাই মনে হয় পাড়ার চায়ের দোকান, সেলুন অথবা এলাকার ক্লাব ঘরে দিনরাতের নানা সময়ে ফ্রি চেম্বার খুলে বসে ছিলেন আমি মাঝে মাঝে ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে এসে, হঠাৎ আন্দাজ করতে পারতাম না উনি কখন কোন সময় কোন চেম্বারে থাকতেনতাই প্রায় প্রতিদিন খুব সহজেই ফাঁদে ধরা পড়া মাত্র কমপক্ষে ঘণ্টা খানেক আমতা আমতা করে শেষ হয়ে যেতো

Non বাকের ভাই টাইপ, প্রায় সময় পাঞ্জাবি পরা এই বড় ভাই শীতের শুরুতে পাড়ার গলির মুখ সিলগালা করে, মহল্লার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে অন্য এক উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তেন টেনে হিঁচড়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হলেও আমাদের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের ভেতর থেকে সাংস্কৃতিক সত্ত্বা তিনি বের করে নিয়ে আসতে বাধ্য করতেন

মহল্লার মেয়েদের সামনে কবিতা আবৃত্তি অথবা অভিনয়ের আতংক, দু:স্বপ্নে আমার বহু নির্ঘুম রাত বার বার পানি খেয়ে এবং বাথরুমে আসা যাওয়া করে কেঁটেছে

তো যাই হোক বড় ভাইয়ের জীবনে একটাই আক্ষেপ ছিল, সেটা তার নিজেরনাম জন্মলগ্ন থেকে তিনি তাঁর নাম নিয়ে ছিলেন মহা অসন্তুষ্ট

সেটা আমরা জানতাম ভাই যেনো mind না খায়, তাই safe side - থাকার জন্য তাঁকে আমরা মহল্লার পোলাপানরা তাঁর অফিশিয়াল নামটা আস্তে করে বাদ দিয়ে শুধু  ‘ভাইবলে ডাকতাম হাতিরঝিলের ওই পাড়ে শহরের পুরনো প্রান্তে আমরা তখনোভাইয়াবলে ডাকার মতো আধুনিক হয়ে উঠিনি

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি শুধু আয়োজকই ছিলেন না, ছিলেন একজন তুখোড় উপস্থাপক ধারাভাষ্যকার তাই যখনই মঞ্চে তার নাম দেশি ফাটা মাইকে বিকট জোরে ঘোষণা করা হতো অথবা পাড়ার মুখে ব্যানারে বড় করে মোটা অক্ষরে লেখা হতো, সেটা শোনা বা দেখা মাত্র ভাইয়ের মেজাজ সাথে সাথে খুব খারাপ হয়ে যেতো

তিনি আবার একইসাথে মনে মনে ছিলেন একজন বিশাল রোমান্টিক কবি একবার নিজের নামের আগে তখনকার হালের ফ্যাশনরুদ্রশব্দটাও লাগিয়েছিলেন সেটাও শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হয়েছিলো কারণ বিষয়টাজমে নাই

দেয়াল পত্রিকা ছিল ভাই-এর আরেক কর্মযজ্ঞ বেশিরভাগ লেখা অবশ্য তার নিজেরই ছিল একদিকে বাসা থেকে হাতের লেখা সুন্দর করার কঠিন চাপ - অন্যদিকে ভাইয়ের চাপ, যদি বেশি সুন্দর হাতের লেখা তার নজরে ধরা পড়ে সারারাত ধরে দেয়াল পত্রিকা লেখাটা তখন দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়

হেলাল হাফিজনামের রমরমা যুগে তিনি তার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া জন্মগত নাম নিয়ে এমনিতে যা তা রকমের মনকষ্টে আছেন, তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে হাজির হলো এলাকার চোর আবিস্কৃত হলো যে, এক বছরে তিন তিনবার ধরা পড়া এই চোরের আসল নাম আর বড় ভাইয়ের নাম একই

 

আমরা তখন বছরে সর্বমোট দুইটা কোক খেতাম দুই ঈদে দুইটা আমি আমার নানার কাছ থেকে ঈদের সালামি পাওয়া মাত্র দৌড় দিলাম পাড়ার মুদির দোকানের দিকে বছরের 1st কোকটা খাওয়ার জন্য

গিয়ে দেখি ভাই ঠিক ঐখানে দাঁড়িয়ে সজোড়ে হাত পা নেড়ে কথা বলছেন মনে হয় ভীষন রেগে আছেন বাংলা ব্যান্ডফিডব্যাক’, ‘চাইম’, ‘ওয়ারফেজ’ বাদ দিয়ে ঈদের দিন মহল্লার মোড়ে হিন্দি গানের মতো সস্তা জিনিস কেন বাজানো হবে সে বিষয়ে তার তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখছেন কাকে যেন শাসাচ্ছেনও সাংস্কৃতিকভাবে বিপথী কিশোরদের কর্মকান্ডে ইতিমধ্যে চরম ক্ষিপ্ত তিনি

সেই সময়ে কিছু না বুঝে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমি বললাম, ‘ঈদ মোবারক মোবারক ভাই

তিনি হঠাৎ কথা থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা এক ভয় নিচে নেমে গেল আমি সেকেন্ডের মধ্যে ঠিক করে ফেললাম হিন্দি গানের ক্যাসেট যে আসলে আমার - সেই কথা আমাকে মেরে ফেললেও স্বীকার করবো না

 তিনি আমার দিকে সাঁই করে ঘুরে তাকিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে বললেন, ‘তুই আমার নাম দুইবার উচ্চারণ করলি ক্যান?

- জ্বী ভাই?

-তুই পর পর দুইবার আমার নাম কইলি ক্যান?

- ভাই, স্লামুআলাইকুম আমিতো আপনাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালাম

ভাই, একটু দম নিলেন তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বিকট চিৎকার করে বললেন, ‘ফাইজলামি করস? তাইলে তুই খালি ঈদ মোবারক কইলেইতো হইতো তুই মোবারক মোবারক ভাই কইলি ক্যান? আমার নাম পর পর দুই বার কওয়ার কি দরকার ছিল?’ 

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি খুব সম্ভবত অন্য সবার উপর যতো রাগ ছিল, এখন সব আমার উপর গিয়ে পড়েছে আমারই কপাল দোষে তবে ভাইয়ের নামজনিত বিষয়টা কতটাসেনসেটিভ’, ছোটবেলা থেকে খুব ভালোভাবে জানি বলেই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী উত্তর দিলে এই যাত্রায় মাফ পাবো

 

একটু FLASHBACK:

 

ততোক্ষণে আমি ভাইয়ের সেন্টু খাওয়ার কারণটা ভালোভাবেই বুঝে ফেলেছি ভাই আমাকে ছোটবেলা থেকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন যে, তাদের জেনারেশনের বাবা-মারা গরু ছাগলের মতো বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করে নাকি হাতের কাছে যে নাম পেয়েছে সেই নামই দিয়ে দিয়েছে জন্ম তারিখ লিখে রাখাতো দূরের কথা

ততোদিনে ক্যাডেট কলেজে চান্স পাবার কারণে তিনি আমাকে জীবনের জটিল সব বিষয় নিয়ে আলোচনার যোগ্য একজন মেধাবী মানুষ হিসেবে গণ্য করা শুরু করেছেন সবে মাত্র

আমি কী করে ভুলে গেলাম ভাই আমাকে কতবার দু: করে বলেছেন, ‘আচ্ছা তুই-ই বল, আমার নামটা কি আমার ক্যারেক্টারের সাথে যায়? আমি কি চিনির গুদামের আড়তদার? আমি তো আসলে একজন শিল্পী, আমি তো একজন কবি তুই কোনোদিন কোনো শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকের নাম শুনছোস- মোবারক?’

আমি অবশ্য যদিও শুনি নাই, তারপরেও মোবারক নামটার সাথে শিল্পী সত্ত্বার কোনো সংঘর্ষ, সমস্যা আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ করি নাই

সমস্যা আসলে করেছিলেন মহল্লার মুরুব্বী এবং মসজিদের বড় হুজুর সাহেব ভাইকে তারা চিনতেন তোবারকের পোলা মোবারকহিসেবে সেই নামেই ভাই-এর রেফারেন্স টানতেন তারা

মহল্লায় বড়দের বেশ অপছন্দের ঝগড়াটে (চিনি চোরাকারবারী হিসেবে জোড়ালো গুজবও ছিল) ‘তোবারক’  চাচা তার একমাত্র গুণধর ভবিষ্যত কবি ছেলের জন্মের পর নাম রাখার সময় আসলেই হাতের সবচেয়ে কাছেমোবারক’- মনে হয় খুঁজে পেয়েছিলেন অন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়ার কথাও না কাঠখোট্টা বদরাগী তোবারক চাচার জীবনে কাব্য থাকাটা কি আদৌ সম্ভব?

সাহস করে এই কথাটা কে বোঝাবে ভাইকে?

যাইহোক, নিয়েই ভাইয়ের অভিমানের শেষ নেইতোবারকের পোলা মোবারক’- এই টাইটেলটাই ভাইকে সারাজীবন neglected feel করিয়েছে বিশেষ করে মহল্লার এক ডাকসাইটে সুন্দরী আপা যখন সেই একই টাইটেল প্রয়োগ করে ভাইকে দাগা দিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, সবার সামনে মুচকি হেসেছিলেন পর পর বেশ কয়েকবার

এভাবেই ক্রমাগত চাপা অভিমানেমোবারকশব্দটার প্রতি ভাইয়ের ততোদিনে তৈরি হয়েছিল এক অজানা কড়া এলার্জি

 

Flash Forward:

এখনো মুদির দোকানের সামনে ভাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ঈদের দিন পাবলিকের সামনে চড় থাপ্পর খেলে মান ইজ্জত থাকবে না শিওর আমি তাই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললাম, ‘ভাই তাহলে ঈদের শুভেচ্ছা আপনাকে কীভাবে জানাবো?’

ভাই এক সেকেন্ডও না ভেবে বললেন,  ‘এখন থাইকা শুধু বলবিঈদের শুভেচ্ছা ভাই।’

- কিন্তু ভাই এইটাতো ঈদের দিন কেমন জানি যথেষ্ট ইসলামিক হইলো না

একটু চিন্তায় পড়ে গিয়ে ভাই এবার এক সেকেন্ড ভেবে বললো, তাইলে তুই শুধু বলবিঈদ মুবা-রক ভাই ঠিক আছে? ‘মুবা-রকমুবাটা আস্তে বলবি মনে থাকবো তো? আরেকবার যদি আমার নাম নিয়া ফাইজলামি করস তোর খবর আছে

আমি বুঝলাম কানের পাশ দিয়ে গুলি বের হয়ে ততোক্ষণে বহুদূর চলে গেছে আমি সাথে সাথে বসে পড়ে ভাইকে পর পর তিনবার পা ধরে ঈদের সালামটা সেরে ফেললাম ভাই, ‘আরে কী পাগলামি করতেছিসবলে বুকে শুধু জড়িয়েই ধরলো না, পাঞ্জাবির পকেট থেকে দশ টাকা সালামিও দিলো

আমি হাফ ছেড়ে আনন্দে বেশ আরাম করে রোজার ঈদেই একটার জায়গায় দুইটা কোক খেয়ে বাৎসরিক কোক খাওয়ার নিয়ম ভেঙ্গে ফেললাম

এই ঘটনার পর থেকে কেউ আমাকে ‘ঈদ মোবারকবললে কানে লাগে

পরিচিতজনদের এ কারণে বলি, আপনারা আমাকে মেসেজেঈদ মোবারকনা লিখে প্লিজ লিখবেনঈদ মুবারক ভাইয়ের কড়া এলার্জির কষ্ট আমি এখনো নিতে পারি না

 

মহা পরোপকারী মোবারক ভাই বহু বছর ধরে বসবাস করেন সুদূর আমেরিকাতে শুনেছি ওখানকার মহল্লার মুরুব্বীরা ওনাকে এখন ডাকেন Mr. “রকনামে আর পোলাপান ভালোবেসে নাকি আদর করে Rock Bro অথবা Rock Dude বলে জড়িয়ে ধরে

ভাইয়ের সাথে অনেক বছর পর ২০১৪ তে রোজার ঈদের দিন দেখা হয়েছিল প্রবাসে দেশি এক গ্রোসারি শপের সামনে টার্মিনেটর টাইপ কালো লেদার জ্যাকেট পরা মানুষটা আমাকে জড়িয়ে ধরার আগেই হাউ মাউ করে কেঁদে দিলেন আবেগে

তার শরীরের বাইরের খোলসটার নাম বদলে সলিড আমেরিকানরকহয়ে গেলেও, ভেতরটা কিন্তু এখনও বাংলার নরম কাঁদামাটিতে মাখামাখি

 

প্রিয় রক ভাই, আমি আপনাকে কতোদিন ঈদে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করি না?

আপনাকেঈদ মু-বা-রক

 


ক্যাটেগরিঃ জীবনধারা,


রাশেদ জামান

সিনেমাটোগ্রাফার। আর্কিটেক্ট। আয়নাবাজি মুভির সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী। টানা ছয় বছর কাজ করেছেন হলিউডের ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। স্টিল ফটোগ্রাফার হিসেবে তার তোলাছবি ব্যবহৃত হয়েছে ২০০৬ সালে বিশ্বখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘এ লিটল পিস’ পিকচার বুকের প্রচ্ছদে। আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করেছেন ইস্তানবুল, কায়রো এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে। আরো জানতে ভিজিট করুন : www.rashedzaman.com